রবিবার, ১৮ মার্চ, ২০১২

বিমানবন্দরে সক্রিয় ২৫ মুদ্রা পাচারকারী চক্র

শুধুমাত্র হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। তবে দেশের আরও দু’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে পাচার হওয়া  বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ অন্তত আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। গ্রেপ্তারকৃত আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারকারী চক্রের গডফাদার মামুন আল আজাদ ওরফে সুমন জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য জানিয়েছে। র‌্যাব জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো ঘিরে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ২০-২৫টি চক্র তৎপর। এদের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগ, নিরাপত্তা, সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের। মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত সরকার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও। বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ পাচারকৃত বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব ১-এর একটি বিশেষ দল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভিযান চালায়। দুই সহযোগী মোশারফ হোসেন ও জুয়েল হোসেনসহ সুমন গ্রেপ্তার হয়। তাদের কাছ থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত সুমনকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বিমানবন্দর থানা পুলিশ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য এ প্রসঙ্গে বলেন, এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকছে না। 
ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি: র‌্যাব জানিয়েছে, মূলত দু’টি কারণে  বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। একটি হচ্ছে আমদানিকৃত মূল্যবান পণ্য আন্ডার ইনভয়েস (প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কমমূল্য) দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া। অন্যটি বেশি দামে বিদেশের কালোবাজারে মুদ্রা বিক্রি। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রায় কালো টাকাও পাচার হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় বলেছেন, পাচারকৃত এ অর্থ দিয়ে কি ধরনের পণ্য আনা হচ্ছে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
জড়িত মানি এক্সচেঞ্জ: গ্রেপ্তারকৃত সুমন জানিয়েছে, রাজধানীর বেশির ভাগ মানি এক্সচেঞ্জ মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত। চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা তারা পাচারচক্রের হাতে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা একসঙ্গে করে তা পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে চক্রের সদস্যরা। এ কাজে দেশীয় সিন্ডিকেটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটও সক্রিয়। বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্সগুলোও তাদের সহায়তা করে। 
কোটিপতি হওয়ার মেশিন: সূত্র জানিয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অল্প সময়ে কোটিপতি বনে যাওয়ার মেশিনে পরিণত হয়েছে। বিমানবন্দরের শুল্কবিভাগে ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পেতে ১ থেকে ২ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। বিমানবন্দর শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের বেনামী ব্যাংক একাউন্টে জমা হয় কোটি কোটি টাকা। এছাড়া বিমানবন্দর নিরাপত্তা শাখা ও সিভিল এভিয়েশনের বিভিন্ন পদেও টাকা আয়ের শেষ নেই। 
শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িত: র‌্যাব জানিয়েছে, বিমানবন্দরে মুদ্রা পাচারের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও জড়িত। শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান, সাগর, মুরগি মিলনের নেতৃত্বে মুদ্রা পাচার সিন্ডিকেট তৎপর ছিল। পরে আরও একাধিক সিন্ডিকেট তৈরি হয়। র‌্যাব ১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রাশিদুল আলম বলেন, মুদ্রা বহন ও পাচারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর নিজেই পাচার সিন্ডিকেট তৈরি করে। এক একটি সিন্ডিকেটে ৬-৫ জন করে সদস্য থাকে। তিনি বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে অন্তত ২০টি চক্রের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিটি চক্র অবৈধভাবে মুদ্রা পাচার করে মাসে ৫০ লাখ টাকার বেশি আয় করে। 
সবই জানে কর্তৃপক্ষ: গত বৃহস্পতিবার টাকার চালান জব্দ করার সময় র‌্যাব দেখতে পায় স্ক্যানার ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা হয়নি। টাকাগুলো সাধারণ প্যাকেটেই পাচার করা হচ্ছিল। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, এ থেকেই বোঝা যায় তাদের মধ্যে ধরা পড়ার কোন ভয় ছিল না। র‌্যাব ১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রাশিদুল আলম বলেন, টাকার ব্যাগটি জব্দ করার পর স্ক্যানারে দেয়া হয়। তখন স্পষ্টভাবেই বান্ডিল বান্ডিল টাকা দেখা যায়। এ সময় শুল্ক বিভাগ ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারাও ছিলেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া মুদ্রার চালান বিমানে তোলা অসম্ভব।   
মাসোহারা পৌঁছে যায়: মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র গতকাল পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মানবজমিনকে জানায়, বিমানবন্দর শুল্ক বিভাগ, সিভিল এভিয়েশন, নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা পান। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে একটি সুতাও পার করা সম্ভব নয়। তবে লেনদেনে বনিবনা না হলে বা মাসোহারার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে দু’একটি চালান ধরা হয়। বিমানবন্দর থানা পুলিশও মোটা অঙ্কের মাসোহারা পায়- এমন তথ্য জানিয়েছেন ওই সূত্র। তবে মাসোহারা পাওয়ার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিমানবন্দর থানার ওসি সামসুদ্দীন সালেহ আহমেদ। 
স্পর্শকাতর অভিযান: নগদ অর্থ উদ্ধার অভিযান স্পর্শকাতর। কেননা, উদ্ধারকৃত অর্থের পরিমাণ নিয়ে অনেক সময়ই প্রশ্ন ওঠে। তাই অনেকেই এসব অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত হন না। র‌্যাব ১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রাশিদুল আলম বলেন, উদ্ধারকৃত অর্থের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এমন বিষয় মাথায় রেখেই অভিযানের সময় বিমানবন্দরে কর্মরত সব সংস্থার সামনে অর্থ জব্দ করা হয়। সাধারণ কয়েকজন নাগরিককেও সাক্ষী রাখা হয়। তাদের উপস্থিতিতে টাকা গণনা করা হয়। সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেই অভিযান চালায় র‌্যাব। তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধে গ্রেপ্তারকৃতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ কমবে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে উৎসাহিত হবেন অনেকেই।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ