রবিবার, ২৫ মার্চ, ২০১২

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া- ৭ : বাড়ছে সবরকম শিক্ষা উপকরণের দাম স্কুলব্যয় মেটাতে হিমশিম অভিভাবক

সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে শিক্ষা উপকরণের দাম। কাগজ, কলম, রঙপেন্সিল, বই, ইরেজার, স্কেলসহ প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের দামই আকাশছোঁয়া। আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাসহ প্রতিটি পর্যায়েই শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে কিছু আমদানিকারক শিক্ষা উপকরণ আমদানি করছে না। এতে শিক্ষা উপকরণের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। যার ফলে দামও বেড়েছে।
তবে ক্রেতারা বলেন, ডলারের দাম বাড়ার তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে শিক্ষা উপকরণের দাম। আমদানিকারকরা ডলারের দাম বাড়ার সুযোগ নিচ্ছেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। আর শিক্ষায় অতিমাত্রায় বাণিজ্য প্রবেশ করায় শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েকদিন আগেও এক প্যাকেট কাগজের দাম ছিল ৩৫০ টাকা। একই কাগজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকায়। ৩৫ টাকার বড় খাতার দাম এখন ৪০ টাকা। ১৫ টাকার ছোট খাতা এখন ১৮ টাকা। কলমের দামও সম্প্রতি অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ১০টি কলমের একটি প্যাকেটের দাম ছিল ৩৫ টাকা। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ টাকা বেড়ে প্রতি প্যাকেট কলমের দাম দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকা। পিংক পয়েন্ট কলমের প্যাকেটের দাম ছিল ৩৮ টাকা। বর্তমানে এর দাম ৪০ টাকা। ইন্ডিয়ান প্রতি পিস কলম এখন ৯ টাকা, আগে ছিল ৭ টাকা। জেলপেনগুলোর দাম প্রতি পিসে ৩ টাকা বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে রঙপেন্সিলের। এর দাম প্রতি প্যাকেটে ২০ টাকা করে বেড়েছে। বহুল প্রচলিত ফেবার ক্যাসল ব্রান্ডের রঙপেন্সিলের প্যাকেট ছিল ১২০ টাকা। এখন সে রঙপেন্সিলের দাম ১৪০ টাকা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেখার পেন্সিলের দামও বেড়েছে। ১১০ টাকার এক প্যাকেট পেন্সিল এখন বাজারে বিক্রয় হচ্ছে ১৪০ টাকা।
ছোট ইরেজারের দাম আগে ছিল ৪ টাকা, এখন তা ৬ টাকা। বড় ইরেজারের দাম ছিল ১০ টাকা, এখন ১২ টাকা। এক বছর আগে ছোট ইরেজার ২-৩ টাকায় পাওয়া যেত, আর বড়টি পাওয়া যেত ৮ টাকার মধ্যে। জ্যামিতি বক্সের দাম বেড়েছে প্রকারভেদে ১৫-২০ টাকা। ৫০ টাকার ছোট জ্যামিতি বক্স এখন ৬৫ টাকা। আর ১০০ টাকার বড় জ্যামিতি বক্স এখন ১২০ টাকা। এক বছর আগে ছোট আকারের একই জ্যামিতি বক্স ৩৫-৪০ টাকা এবং বড়টি ৮০ টাকায় পাওয়া যেত।
শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি বেতনসহ অন্যান্য শিক্ষাব্যয় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। নামি দামি বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আকাশছোঁয়া বেতনের পাশাপাশি উন্নয়ন ফি’র নামে আদায় করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। তাছাড়া প্রাইভেট, কোচিং এবং নোট-গাইডের পিছনেও বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হয়। দ্রব্যমূল্যের চাপে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী দিশেহারা। এ অবস্থায় শিক্ষা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সন্তানের সুশিক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকেই।
একটি বেসরকারি স্কুলের সামনে কথা হয় রুমানা আক্তারের সঙ্গে। তিনি স্কুল থেকে তার তৃতীয় শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েকে নিতে এসেছেন। শিক্ষা উপকরণের দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়তই বই, খাতা, কলম পেন্সিলের দাম বাড়ছে। আমাদের আয় সেই হারে বাড়ছে না। এভাবে শিক্ষাসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকলে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে বলে তিনি জানান।
বিক্রেতারা বলছেন, কয়েক দিন ধরেই শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ছে। ডলারের দাম বাড়ার কারণেই এ অবস্থা। এতে অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ, ক্রেতারা এসব বুঝতে চান না। তারা বলেন, শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ক্রেতারা বিক্রেতাদের সঙ্গে দাম নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছেন।
জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি করা বইয়ের দামও বেড়ে গেছে। নীলক্ষেত ও আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানে দেখা যায়, যে বই কয়েকদিন আগেও ১২০ টাকায় বিক্রি হতো এখন সেটির দাম ১৬০ টাকা। বইয়ের দামের পাশাপাশি ফটোকপির দামও বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৭৫ পয়সা থেকে ফটোকপির রেট বেড়ে এক টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর অন্যান্য জায়গায় ফটোকপির দাম উঠেছে ২ টাকায়। ফলে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ফটোকপি করতেও ব্যয় বেড়ে গেছে। তবে এজন্য কাগজ ও কালির দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন দোকানিরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষা উপকরণের ৮০ ভাগই আমদানি করতে হয়। ফলে বিশ্ববাজারে এর দাম ঠিক থাকলেও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এসব উপকরণের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। চকবাজারের ব্যবসায়ী শরিফুল জানান, দেশীয় উপকরণের দাম কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না। বিদেশ থেকে যেগুলো আমদানি করতে হয়, সেগুলোর দামই বেশি বাড়ছে।
এ ব্যাপারে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল আমার দেশকে বলেন, শিক্ষার ব্যয়ভার চালিয়ে যাওয়া অনেক পরিবারের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি অভিভাবকদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুলের বেতন ও কোচিং ফি বৃদ্ধি। শিক্ষার মধ্যে অতিমাত্রায় বাণিজ্য প্রবেশ করায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি জানান।
ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ খুবই কম। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় আয়ের (জিডিপি) শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ আমাদের দেশে সরকার শিক্ষা খাতে ৩ শতাংশের কম অর্থ ব্যয় করছে। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা উপকরণের দাম কমাতে উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ