ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক জেমস ক্রফোর্ড ১৫ মার্চ ই-মেইলে এই লেখককে নিশ্চিত করেন যে সমুদ্র বিরোধের বিচারিক ইতিহাসে বাংলাদেশ বনাম মিয়ানমার মামলার রায় একটি নতুন ঘটনা। এই প্রথম সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধের রফা হলো ইটলস বা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। অধ্যাপক ক্রফোর্ড ১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্টে ব্যারিস্টার ও সলিসিটর হিসেবে পেশা শুরু করেছিলেন। হামবুর্গে বাংলাদেশের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের তিনি অন্যতম কুশলীব। রায় সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এটুকু বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এটা এক মহান জয়।’
এই মহান জয় কীভাবে এল, তার নেপথ্যে কূটনৈতিক নাটকীয়তা রয়েছে। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রশাসন গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারে না। কেউ কেউ বলেন, বিদেশিরা দ্রুত ঘরের কথা জেনে যায়। কিন্তু এই মামলা দায়েরের ঘটনা প্রমাণ করে যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গোপনীয়তা বজায় রাখতে জানে। চার মাস ধরে গোপনীয়তার মধ্যে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলেছে। এটা যদি ফাঁস হতো, তাহলে ভারত ও মিয়ানমার উভয়ে অস্ট্রেলিয়ার মতো কাণ্ড ঘটাত যে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের সঙ্গে কী কাণ্ড ঘটিয়েছে সে কথায় পরে আসছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত বুঝে নিয়েছিলেন যে ভারতের কাছ থেকে স্থল সীমান্তবর্তী জমি পাওয়ার অভিজ্ঞতা তিক্ত। ১৯৭৪ থেকে আজ পর্যন্ত স্থল সীমানা ঠিক করা সম্ভব হয়নি। আর সাগরে আমরা পারব কীভাবে। কোনো দিন ভারত সমুদ্রের জমির দাবি আপসে ছাড়বে না। তা ছাড়া সমঝোতার জন্য বাংলাদেশ তো ৩৫ বছর পার করেছে। এ রকম আরও ৪০-৫০ বছর ব্যয় করা যেতে পারে। সুতরাং এর বিকল্প হলো তৃতীয় পক্ষ মানে আদালতে যাওয়া।
সমুদ্র আইনের আওতায় তিনটা আদালত আছে। জার্মানিতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ল অব দ্য সি (ইটলস)। কিন্তু তাতে ভারতের সম্মতি লাগবে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ধরে নেন, ভারত রাজি হবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে ‘রান অব কুচের’ মামলায় হেরে যাওয়ার পর ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা আর আদালতের মুখ দেখবে না। দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করবে। দ্বিতীয় বিকল্প ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) যাওয়া। ভারতকে সেখানেও নেওয়া যাবে না, কারণ সেখানে তারা যাবে না বলে আগেই আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। তাদের মনোভাব হলো, সমুদ্রসীমা প্রশ্নে তারা হেগের ওই আদালতের রায় মানবে না। বহুকাল আগেই তারা ওই আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। আমাদের কূটনীতিক মহলে খবর ছিল, মিয়ানমারও এখানে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। তাই বাকি থাকে আরবিট্রেশন বা সালিস আদালত। অনেক ভেবেচিন্তে বাংলাদেশ সেখানে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, আগে আপত্তি না জানিয়ে রাখলে কোনো পক্ষের নোটিশ প্রদান বা মামলা দায়েরের উদ্যোগের পরে আর তা এড়ানোর উপায় থাকে না।
বাংলাদেশ বিচলিত ছিল আরেকটি কারণে। মিয়ানমার মহীসোপানের বিষয়ে দাবিনামা পেশ করেছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। ভারত দিল ১১ মে ২০০৯। বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল যে ভারত তার দাবিনামায় মিয়ানমারের জন্য একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তারা সাগরের ওই এলাকায় কোনো ধরনের বরাদ্দ রাখেনি। অন্যদিকে সমুদ্র আইনের আওতায় বাংলাদেশের দাবি পেশের সময় ফুরিয়ে আসছিল। মহীসোপানের দাবি মিয়ানমারের আগে দিতে পারলে হামবুর্গ থেকেই আমরা হয়তো চূড়ান্ত সুরাহা পেতাম। এখন হয়তো এমনকি পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। বিএনপি সরকার এ ক্ষেত্রে অমার্জনীয় উদাসীন্যের পরিচয় দিয়েছিল। মূল বিরোধ না মিটিয়ে তারা বঙ্গোপসাগরে ২৭টি ব্লক ঘোষণায় (ভারত ১০ ও মিয়ানমার ১৭টির বিষয়ে আপত্তি দিয়েছিল) মনোযোগী হয়েছিল। মিয়ানমার যে ১৭টির বিষয়ে আপত্তি দিয়েছিল, এখন রায়ের ফলে তার চার-পাঁচটা চলে যেতে পারে ওয়াকিবহাল সূত্রে একটা প্রাথমিক ধারণা পেলাম।
উপকূলঘেঁষা বেইজলাইন থেকে প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইল (২০০০ গজ) টেরিটরিয়াল ওয়াটার। উপকূল থেকে ২০০ মাইল হলো ইইজেড বা এক্সকু্লসিভ ইকনোমিক জোন। এর বাইরে মহীসোপান। ভারত ও মিয়ানমারের পছন্দের সমদূরত্ব পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ পেত ১৩০ মাইল। অথচ আমাদের মহীসোপানের দাবি ৪৬০ নটিক্যাল মাইল (ইইজেডসহ)। তার মানে ৩৩০ মাইল জায়গা ভারত ও মিয়ানমার ভাগ করে নিয়ে গিয়েছিল। এটা তারা জাতিসংঘের সিএলসিএসে পেশও করেছে, যা এখনো বিবেচনাধীন। এ ছাড়া বাংলাদেশ আরও কিছু তার্যাপর্যপূর্ণ ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছিল।
হতদরিদ্র পূর্ব তিমুর ধনী অস্ট্রেলিয়ার কাছে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমার সুরাহা চেয়ে আসছে। তিনটি আদালত থেকেই অস্ট্রেলিয়া নাটকীয়ভাবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, যাতে পূর্ব তিমুর আদালতে যেতে না পারে। চীনও তার সমুদ্র-প্রতিবেশীদের বাগে রাখতে একই কাজ করেছে। বাংলাদেশ তাই ভারত ও মিয়ানমারের কাছে অনুরূপ ফাঁদে পড়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। তারা আগেভাগে টের পেলে হয়তো তিনটি আদালত থেকেই নিজেদের আগাম সরিয়ে নিত। ভারত ও মিয়ানমারের কূটনীতি পরাস্ত করেছে বাংলাদেশ।
আইনে যেকোনো সদস্যরাষ্ট্রকে এভাবে বিচার-সালিশ থেকে একতরফা প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র আইনের ২৯৮ ধারার আওতায় এই অধিকার প্রয়োগ করা যায়। পূর্ব তিমুরে ৮০ মিলিয়ন ডলারের একটি গ্যাস ফিল্ড ছিল। অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা লাভের আগেই চুক্তি করল যে তোমরা পাবে ২০ মিলিয়ন ডলার আর আমরা পাব ৬০ মিলিয়ন ডলার। এই চুক্তিকালে শান্তিরক্ষায় অস্ট্রেলীয় সেনা পূর্ব তিমুরে ছিল। অস্ট্রেলিয়া জানত, পূর্ব তিমুর স্বাধীনতা পেলেই এ নিয়ে তারা আদালতে যাবে। তাই চুক্তি করেই অস্ট্রেলিয়া তিনটি আদালত থেকেই নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
তাই বাংলাদেশের ভয় ছিল যেহেতু ৩৩০ মাইল সাগর দুই প্রতিবেশী ভাগাভাগি করে নিয়েছে, এখন যদি তারা একসঙ্গে তিনটি আদালত থেকে প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য চিরতরে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমঝোতার দরজা বন্ধ হয়ে যেত। ভারত ও মিয়ানমার তখন হয়তো বলত, তোমাদের ১৩০ নটিক্যাল মাইল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কারণ তোমাদের উপকূলকে অবতল হিসেবে আমরা সৃষ্টি করিনি, এটা বিধাতার সৃষ্টি। ভারতীয় একজন অ্যাডমিরাল আলোচনার টেবিলে তেমনটা বলেছেনও। ভাগ্যিস, তারা চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো চাল চালেনি। অবশ্য প্রকৃতিকে বদলানো যায় না মর্মে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় যে নেই, তাও নয়। ইটলসের ২৩ বিচারকের অন্যতম ভারতীয় বিচারক চন্দ্রশেখর রাও। তিনি বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন করেই রায় লিখেছেন। ইটলস ওয়েবসাইটে ১৫১ পৃষ্ঠার রায়টি এক অর্থে পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। এর মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় শ, এটি পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। সব বিচারে ও অর্থে আদালতে যাওয়া সুচিন্তিত ও এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এমনকি অন্তত একজন বিচারক ভিন্নমত দিয়েছেন এই বলে যে বাংলাদেশের স্বার্থ আরও ভালোভাবে কেন দেখা হলো না। আদালতে যাওয়ার একটা গল্প আছে। সেটাই এখন বলি।
২০০৯ সালের এপ্রিল-মেতে আওয়ামী লীগ সরকার আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসের একটি অনন্য দিন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ভারত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে একই দিনে প্রায় একই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আনা হবে। তাই করা হয়েছিল। দুজনকে দুই কক্ষে বসানো হলো। কেউ জানতে পারলেন না তাদের একই উদ্দেশ্যে একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আনা হয়েছে। আর ঠিক একই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজনকে মিয়ানমার দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যখন রাষ্ট্রদূতদের কাছে চিঠি হস্তান্তর করা হয়, তখন তার অনুলিপি সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিশনেও হস্তান্তর করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। অনেকটা ফিল্মি কায়দায় পুরো ঘটনা ঘটে। পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস প্রথমে কথা বলেন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তবে এখানেও একটি টীকাটিপ্পনী আছে। সেটি হলো, ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে বিষয়টি প্রকাশ করার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি টেলিফোনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণার সঙ্গে এ নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসিয়ে রেখেই দীপু মনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। পররাষ্ট্রসচিব এরপরই পিনাক রঞ্জনের কাছে চিঠি হস্তান্তর করেন। পরে মিয়ানমারই সালিশি আদালতের পরিবর্তে ইটলসে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ তা মেনে ভারতকেও ইটলসে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। দিল্লি তাতে রাজি হয়নি। রাজি হলে সমুদ্রসীমার ভারতীয় অংশের মীমাংসার জন্য ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হতো না। অবাক বিষয়, মিয়ানমার ইটলসের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার তিন মাস পরে আকস্মিকভাবে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। জার্মানিতে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ১৪ জানুয়ারি ২০১০ ইটলসে পত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তি অগ্রাহ্য করেন।
এই বিজয় এক অবিস্মরণীয় বিজয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৪৪,০০০ বর্গ কিমির সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। ৪০ বছরের ব্যবধানে আরেক মার্চে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জাতিকে প্রায় একই আয়তনের এক নতুন ভাসমান বাংলাদেশ নিশ্চিত করেছে। এর প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইলের ওপর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব এবং অবশিষ্ট জলরাশির ওপর ‘সার্বভৌম অধিকার’ প্রতিষ্ঠিত হলো। ভারতের সঙ্গে অনুকূল ফয়সালা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন কমসে কম আরো অর্ধেক বা তার বেশি আয়তনের আরেকটি ভাসমান বাংলাদেশ মিলবে বলে আশা করা যায়।
বিশ্বের মানচিত্রে এক অবিসংবাদিত সমুদ্র-জাতির অভ্যুদয় ঘটেছে। সব বিভেদ ও দ্বেষ ভুলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমুদ্র জয়কে উদ্যাপন করা উচিত। দুঃখের বিষয়, ক্ষমতাসীন দল এমন এক তিক্ততার যুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যতিব্যস্ত ও বিরক্ত করে রেখেছে যে জনগণ যেন এই বিজয়ের গৌরবে প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না। বিএনপির নেত্রী কিন্তু কালেভদ্রে হলেও শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকেন। হামবুর্গের রায় এমনই এক অসামান্য তার্যাপর্যমণ্ডিত অর্জন, বেগম খালেদা জিয়ার উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন জানানো। আমরা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে এই জয়ের হিরণ্ময় নায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বাধীন টিমকে অকুণ্ঠচিত্তে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
এই মহান জয় কীভাবে এল, তার নেপথ্যে কূটনৈতিক নাটকীয়তা রয়েছে। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রশাসন গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারে না। কেউ কেউ বলেন, বিদেশিরা দ্রুত ঘরের কথা জেনে যায়। কিন্তু এই মামলা দায়েরের ঘটনা প্রমাণ করে যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গোপনীয়তা বজায় রাখতে জানে। চার মাস ধরে গোপনীয়তার মধ্যে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলেছে। এটা যদি ফাঁস হতো, তাহলে ভারত ও মিয়ানমার উভয়ে অস্ট্রেলিয়ার মতো কাণ্ড ঘটাত যে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের সঙ্গে কী কাণ্ড ঘটিয়েছে সে কথায় পরে আসছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত বুঝে নিয়েছিলেন যে ভারতের কাছ থেকে স্থল সীমান্তবর্তী জমি পাওয়ার অভিজ্ঞতা তিক্ত। ১৯৭৪ থেকে আজ পর্যন্ত স্থল সীমানা ঠিক করা সম্ভব হয়নি। আর সাগরে আমরা পারব কীভাবে। কোনো দিন ভারত সমুদ্রের জমির দাবি আপসে ছাড়বে না। তা ছাড়া সমঝোতার জন্য বাংলাদেশ তো ৩৫ বছর পার করেছে। এ রকম আরও ৪০-৫০ বছর ব্যয় করা যেতে পারে। সুতরাং এর বিকল্প হলো তৃতীয় পক্ষ মানে আদালতে যাওয়া।
সমুদ্র আইনের আওতায় তিনটা আদালত আছে। জার্মানিতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ল অব দ্য সি (ইটলস)। কিন্তু তাতে ভারতের সম্মতি লাগবে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ধরে নেন, ভারত রাজি হবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে ‘রান অব কুচের’ মামলায় হেরে যাওয়ার পর ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা আর আদালতের মুখ দেখবে না। দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করবে। দ্বিতীয় বিকল্প ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) যাওয়া। ভারতকে সেখানেও নেওয়া যাবে না, কারণ সেখানে তারা যাবে না বলে আগেই আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। তাদের মনোভাব হলো, সমুদ্রসীমা প্রশ্নে তারা হেগের ওই আদালতের রায় মানবে না। বহুকাল আগেই তারা ওই আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। আমাদের কূটনীতিক মহলে খবর ছিল, মিয়ানমারও এখানে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। তাই বাকি থাকে আরবিট্রেশন বা সালিস আদালত। অনেক ভেবেচিন্তে বাংলাদেশ সেখানে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, আগে আপত্তি না জানিয়ে রাখলে কোনো পক্ষের নোটিশ প্রদান বা মামলা দায়েরের উদ্যোগের পরে আর তা এড়ানোর উপায় থাকে না।
বাংলাদেশ বিচলিত ছিল আরেকটি কারণে। মিয়ানমার মহীসোপানের বিষয়ে দাবিনামা পেশ করেছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। ভারত দিল ১১ মে ২০০৯। বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল যে ভারত তার দাবিনামায় মিয়ানমারের জন্য একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তারা সাগরের ওই এলাকায় কোনো ধরনের বরাদ্দ রাখেনি। অন্যদিকে সমুদ্র আইনের আওতায় বাংলাদেশের দাবি পেশের সময় ফুরিয়ে আসছিল। মহীসোপানের দাবি মিয়ানমারের আগে দিতে পারলে হামবুর্গ থেকেই আমরা হয়তো চূড়ান্ত সুরাহা পেতাম। এখন হয়তো এমনকি পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। বিএনপি সরকার এ ক্ষেত্রে অমার্জনীয় উদাসীন্যের পরিচয় দিয়েছিল। মূল বিরোধ না মিটিয়ে তারা বঙ্গোপসাগরে ২৭টি ব্লক ঘোষণায় (ভারত ১০ ও মিয়ানমার ১৭টির বিষয়ে আপত্তি দিয়েছিল) মনোযোগী হয়েছিল। মিয়ানমার যে ১৭টির বিষয়ে আপত্তি দিয়েছিল, এখন রায়ের ফলে তার চার-পাঁচটা চলে যেতে পারে ওয়াকিবহাল সূত্রে একটা প্রাথমিক ধারণা পেলাম।
উপকূলঘেঁষা বেইজলাইন থেকে প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইল (২০০০ গজ) টেরিটরিয়াল ওয়াটার। উপকূল থেকে ২০০ মাইল হলো ইইজেড বা এক্সকু্লসিভ ইকনোমিক জোন। এর বাইরে মহীসোপান। ভারত ও মিয়ানমারের পছন্দের সমদূরত্ব পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ পেত ১৩০ মাইল। অথচ আমাদের মহীসোপানের দাবি ৪৬০ নটিক্যাল মাইল (ইইজেডসহ)। তার মানে ৩৩০ মাইল জায়গা ভারত ও মিয়ানমার ভাগ করে নিয়ে গিয়েছিল। এটা তারা জাতিসংঘের সিএলসিএসে পেশও করেছে, যা এখনো বিবেচনাধীন। এ ছাড়া বাংলাদেশ আরও কিছু তার্যাপর্যপূর্ণ ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছিল।
হতদরিদ্র পূর্ব তিমুর ধনী অস্ট্রেলিয়ার কাছে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমার সুরাহা চেয়ে আসছে। তিনটি আদালত থেকেই অস্ট্রেলিয়া নাটকীয়ভাবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, যাতে পূর্ব তিমুর আদালতে যেতে না পারে। চীনও তার সমুদ্র-প্রতিবেশীদের বাগে রাখতে একই কাজ করেছে। বাংলাদেশ তাই ভারত ও মিয়ানমারের কাছে অনুরূপ ফাঁদে পড়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। তারা আগেভাগে টের পেলে হয়তো তিনটি আদালত থেকেই নিজেদের আগাম সরিয়ে নিত। ভারত ও মিয়ানমারের কূটনীতি পরাস্ত করেছে বাংলাদেশ।
আইনে যেকোনো সদস্যরাষ্ট্রকে এভাবে বিচার-সালিশ থেকে একতরফা প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র আইনের ২৯৮ ধারার আওতায় এই অধিকার প্রয়োগ করা যায়। পূর্ব তিমুরে ৮০ মিলিয়ন ডলারের একটি গ্যাস ফিল্ড ছিল। অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা লাভের আগেই চুক্তি করল যে তোমরা পাবে ২০ মিলিয়ন ডলার আর আমরা পাব ৬০ মিলিয়ন ডলার। এই চুক্তিকালে শান্তিরক্ষায় অস্ট্রেলীয় সেনা পূর্ব তিমুরে ছিল। অস্ট্রেলিয়া জানত, পূর্ব তিমুর স্বাধীনতা পেলেই এ নিয়ে তারা আদালতে যাবে। তাই চুক্তি করেই অস্ট্রেলিয়া তিনটি আদালত থেকেই নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
তাই বাংলাদেশের ভয় ছিল যেহেতু ৩৩০ মাইল সাগর দুই প্রতিবেশী ভাগাভাগি করে নিয়েছে, এখন যদি তারা একসঙ্গে তিনটি আদালত থেকে প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য চিরতরে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমঝোতার দরজা বন্ধ হয়ে যেত। ভারত ও মিয়ানমার তখন হয়তো বলত, তোমাদের ১৩০ নটিক্যাল মাইল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কারণ তোমাদের উপকূলকে অবতল হিসেবে আমরা সৃষ্টি করিনি, এটা বিধাতার সৃষ্টি। ভারতীয় একজন অ্যাডমিরাল আলোচনার টেবিলে তেমনটা বলেছেনও। ভাগ্যিস, তারা চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো চাল চালেনি। অবশ্য প্রকৃতিকে বদলানো যায় না মর্মে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় যে নেই, তাও নয়। ইটলসের ২৩ বিচারকের অন্যতম ভারতীয় বিচারক চন্দ্রশেখর রাও। তিনি বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন করেই রায় লিখেছেন। ইটলস ওয়েবসাইটে ১৫১ পৃষ্ঠার রায়টি এক অর্থে পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। এর মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় শ, এটি পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। সব বিচারে ও অর্থে আদালতে যাওয়া সুচিন্তিত ও এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এমনকি অন্তত একজন বিচারক ভিন্নমত দিয়েছেন এই বলে যে বাংলাদেশের স্বার্থ আরও ভালোভাবে কেন দেখা হলো না। আদালতে যাওয়ার একটা গল্প আছে। সেটাই এখন বলি।
২০০৯ সালের এপ্রিল-মেতে আওয়ামী লীগ সরকার আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসের একটি অনন্য দিন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ভারত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে একই দিনে প্রায় একই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আনা হবে। তাই করা হয়েছিল। দুজনকে দুই কক্ষে বসানো হলো। কেউ জানতে পারলেন না তাদের একই উদ্দেশ্যে একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আনা হয়েছে। আর ঠিক একই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজনকে মিয়ানমার দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যখন রাষ্ট্রদূতদের কাছে চিঠি হস্তান্তর করা হয়, তখন তার অনুলিপি সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিশনেও হস্তান্তর করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। অনেকটা ফিল্মি কায়দায় পুরো ঘটনা ঘটে। পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস প্রথমে কথা বলেন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তবে এখানেও একটি টীকাটিপ্পনী আছে। সেটি হলো, ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে বিষয়টি প্রকাশ করার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি টেলিফোনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণার সঙ্গে এ নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসিয়ে রেখেই দীপু মনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। পররাষ্ট্রসচিব এরপরই পিনাক রঞ্জনের কাছে চিঠি হস্তান্তর করেন। পরে মিয়ানমারই সালিশি আদালতের পরিবর্তে ইটলসে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ তা মেনে ভারতকেও ইটলসে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। দিল্লি তাতে রাজি হয়নি। রাজি হলে সমুদ্রসীমার ভারতীয় অংশের মীমাংসার জন্য ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হতো না। অবাক বিষয়, মিয়ানমার ইটলসের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার তিন মাস পরে আকস্মিকভাবে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। জার্মানিতে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ১৪ জানুয়ারি ২০১০ ইটলসে পত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তি অগ্রাহ্য করেন।
এই বিজয় এক অবিস্মরণীয় বিজয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৪৪,০০০ বর্গ কিমির সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। ৪০ বছরের ব্যবধানে আরেক মার্চে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জাতিকে প্রায় একই আয়তনের এক নতুন ভাসমান বাংলাদেশ নিশ্চিত করেছে। এর প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইলের ওপর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব এবং অবশিষ্ট জলরাশির ওপর ‘সার্বভৌম অধিকার’ প্রতিষ্ঠিত হলো। ভারতের সঙ্গে অনুকূল ফয়সালা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন কমসে কম আরো অর্ধেক বা তার বেশি আয়তনের আরেকটি ভাসমান বাংলাদেশ মিলবে বলে আশা করা যায়।
বিশ্বের মানচিত্রে এক অবিসংবাদিত সমুদ্র-জাতির অভ্যুদয় ঘটেছে। সব বিভেদ ও দ্বেষ ভুলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমুদ্র জয়কে উদ্যাপন করা উচিত। দুঃখের বিষয়, ক্ষমতাসীন দল এমন এক তিক্ততার যুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যতিব্যস্ত ও বিরক্ত করে রেখেছে যে জনগণ যেন এই বিজয়ের গৌরবে প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না। বিএনপির নেত্রী কিন্তু কালেভদ্রে হলেও শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকেন। হামবুর্গের রায় এমনই এক অসামান্য তার্যাপর্যমণ্ডিত অর্জন, বেগম খালেদা জিয়ার উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন জানানো। আমরা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে এই জয়ের হিরণ্ময় নায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বাধীন টিমকে অকুণ্ঠচিত্তে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন