বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

শিল্পাঞ্চলে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের আদেশে দেশের উৎপাদন সব বন্ধ হয়ে যাবে। রফতানি ধসে পড়বে। সরকারের উচিত ষড়যন্ত্রকারী মহলের হঠকারী এ সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুত সরে আসা

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন দফতর থেকে কলকারখানায় চিঠি দিয়ে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বোরো উৎপাদনে সেচব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়েছে।
এতে করে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কলকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার উপর দিনে ৪-৫ ঘণ্টার লোডশেডিং তো আছেই। 
পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, বোরো মৌসুমের দুই মাস এভাবে চলতে থাকলে রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তারা দিনের বেলায় ১২ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন। ২৫ মার্চ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পোশাকশিল্পে গত বছর রফতানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪২ শতাংশ এবং অন্যান্য শিল্প খাতেও প্রবৃদ্ধির হার ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু চলতি অর্থবছরের (২০১১-১২) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি মাত্র ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ সময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম রফতানি হয়েছে, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক এ হার দেশের অর্থনীতির জন্য আশাপ্রদ নয়।
উল্লেখ্য, কৃষি খাতে সেচ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দেশের তৈরি পোশাক খাতটিও সংবেদনশীল। বিশ্বমন্দার প্রভাবে রফতানি কমে গেছে। যেসব অর্ডার হাতে আছে, তা বিদ্যুতের অভাবে সময়মতো সরবরাহ করা যাবে না, কিংবা আকাশপথে পাঠাতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
এদিকে দিনের চেয়ে রাতে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা বেশি অনুভব করছেন রি-রোলিং ও স্টিল মিল ব্যবসায়ীরা। দিনের তুলনায় রাতে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে বলে এ ধরনের কারখানায় রাতেই বিদ্যুৎ বেশি প্রয়োজন। কারণ গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ ছাড়া রি-রোলিং অচল। আবার দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় রি-রোলিংয়ের কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারছে না স্টিল মিলগুলো।
এ খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে স্টিল মিল চালু থাকলে রি-রোলিং মিলে ৪ দিন পরপর কাঁচামাল যাবে। ফলে উৎপাদন কমে রডের দাম বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমবে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এমনিতেই ব্যাংকের সুদের হার বেশি। তার উপর ব্যবসার এ রকম পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ঋণখেলাপি হওয়া ছাড়া তাদের উপায় থাকবে না।
জানা যায়, এরই মধ্যে রডের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার টন রড উৎপাদন করত। এ উৎপাদন এখন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। এখন রড উৎপাদনের মৌসুম চলছে। এ সময় উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে নন-গ্রেড রডের দাম ২-৩ হাজার এবং গ্রেড রডের দাম ১ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। বর্ষার আগ পর্যন্ত চাহিদা বেশি থাকায় রডের দাম আরও বাড়বে।
এদিকে গার্মেন্টেসের জরুরি শিপমেন্টের সময় যদি বিদ্যুৎ বন্ধের অনুরোধ না শুনে উৎপাদন চালু রাখতে চাওয়া হয়, তাও সম্ভব হচ্ছে না। কারখানায় জেনারেটর থাকলেও তা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আর যাদের ছোট কারখানা, তারা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আর বড় ধরনের উৎপাদন কমে যাওয়ায় সঠিকভাবে রফতানির চাহিদা মেটানো যাবে না। ফলে আমাদের রফতানি আদেশ অন্য দেশে চলে যাবে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে ফেলে দিবে। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত অন্তত: যেন রফতানিমুখী শিল্পগুলোকে এ সিদ্ধান্তের বাইরে রাখা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কারখানাগুলোতে বয়লার একবার বন্ধ হলে তা গরম হতেই সময় লাগে ৬ ঘণ্টা। সুতরাং ১২ ঘণ্টা যদি লোডশেডিং দেয়া হয় তবে তারা চাহিদা অনুযায়ী ফেব্রিক্স তৈরি করতে পারবে না। এমনিতেই গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের কারণে উৎপাদন অনেক কম। যদি ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়া হয় তবে উৎপাদন আরও ৬০ শতাংশের মতো কমে যাবে। ফলে স্থবির হয়ে পড়বে শিল্পকারখানা। এছাড়া অনেক কারখানায় শ্রমিকরা কাজের উপর মজুরি পায়। সেক্ষেত্রে তাদের মজুরি ব্যাপকভাবে কমে যাবে, যা শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হতে পারে।
উল্লেখ্য, দেশের রফতানি সেক্টরে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১ কোটির অধিক শ্রমিক বা কর্মচারীর কর্মসংস্থানের মাধ্যম প্রায় ৪ কোটি ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। এছাড়া এ সেক্টর থেকে গত বছর ২৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদ-। এখন সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে যদি শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিতে হয়, তবে সারাদেশে ব্যাপকভাবে বেকারত্ব বেড়ে যাবে, দেখা দেবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। তাছাড়া অর্থনীতিতেও চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রফতানি বাণিজ্যের মূল বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত ২০০৯ সালে এসব দেশগুলোতে মন্দা হওয়ার পরও প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইউরো জোনের গ্রীস,পর্তুগাল, স্পেন, ইতালিসহ অনেক দেশের ঋণ সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে পুনরায় মন্দা শুরু হয়েছে। এ মন্দায় দেশের রফতানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। রফতানি আদেশ ব্যাপক হারে হ্রাস পয়েছে।
শুধু তাই নয়, যেসব রফতানি আদেশ পাওয়া যাচ্ছে, তার রফতানি মূল্যের হারও হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া গত বছর ৪ দফা বিদ্যুৎ, পেট্রল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস ওয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। আর গত ডিসেম্বর মাসে (২০১১) বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ২১.২৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, যা রফতানি শিল্পের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া গ্যাস সঙ্কটের কারণসহ উপরের কারণ যোগ হয়ে কারখানার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রফতানিকারকদের সক্ষমতা হ্রাস করেছে।
এ অবস্থায় বিশ্ববাজারে রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিতেই কোনো স্বার্থান্বেষী মহল সরকারকে এ খাতে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সরকারও কোনো চিন্তা না করেই তা মেনে নিয়েছে। মূলত সরকারের এ সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল কাজ করছে। সরকারের উচিত এ হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে প্রকৃত অর্থে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা। দেশ জাতিকে রক্ষা করা।
মূলত সব সমস্যা সমাধানে চাই সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা তথা সততা। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন নেক কুওওয়ত। যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার সুমহান ছোহবত মুবারক-এ তা প্রাপ্তি সম্ভব। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সবাইকে সে মহান নিয়ামত নছীব করুন। (আমীন)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ