শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১২

এক রক্তচোষার আর্তি

মানবধিকার কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান একটি সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে চিকি?সক সমাজকে রক্তচোষা বলে অভিযুক্ত করেন। হাসপাতালের বাথরুম পরিচ্ছন্ন না থাকা, ওষুধ না থাকার জন্য চিকি?সকদের দায়ী করে তাদের আর কত বাড়ি-গাড়ির প্রয়োজন তা জানতে চান। এ ঘটনার পর চিকি?সক সমাজের প্রতিনিধি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করলেও কোনো কোনো পত্রিকার ভেতরের পাতায় এক কলামে ছাপা হলেও বেশিরভাগ পত্রিকায় এর প্রয়োজনও মনে করেনি। চিকি?সকরা বরাবরই মিডিয়া বিমুখ। মিডিয়ার কথা শুনলে নম: নম: করে হাজার মাইল পালিয়ে বাঁচতে চান। ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডীন অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ। দেশের চিকি?সা ব্যবস্থা ও চিকি?সক সমাজের প্রয়োজনের তাগিদে তিনি বেশ কয়েকটি কলাম লিখে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন। বরাবরের মত এবারও আমার পরম পূজনীয় স্যার দৈনিক প্রথম আলোতে একটি কলাম লেখেন। স্যারের কলামের জবাবে অনেকেই কলাম লিখে স্যারকে কলমের খোঁচায় হেনস্তা করছেন।
আমি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ স্যার বা ড. মিজানুর রহমানের মত ব্যক্তিত্বের কাছে তুচ্ছ। সদ্য পাশ করা চিকি?সক সমাজের একজন। আমার অভিজ্ঞতা আব্দুল্লাহ স্যারের কাছে বালিকণার মত। তারপরও গত ২ বছরে যতটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তার আলোকে কিছু লেখার প্রয়াস পেয়েছি। লেখার পেছনে আরোও একটি কারণ আছে তা’হল আমি এখনও মস্ত বড় অধ্যাপক নই যে কাড়িকাড়ি টাকার পেছনে ছুটে নিজের মুল্যবোধ হারিয়েছি। আমার এ লেখাটি আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা তাই বর্ণনায় আমার কথা চলে আসায় পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক হলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
চিকি?সক হওয়ার ইচ্ছা আমার কোন কালেই ছিল না। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি চিকি?সকরা রক্তচোষা। আর যাই হই রক্তচোষা হওয়ার ইচ্ছা ছিলনা কখনও। মায়ের ইচ্ছা পুরণের জন্য স্বপ্নের বুয়েট,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে ভর্তি হই ঢাকার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে। পরীক্ষার আগে মাকে মনে মনে কতবার যে বকেছি তার ইয়াত্তা নেই। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু পড়া আর পড়া। কত রাত যে না ঘুমিয়ে কেটেছে তার হিসাব নেই। পাশ করার পর শিক্ষানবিশ চিকি?সক হিসেবে কাজ শুরু করি। সবার মত ভেবেছিলাম কষ্ট থেকে মুক্তি পাব। না এ যেন কষ্টে সাগরে এসে পড়া। রাত নেই দিন নেই শুধু কাজ আর কাজ। একবার তো একটানা ৫৬ ঘন্টা ডিউটি করলাম। একটা ঘটনা শেয়ার না করে পারছি না। এক স্বামীহারা মহিলার অপারেশন হবে। দু’ব্যাগ রক্ত দরকার। সারাদিন চেষ্টা সন্ধ্যায় একব্যাগ রক্ত জোগাড় করেছেন অসহায় মহিলার ভাই। আর একব্যাগ রক্ত কিছুতেই পাচ্ছেন না। আমার সহকারী রেজিস্ট্রারও অপারেশন শুরু করতে পাচ্ছেন না। সময়ের সাথে সাথে রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমার ডিউটি। খুব মায়া হল। নিজের রক্তের সাথে মিলে যাওয়ায় একব্যাগ রক্ত দিলাম। রক্ত পাওয়ায় অপারেশনের ব্যবস্থা করা হল। অপারেশন করছেন সেই সহকারী রেজিস্ট্রার আর তাকে সহায়তা করছি আমি। তিন ঘন্টার সে অপারেশনে রোগী বেঁচে যান। কিন্তু আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি। এ ধরণের ঘটনা ব্যতিক্রম ভাববেন না। গাইনি বিভাগে খোঁজ নিয়ে দেখুন কত চিকি?সকের দেয়া রক্তে অপারেশন শুরু হয়। 
ডিউডির রাতগুলো যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না। পরদিন সকালে যে বাসায় এসে ঘুমাব সে সুযোগ নেই। সারা রাত জেগে সাড়ে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত সময় দেয়া হয় ফ্রেস হয়ে নাস্তা করার জন্য। পরের দিন আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত চলে ডিউটি। সপ্তাহে এমন ২০ ঘন্টার রুটিন দু’দিন। বাকী পাঁচদিন ৮-১৬ ঘন্টা। একটুও এদিন ওদিক করার নেই। একদিন রাতে ডিউটি করে সকালে নাস্তা করে আসতে নয়টা বাজায় স্যারের কাছে যে বকুনি খেয়েছি তাতে চোখের জল ধরে রাখতে কষ্ট করতে হয়েছে। পরে এ ভেবে সান্ত¦না খুজেছি স্যার তো নিজের জন্য বকেন নি, রোগীর ভালোর জন্য বকেছেন। ভাবছেন কষ্ট তো করতেই হবে সরকার আমাদের অনেক টাকা যে সম্মানী দিচ্ছেন। হ্যাঁ সরকার আমাদের মত শিক্ষানবিশ চিকি?সকদের সম্মানী দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কত? নিজের সম্মানীর কথা বলতে পারি নি কাউকে। কেউ কেউ তো আমাদের ড্রাইভার বলেও ঠাট্টা করতেন। শুধু এটুকু বলি এক বছরে যা পেয়েছি তার এক কড়িও জমাতে পারিনি উল্টো বাবা-ভাইদের কাছে হাত পাততে হয়েছে। কতটা লজ্জা পেয়েছি বলে বোঝানো যাবে না। রোগীদের কাছ থেকে কি পেয়েছি? কোন দিন কেউ ধন্যবাদ দেয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি। আমি বা আমরা কারোও ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য কাজ করি না। কিন্তু এত কষ্ট করার পর আমারই কয়েকজন সহকর্মী ও সহপাঠী রোগীর আত্মীয়ের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন। এর মধ্যে মহিলা সহকর্মীও আছেন। কই লাঞ্চিতকারীদের বিচার হতে তো দেখলাম না। আমি একদিন আধাঘন্টা দেরি করার জন্য যে বকুনি খেয়েছি আমারই সহকর্মীকে মারধর করা হলেও তো তাদেরকে বকুনি খেতে দেখি নি। উল্টোটা মিডিয়ায় পড়েছি। শুধু আমার সহকর্মীর চোখের জল দেখেছি।
শিক্ষানবিশ চিকি?সক হিসেবে কাজ শেষ করার পর চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করি। শিক্ষানবিশ সময়ে তাও হাত খরচটা চলত এখন তো তাও নেই। কয়েক জায়গায় বায়োডাটা জমা দিলাম। ভাইভাও দিলাম। মাসখানেক চলল কোন ইনকাম ছাড়া। আবারও ভরসা ভাই।
ইতোমধ্যে অনারারী মেডিকেল অফিসার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে যোগদান করি। আমরা এটাকে বিদ্রুপ করে বলি অনাহারী মেডিকেল অফিসার। এদের কাজ প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে চিকি?সা করতে হবে, রাতের বেলা জাগতে হবে। বিনিময়ে বেতন কত? আশ্চার্য হলেও সত্য মাস শেষে একটা কণাকড়িও দিবে না সরকার বা হাসপাতাল। কত নির্মম-নিষ্ঠুর। সারা মাস পরিশ্রম করবেন, নিজের টাকায় যাতায়াত কবরেন কিন্তু একটাকাও পাবেন না। এ রকম অন্য কোনো পেশায় আছে কিনা তা জানা নেই। এভাবে কতদিন কাজ করতে হবে? একমাস, দু’মাস নয় টানা তিন-চার বছর। আমিও আছি এই দলে। 
টাকা তো প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালে অনাহারী ডিউটি করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে বাকি সময় ডিউটি করি। কোন দিন এমন হয় অনারারী ডিউটি করে ওই হাসপাতালে সরারাত ডিউটি করে আবার অনারারী করতে সকালে চলে যাই হাসপাতালে। বাসায় পেট ভরে খেয়ে আরাম করে ঘুমিয়েছি তা গননা করতে বললে গোনা যাবে। বেসরকারি যে হাসপাতালে কাজ করি সেখানে ঘুমাই কিভাবে শুনলে অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। একটা ৮ বাই ৮ হাত ঘরে চারজন চিকি?সক। দুজন একহাত প্রস্থের দুটি ব্রেঞ্চে ও দুজন ফ্লোরে। চিত-কাত পদ্ধতিতে শুতে হয়। শীতের মধ্যেও একটি মাদুর বিছিয়ে কত রাত কাটিয়েছি। গায়ে দেয়ার জন্য কম্বল দেয়া হয় না, দেয়া হয় ছেঁড়া দুটো বিছানার চাদর যেগুলো রোগীরা ব্যবহার করার পর ছিঁড়ে গেছে। বালিশ আছে তিনটি। একজনকে বালিশ বানাতে হয় মেডিকেল মোটা ডেভিসনের বই। বিশ্বাস হচ্ছে না। হলফ করে বলছি মিথ্যা বলছি না। খুব কম রাতই আছে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছি। একরাতে রোগীর ডাকে ৮-১০ বার পর্যন্ত ঘুম থেকে ওঠতে হয়েছে। রাত জাগা শরীর নিয়ে অনারারী ডিউটি করেছি। ভাবছেন চিকি?সক তার ওপর এত কষ্ট নিশ্চয় বেতনও পান স্বাস্থ্যবান। না, আপনার ধারণা ঠিক নয়। বেতন সর্বসাকুল্যে ১৬ হাজার টাকা যার অর্ধেকই খরচ হয় সরকারি হাসপাতালে বিনামুল্যে চিকি?সা দিতে গিয়ে।
নিজেকে খুব মেধাবী মনে করি না। তবে খারাপও তো না। এসএসসিতে আমি আমার জেলার মধ্যে প্রথমস্থান অধিকার করি। নটরডেম কলেজে আমার মেধাতালিকা ছিল ২৬ তম। আমার সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগ করতে ভয় করে। ফেসবুকের কল্যানে জানতে পারি তাদের অবস্থান। নটরডেম কলেজে সায়েন্স গ্রুপ-১ এ আমাদের প্রায় একশ’ ৬০ জন ছাত্রের মধ্যে যারা বুয়েট থেকে পাশ করেছে তাদের বেশিরভাগই আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসি রুমে বসে গবেষণা করছে। ইতোমধ্যে কয়েক বন্ধু নাকি গাড়িও কিনেছে। আর আমি? মাদুরে শুয়ে, বইয়ের বালিশে ঘুম জড়ানো চোখে অপেক্ষা করি কখন রোগী আসবে। শুধু জানতে ইচ্ছা করে আমি কি ওদের চেয়ে কম মেধাবী? নাকি মেডিকেলে পড়ার শাস্তি? 
বিয়ের কথা চলছে। পাত্রী আমার পাঁচ বছরের প্রেমিকা। পরিবারের সবাই রাজি। শুধু রাজি হতে পারি না আমি। স্বর্ণের এ র্দুমূল্যে এত টাকা জোগার হবে কিভাবে। এদিকে বয়স আমাদের তো থেমে নেই। এত দিনের প্রেমিকাকে ঠকাতে ইচ্ছা করে না। আমাকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে ২০-২৫ ভরি সোনা পেত অনায়াসেই। আমি ৩-৪ ভরি দিতেই ওর সাথে দরকষাকষি করে চলেছি। যদি এক ভরি কমানো যায়। ওর থরে থরে সাজানো স্বপ্ন নিজের হাতে ভেঙ্গে চুরমার করি। ওর মলিন মুখ দেখে কষ্ট পেলেও অন্য দিকে তাকিয়ে না দেখার ভান করি। নিজের কাছে খুব কষ্ট লাগে। সব কিছু বিস্বাদ মনে হয়। ইচ্ছা করে যদি ধুমধাম করে ওকে ওর মনের মত সাজিয়ে আনি। কিন্তু আমার হাত-পা বাধা। এত টাকা পাব কই? কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি, মাঝে মাঝে কয়েক ফোঁটা জল ফেলি।
পাশ করার দু’বছর হয়ে গেলেও পরিবারে একটা টাকা দিতে পারি নি। এখনও আমার খাবার বিল দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা আমার ২ বছরের বড় ভাই। মাসে সে যত টাকা আয় করে তার খরচ করার জয়গা বা কই? তাই আমার মত অসহায়কে সহায়তা করে পূণ্য বাড়ায়।
স্বপ্ন দেখি একদিন আমিও বড় চিকি?সক হব। আমার চেম্বারে রোগীদের লাইন পড়বে। হয়ত মুঠো মুঠো টাকা আসবে। একদিন গাড়ি-বাড়ি হবে। কিন্তু কবে? আজ থেকে আরোও ১০-১৫ বছর পরে। এত বছর পর আমি কি পারব আমার প্রেমিকার না পাওয়ার বেদনা মুছে দিতে। শেষ বয়সের আয়ে যদি তার পুরো শরীর সোনায় মুড়িয়ে দেই সে কি এখনের না পাওয়ার বেদনা ভুলতে পারবে? ভাইয়ের হাতে টাকা তুলে দিয়ে কি পারব এখনের লজ্জা পাওয়া স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে। আজও মা-বাবার হাতে পাঁচশ টাকা তুলে দিতে পারি নি। সে সময় কোটি টাকা দিলেও কি তাদের মন ভরবে? আর সে পর্যন্ত তারা যে জীবিত থাকবেন তার নিশ্চয়তাবা কে দেবে? মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই আমি রক্তচোষা। রক্ত চুষে রক্তশুন্য করে চলেছি আমার ভাই, মা-বাবা, প্রিয়তমাসহ পরিবারের সবার। বিবেকের কাছে আমি অপরাধী। আমি ওদের মানবাধিকার হরণ করে চলেছি প্রতিনিয়ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ