বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : ‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত


প্রথম পর্ব
গত সপ্তাহে সপরিবারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের বেশ কয়েকটি নিদর্শন রয়েছে। প্রায় পাঁচশ’ বছরের পুরনো ছোট সোনা মসজিদ, হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহ (র.)-এর মাজার এবং মাজার সংলগ্ন মসজিদ দেখতে দেখতে অতীতের বাংলাদেশের কথা কল্পনায় আনতে চেষ্টা করছিলাম। শাহ নেয়ামতউল্লাহর মতো ধর্ম প্রচারকরা এত দূরদেশে কেমন করে এসেছিলেন, কীভাবেই-বা এমন অপরিচিত, অজানা পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে ইসলাম প্রচার করে গেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। যাই হোক, এসব ঐতিহাসিক স্থান দেখা ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী নিয়ে আমার প্রবল কৌতূহল ছিল। স্কুলজীবনে ভূগোলের বইতে পড়েছিলাম মহানন্দা দার্জিলিং পাহাড় থেকে উত্পত্তি লাভ করে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়িতে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে শেষ হয়েছে মহানন্দার জলপ্রবাহের দীর্ঘ যাত্রা।
আমাদের গাড়ি মহানন্দা সেতুর ওপরে উঠতেই বড় হতাশ হলাম। নদীতে সামান্যই পানি রয়েছে। দেখলাম অনেক মানুষ গোসল করছে। তারা প্রায় মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে গোসল করলেও পানি কোমর পর্যন্তও পৌঁছায়নি। মনে হলো, হেঁটেই মহানন্দা পার হওয়া সম্ভব। কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জে করতোয়া নদী দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিনও একই রকম বিষণ্ন বোধ করেছিলাম। উজানেভারত কর্তৃক অব্যাহত পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের একসময়কার প্রমত্তা প্রতিটি নদীই এখন পূর্বের ছায়ামাত্র। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনে ভাটির দেশকে পানির ওপর যে অধিকার দেয়া হয়েছে, তার কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না সাম্রাজ্যবাদী ভারতের উন্মত্ত শাসকশ্রেণী। উপরন্তু, সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বাংলাদেশকে অধিকারবঞ্চিত করে বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশটিকে মরুভূমিতে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। এই প্রসঙ্গের আলোচনা আপাতত দ্বিতীয় পর্বের জন্য তুলে রাখছি।
৫৮টি নদী পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রবেশ করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ওপর দিয়ে এতগুলো আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হয়নি। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে। অবশ্য এই ৫৪টি নদীর সবগুলোই ভারত থেকে জন্মলাভ করেনি। যেমন গঙ্গা নদীর উত্পত্তিস্থল ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্য হলেও ব্রহ্মপুত্র নদের জন্ম হয়েছে চীন দেশের তিব্বত অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে। তিব্বতের সাংপো (Tsangpo), চীনের ইয়ারলাং জাংবো (Yarlang Zangbo), অরুণাচলের দিহাং (Dihang), আসামের ব্রহ্মপুত্র (Brahmaputra) বাংলাদেশে এসে নাম নিয়েছে যমুনা (Jamuna) নদী। সমস্যা হলো—
নদীগুলোর জন্ম
যে দেশেই হোক না কেন, ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীর ৪টি ব্যতীত সবগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভারত হয়েই। এই ভৌগোলিক কারণেই ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে তার পানি আগ্রাসনের অসহায় শিকারে পরিণত করাটা সহজ হয়েছে। এ দেশের সাধারণ জনগণ ভারত কর্তৃক উজানে মাত্র চারটি নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে অবগত আছে। এর মধ্যে গঙ্গা, তিস্তা এবং সম্প্রতি সারি নদীতে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। বরাক নদীর টিপাইমুখে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ নিয়েও গত তিন বছরে অনেক বিতর্ক হয়েছে।
কিন্তু, নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ। ভারত প্রকৃতপক্ষে কয়েক ডজন নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তত্কালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জাতীয় সংসদে আ ন ম ইউসুফের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, “India hampered the natural flow of 22 rivers and tributaries flowing from India to Bangladesh by constructing groynes and embankments. (Ref. India-Bangladesh Relations, Documents 1971-2002, Volume-II Edited by Avtar Singh Bhasin, Page 997) (ভারত ২২টি নদী ও উপনদীর ওপর গ্রয়েন ও বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে।)
১৯৮৭ সালে যেসব নদী, ছড়া এবং অন্যান্য জলপ্রবাহ থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহারের তথ্য বাংলাদেশ সরকারের জানা ছিল, সেগুলো হলো—গঙ্গা, তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, গোমতি, খোয়াই, মনু, কোদালিয়া, বাসালি ছড়া, ফুলছড়ি, আন্ধারমানিক ছড়া, ছাগলনাইয়া ছড়া, মহামায়ার ছড়া, গয়রা ছড়া, গজারিয়া ছড়া, কচুয়া ছড়া, মাবেসনদী ছড়া, মাতাই ছড়া, উজিরপুর ছড়া, চন্দনা ছড়া, রাজেশপুর-তেতুয়া ছড়া, কমলা ছড়া এবং ভৈরব-সাংলি নদী। ধারণা করতে অসুবিধা নেই, ১৯৮৭ সালের পর থেকে গত ২৫ বছরে আগের ২২টির অতিরিক্ত আরও অসংখ্য আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ থেকে ভারত বাংলাদেশকে অবহিত না করেই একতরফা পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখেছে।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়েই ভারত চুক্তি করেছে। সেটাও সম্ভব হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অগাধ দেশপ্রেম এবং প্রচণ্ড মানসিক দৃঢ়তার কারণে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের তত্কালীন একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কোনোরকম চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার অনুমতি দিয়ে দেশের যে সর্বনাশ সাধন করেছিলেন, তার থেকে নিষ্কৃতি পেতে জিয়াউর রহমান ভারতের পানি আগ্রাসনের বিষয়টিকে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি নবীন, দুর্বল রাষ্ট্রটির মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার শত্রু-মিত্ররা বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। আমি বিশ্বাস করি, তিনটি কারণে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন উচ্চতায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবেন যে আদালতকে ব্যবহার করেও ক্ষমতাসীনরা তার সেই অবস্থান কোনোদিন কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না। প্রথমত তিনি কেবল স্বাধীনতা ঘোষণাই করেননি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের সঙ্গে দেশপ্রেমিক সৈনিকদের যে ঐক্য রচিত হয়েছিল, সেটা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে মহিমান্বিত করেছিল। সর্বশেষ, সম্প্রসারণবাদী প্রতিবেশী ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করার ঝুঁকি নিয়েও জাতিসংঘে গঙ্গার পানির ওপর আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবি উত্থাপন। হয়তো সে কারণেই ১৯৮১ সালে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
গঙ্গার পানি সংক্রান্ত বিরোধ জাতিসংঘে পৌঁছে যাওয়ার প্রেক্ষাপটেই ভারত ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে পাঁচ বছরমেয়াদি একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। সেই চুক্তির ২ এবং ৩ নং ধারায় শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার ন্যূনতম পানি প্রবাহের ৮০ শতাংশ প্রাপ্তির বিষয়ে বাংলাদেশকে Guarantee দেয়া হয়। জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার চুক্তির মেয়াদান্তে ১৯৮২ সালের অক্টোবরে উপরোক্ত Guarantee clause বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে ভারত সরকারের সঙ্গে একটি ১৮ মাস মেয়াদি সমঝোতা স্মারক (MOU) স্বাক্ষর করে, যার মেয়াদ ১৯৮৪ সালের ৩০ মে শেষ হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ভারত আর গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন না করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে দ্রুত মরুকরণের দিকে ঠেলে দেয়। এ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় আবারও ভারতের পানি আগ্রাসনের বিষয়টি উত্থাপন করতে বাধ্য হন। সেই বক্তৃতায় তিনি বলেন, “The pledges given by India when the Farakka Barrage was commissioned remain unfulfilled. This unilateral withdrawal of water in complete disregard of the interests of the people of Bangladesh, has brought more than 40 million people in the Ganges basin-or, rather, the Padma basin-face to face with catastrophe, with disaster. ...
While the whole world is voicing concern about protection of the environment, a large proportion of Bangladesh’s population is being pushed to the threshold of poverty and destruction. This is nothing but a gross violation of human rights and justice. To put it simply, our economic structure is faced with disaster because of the Farakka Barrage.” (ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সময় ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অদ্যাবধি অপূর্ণ রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে এই একতরফা পানি প্রত্যাহার গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার ৪ কোটিরও অধিক জনগোষ্ঠীকে সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।...
সমগ্র বিশ্ব যখন পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণের এক বৃহত্ অংশকে দারিদ্র্য এবং ধ্বংসের দোরগোড়ায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। এটি মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের চরম লঙ্ঘন। সরলভাবে বললে ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চরম দুর্দশায় পতিত হয়েছে।)
বাংলাদেশের মাত্র দু’জন নেতাই ফারাক্কা বাঁধের মতো এদেশের মানুষের জীবন-মরণের ইস্যুটি দেশপ্রেম ও সাহসিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্থাপন করতে পেরেছেন। কাকতালীয়ভাবে তারা স্বামী এবং স্ত্রী।
শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের পছন্দের নেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করলে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেকাংশে বিসর্জন দিয়ে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পাদন করা হয়। কিন্তু, ততদিনে বাংলাদেশের জীবন ও জীবিকার কী পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছে, সেটি বুঝবার জন্য আজকের ক্ষীণকায়া পদ্মা এবং তার পানিশূন্য শাখা নদীগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই চলবে।
এবার তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় কপটতার অভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করা যাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অব্যবহিত পর তত্কালীন ওয়াপদার (Water and Power Development Authority) চেয়ারম্যান বিএম আব্বাস এ টি নয়াদিল্লিতে ভারতের সেচ ও বিদ্যুত্মন্ত্রী ড. কে এল রাও (উত্. ক. খ. জধড়)’র সঙ্গে আলোচনা শেষে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি যে যৌথ প্রেসব্রিফিং করেছিলেন সেখানেও তিস্তা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিল। উভয় পক্ষ থেকে সেদিন বলা হয়েছিল—’’There could be a joint India-Bangladesh study on silting particularly in the Teesta and other North Bengal river systems. (তিস্তা এবং উত্তরবঙ্গের অন্যান্য নদীসমূহের চর জেগে ওঠা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ সমীক্ষা হতে পারে।)
অর্থাত্ তিস্তার পানি প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়ায় তখনই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি ভারতকে অবহিত করা হয়েছিল। ‘বন্ধু’রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পানি সঙ্কট সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকা সত্ত্বেও তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণের কাজ বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় মন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ নদী কমিশনের (Joint River Commission) সভায় প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, গজলডোবা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানির ২৫ শতাংশ তিস্তা নদীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা হিসেবে অব্যবহৃত রেখে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ ভারতের প্রাপ্য হবে। সেই সভায় যৌথ নদী কমিশনকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে যথাযথ চুক্তি প্রণয়নের নির্দেশ দেয়া হয়। বলাই বাহুল্য, সেই ৯০ দিন আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি! ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার পানি সমস্যা সমাধানকল্পে Joint Committee of Experts (JCE) গঠিত হয়। নবগঠিত কমিটিকে তিস্তা ছাড়াও মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার মোট সাতটি নদীর পানি বণ্টন প্রস্তাব দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ভারতের অনাগ্রহে এই কমিটি সময়ক্ষেপণ ব্যতীত আর কিছু যে অর্জন করতে পারেনি, সেটি ২০০০ সালের জানুয়ারির ১২ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৪তম সভায় প্রদত্ত বাংলাদেশের তত্কালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যের মাধ্যমেই উঠে এসেছে। তিনি সেদিন বলেছিলেন, During it’s Thirty-second meeting held in July, 1997 the Commission had set up a Joint Committee of Experts (JCE) to work out arrangements for long term sharing of the waters of common rivers between the two countries, according priority to the Teesta. The JCE in its first meeting held in August, 1997 had agreed to take up seven rivers namely the Teesta, Manu, Khowai, Gumti, Muhuri, Dharla and Dudhkumar to work out sharing arrangement in the first phase, according priority to the Teesta as mandated. Thereafter, The JCE, I am informed, had held only two meetings during the years 1999 and 2000. More than three years have elapsed since the JCE was constituted, but it is yet to submit any proposal to the Commission for sharing the flows of the Teesta, let alone other rivers.’’ (১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বত্রিশতম বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের কমিটি (JCE) গঠন করে কমিটিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলির মধ্যে তিস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল নদীর পানিবণ্টনের দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। একই বছরের আগস্টে JCE তাদের প্রথম বৈঠকে তিস্তার অগ্রাধিকারসহ মনু, খোয়াই, গোমতি, মুহুরি, ধরলা এং দুধকুমার নদীর পানিসমস্যা প্রথম পর্যায়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সময় থেকে গত তিন বছরে JCE’র আর মাত্র দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। JCE গঠনের তিন বছরেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অন্যান্য নদী তো দূরের কথা তিস্তার পানিবণ্টনের কোনো প্রস্তাব পর্যন্ত কমিশনের কাছে উত্থাপন করা হয়নি।)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময় অন্যতম ভারতবান্ধব রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যে হতাশার সুরটি এখানে যথেষ্টই স্পষ্ট। সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, “The flow of Teesta has drastically declined from normal 7000 cusec to less than 600 cusec in the first ten days of January this year. অর্থাত্ জানুয়ারির প্রথম দশ দিনের তিস্তার প্রবাহ স্বাভাবিক ৭০০০ কিউসেক থেকে অবিশ্বাস্যভাবে হ্রাস পেয়ে ৬০০ কিউসেকেরও নিচে নেমে গেছে। যৌথ নদী কমিশনের এই সভার কদিন পরই অনুষ্ঠিত JCE’র সভায় তিস্তার পানিবণ্টনের একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির খসড়া বাংলাদেশ উত্থাপন করলেও ভারতীয় পক্ষ এ নিয়ে কোনো আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশের সেই প্রস্তাবে গজলডোবা পয়েন্টে ৩০ শতাংশ পানি নদীর জীবনধারণের জন্য রেখে দিয়ে বাকিটা দুই বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে সমানভাবে ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয়া হয়। তিস্তা থেকে ভারতের সেই একতরফা পানি প্রত্যাহার আজও শেষ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, বাংলাদেশের বর্তমান ভারতপন্থী সরকারের ততোধিক ভারতপন্থী উপদেষ্টাদ্বয় ড. গওহর রিজভী এবং ড. মশিউর রহমান দেশবাসীকে আশার বন্যায় ভাসিয়ে দিলেও উত্তরের তিস্তা পানিশূন্যই থেকেছে। এরপরও আমাদের মেনে নিতে হবে ভারত নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র! তিস্তা প্রসঙ্গে একটা উড়ো গল্প বলে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রথম পর্ব লেখা শেষ করব।
ক’দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি দেশের প্রধান জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক এবং আওয়ামীপন্থী কলামিস্টদের এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আমারও সেখানে দাওয়াত থাকলেও আওয়ামী মিলনমেলার সুর কেটে যাবে ভেবে আমি অনুপস্থিত ছিলাম। আমি গেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে সরকারি পয়সায় সরবরাহকৃত নানারকম সুখাদ্যের স্বাদ অনেকের কাছেই তেতো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। যাই হোক, সেই নৈশভোজে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট সুশীল(?) কলামিস্ট নাকি অনুচ্চ কণ্ঠে তিস্তা চুক্তি প্রণয়নে ব্যর্থতার বিষয়ে দীপু মনির কাছে অনুযোগ করছিলেন। সেই সন্ধ্যায় যথেষ্ট ব্যাকুলতার সঙ্গেই তিনি বলেছেন, তিস্তার সমাধান না হলে তাদের পক্ষে সরকারের দালালী চালিয়ে যাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। ভারতের সঙ্গে অন্তত কোনোরকম চুক্তি একটা না হলে দালালী অব্যাহত রাখাটা তাদের জন্য বিপজ্জনক। ভারতের অব্যাহত প্রতারণায় এ দেশের জনগণ ক্রমেই খেপে উঠতে শুরু করেছে। সুতরাং, পানি আসুক আর না আসুক, নিদেনপক্ষে চুক্তি একটা হলেই সেই চিহ্নিত ভারত বন্ধুরা সদলবলে নাকি দেশপ্রেমিক জনতার ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারতেন। দেখা যাক, বাংলাদেশের জনগণ এই ভারতীয় রাজাকারদের লেখালেখিতে কতদিন আস্থাশীল থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ