প্রথম মৃত্যু দেখি যখন আমি ক্লাস ফোর অথবা ফাইভে পড়ি। মৃত্যু দেখা বললে
ভুল হবে। বলা উচিত মৃত মানুষ দেখা। মানে লাশ দেখা। আমার মেজো চাচার লাশ।
রমজান মাসে তিনি মারা গিয়েছিলেন। আব্বুকে সেদিন প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম।
সেই ছোট্ট মনে একটা লাশ দেখার চেয়ে আব্বুর চোখের পানি আমাকে বেশী অবাক
করেছিল। এরপর অনেক আত্মীয় স্বজন বা প্রতিবেশীর মৃত্যুর খবর শুনেছি, লাশ
দেখেছি। সাময়িক একটা কষ্ট পেয়েছি। হয়তো একদিন বা দুইদিন সেই কষ্টের রেশ
থাকতো। তারপর আবার স্বাভাবিক। ভাবনাটা হয়তো এমন ছিলো যে, জন্ম হয়েছে,
মৃত্যু তো হবেই।
কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা খেলাম আব্বুর মৃত্যুর পর। তার আগে বলে নেই, আমরা ভাই বোনেরা আব্বুকে ভয় পেতাম। অথচ আব্বু কোনদিন আমাদের গায়ে হাত তুলেনি বা উল্লেখযোগ্য কোন বকা দেয়নি। তারপরও ভয় পেতাম। যত আবদার, যত কথা হতো আম্মুর সাথে। গান গাওয়ার শখ ছিল, ছবি আকার শখ ছিল। কিন্তু আব্বুর জন্য সব বন্ধ ছিল। আব্বু যে আমার ভালোর জন্যই বলতো সেটা এখন বুঝি। বেশী জামা কাপড় বানানো যাবে না। সব কিছু রুটিন মাফিক হতে হবে। সব খাবার খেতে হবে এমনকি চিরতার পানিও বাদ নেই। মিষ্টি আলু অসহ্য লাগতো। বাসায় টিচার আসতো, উনাকেও জোর করে মিষ্টি আলু খাওয়াতো। সকাল বেলা ফ্যান বন্ধ করে দেওয়া হতো, যাতে ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ি। এমন অসংখ্য নিয়ম নীতি। খুব রাগ লাগতো আব্বুর উপর।তখন যদি ভোট দিতে বলা হতো, তাহলে হয়তো আম্মুকেই ভোট দিতাম। যাই হোক, আব্বু যখন মারা গেলো, তখন বুকের ভিতর কেমন খা খা করে। আব্বু মারা গিয়েছে ২০০৬ সালে। তখন থেকে আজ অবধি এমন কোন সময় নেই যে আব্বুর কথা চিন্তা করিনা। আব্বু বেচে থাকার সময় মনে হয় আব্বু কে নিয়ে এত চিন্তা করিনি। আব্বু যে কত আদর করতো সেটা বেশী অনুভব করি তার মৃত্যুর পর।
দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলাম আমার ফুফু শাশুড়ীর মৃত্যুর সময়। উনি বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা ছিলো। খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার। সন্তানেরা, আত্মীয় স্বজনরা লাইফ সাপোর্ট খুলতেও পারছিলো না আবার কন্টিনিউ করাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞান মানুষকে কত দ্বিধা দ্বন্দে ফেলে দেয়! প্রায় মাসখানেকের উপর লাইফ সাপোর্ট দেয়া অবস্থায় ছিলেন। এরপর চলে গেলেন। এমন একটা খবর যে কোনদিন আসবে, তাই সবাই প্রস্তুত ছিলো। খবর শোনার সাথে সাথেই পড়লাম ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। অর্থাৎ আমরা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছি আবার আল্লাহর কাছেই চলে যাবো।
আব্বু মারা গিয়েছিলো ফজরের সময় আর দাফন করা হয়েছিলো যোহরের সময়। আসরের নামাযের আগে কি বৃষ্টি। মনে হচ্ছিলো আমার আব্বুটা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে, একা একা কবরে শুয়ে আছে, আমরা কিছুই করতে পারছিনা। মানুষ কতোটা অসহায়। চাইলেও কিছু করতে পারবো না। আব্বুও নিজে তার টাকা পয়সা, বাড়ি ঘর, পরিবার নিয়ে কিছু করতে পারবে না। আব্বু এখন একা, একদম একা।আমার ফুফু শাশুড়ীর মৃত্যুর সময় একি রকম অবস্থা। সবাই চেষ্টা করছিলো। একটা মানুষ দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছে, চোখের সামনে দেখতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। মৃত্যুর প্রহর গুনছিলো সবাই। তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন। আমরা দেখছি তিনি ঘুমিয়ে আছেন, কিন্তু আল্লাহই জানেন ফুফু তখন কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। কত অসহায় আর একা।
এই যে আমরা বেচে থাকি আমাদের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে, আমাদের বাড়ি ঘর, সম্পত্তি, টাকা পয়সা নিয়ে, এগুলো কি আমরা সব মৃত্যুর সময় সাথে নিয়ে যেতে পারবো? মোটেও না। আমি জোর করে নিয়ে গেলেও আমার কোন লাভ নেই। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। এক কৃপণ লোক মৃত্যুর সময় তার বৌকে বললো যে, আমি মরে গেলে আমার ব্যাংকের সব টাকা কবরে রেখে দিবে। বৌ বললো, আচ্ছা দিবো। বৌ আবার স্বামীর কথার অবাধ্য হয়না। যখন লোকটি মারা গেলো বৌ কথা মতই কাজ করলো। বৌ এর প্রতিবেশী তাকে মনে করিয়ে দিলো, তুমি কি তোমার স্বামীর সব টাকা সাথে দিয়ে দিয়েছো? তখন বৌ বললো, হ্যা, সব টাকা তার চেকে লিখে দিয়েছি, এখন সে যখন ইচ্ছা সাক্ষর দিয়ে টাকাগুলো উঠিয়ে নিতে পারবে।
কি সাঙ্ঘাতিক, কি কষ্টের তাই না! আমার চারপাশে যা আছে, যা নিয়ে আমার অহংকার, আমার ব্যাংক ব্যালেন্স, আমার যশ, আমার নিজের ডিগ্রী, আমার ছেলে মেয়ের ডিগ্রী ইত্যাদি কোনটাই সাথে নিতে পারবো না। কেনো? কারণ আমার চারপাশের কোন কিছুই আমার না। এমন কি আমার শরীরটাও কিন্তু আমার না। আল্লাহ এসব আমাকে দিয়েছেন আমার চলার পথের সুবিধার জন্য। উনি দিয়ে দেখছেন আমি এসব দিয়ে কি করি। ব্যাপারটা অনেকটা কোন কিছু ধার দেওয়ার মত। আল্লাহ এসব ধার দিচ্ছেন আমাদের, আবার যখন ইচ্ছা নিয়ে নিচ্ছেন। জিনিসের মালিক যখন চাইবে, তখন তো তাকে ফেরত দিতে হবে। এটাই নিয়ম, এটাই পরীক্ষা।
আর আমরা কি করি? সব নিজের বলে মনে করি আর সব কিছুতেই অধিকার ফলানোর চেষ্টা করি। তখনি বিপত্তি ঘটে। আর কষ্ট পাই। দুনিয়ার সব জিনিস হৃদয়ে ধারন করি বোকার মত। অথচ হৃদয়ে ধারন করবো শুধু আল্লাহকে আর দুনিয়ার উপকরনগুলো থাকবে হাতে। বোকার মত আল্লাহকে হাতে রাখি। ভুলে যাই যে আমরা দুনিয়াতে ক্ষণিকের অতিথি, একজন পথিক।
একজন পথিক চলার সময় সাথে তার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বহন করে। বেশী বোঝা বহন করলে তো তারই কষ্ট। অথচ আমরা দুনিয়াতে এমন ভাবে বাস করি যে, যেন সারা জীবন এখানেই থাকবো। একজন পথিক নিশ্চয় চলার পথের কোন শহরে বা দোকানে ইনভেস্ট করবে না। যেখানে সে চিরদিন থাকবে সেখানেই সে ইনভেস্ট করবে। কিন্তু আমরা পথিক হয়ে কোথায় ইনভেস্ট করছি?
“ এ পার্থিব জীবন তো অর্থহীন কতিপয় খেল তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়; নিশ্চয় আখেরাতের জীবন হচ্ছে সত্যিকারের জীবন। কতো ভালো হতো যদি তারা জানতো!!”—সূরা আনকাবুত, আয়াতঃ৬৪।
আব্বু সারা জীবন এটাই শিখাতে চেয়েছিলেন। ছোট ছিলাম, অবুঝ ছিলাম, তাই ধারন করতে পারিনি তখন। এখন বুঝি। আল্লাহ তুমি আমার আব্বু সহ সকল মুসলিম কে জান্নাতুল ফেরদৌস দান কর। আমিন।
কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা খেলাম আব্বুর মৃত্যুর পর। তার আগে বলে নেই, আমরা ভাই বোনেরা আব্বুকে ভয় পেতাম। অথচ আব্বু কোনদিন আমাদের গায়ে হাত তুলেনি বা উল্লেখযোগ্য কোন বকা দেয়নি। তারপরও ভয় পেতাম। যত আবদার, যত কথা হতো আম্মুর সাথে। গান গাওয়ার শখ ছিল, ছবি আকার শখ ছিল। কিন্তু আব্বুর জন্য সব বন্ধ ছিল। আব্বু যে আমার ভালোর জন্যই বলতো সেটা এখন বুঝি। বেশী জামা কাপড় বানানো যাবে না। সব কিছু রুটিন মাফিক হতে হবে। সব খাবার খেতে হবে এমনকি চিরতার পানিও বাদ নেই। মিষ্টি আলু অসহ্য লাগতো। বাসায় টিচার আসতো, উনাকেও জোর করে মিষ্টি আলু খাওয়াতো। সকাল বেলা ফ্যান বন্ধ করে দেওয়া হতো, যাতে ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ি। এমন অসংখ্য নিয়ম নীতি। খুব রাগ লাগতো আব্বুর উপর।তখন যদি ভোট দিতে বলা হতো, তাহলে হয়তো আম্মুকেই ভোট দিতাম। যাই হোক, আব্বু যখন মারা গেলো, তখন বুকের ভিতর কেমন খা খা করে। আব্বু মারা গিয়েছে ২০০৬ সালে। তখন থেকে আজ অবধি এমন কোন সময় নেই যে আব্বুর কথা চিন্তা করিনা। আব্বু বেচে থাকার সময় মনে হয় আব্বু কে নিয়ে এত চিন্তা করিনি। আব্বু যে কত আদর করতো সেটা বেশী অনুভব করি তার মৃত্যুর পর।
দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলাম আমার ফুফু শাশুড়ীর মৃত্যুর সময়। উনি বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা ছিলো। খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার। সন্তানেরা, আত্মীয় স্বজনরা লাইফ সাপোর্ট খুলতেও পারছিলো না আবার কন্টিনিউ করাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞান মানুষকে কত দ্বিধা দ্বন্দে ফেলে দেয়! প্রায় মাসখানেকের উপর লাইফ সাপোর্ট দেয়া অবস্থায় ছিলেন। এরপর চলে গেলেন। এমন একটা খবর যে কোনদিন আসবে, তাই সবাই প্রস্তুত ছিলো। খবর শোনার সাথে সাথেই পড়লাম ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। অর্থাৎ আমরা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছি আবার আল্লাহর কাছেই চলে যাবো।
আব্বু মারা গিয়েছিলো ফজরের সময় আর দাফন করা হয়েছিলো যোহরের সময়। আসরের নামাযের আগে কি বৃষ্টি। মনে হচ্ছিলো আমার আব্বুটা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে, একা একা কবরে শুয়ে আছে, আমরা কিছুই করতে পারছিনা। মানুষ কতোটা অসহায়। চাইলেও কিছু করতে পারবো না। আব্বুও নিজে তার টাকা পয়সা, বাড়ি ঘর, পরিবার নিয়ে কিছু করতে পারবে না। আব্বু এখন একা, একদম একা।আমার ফুফু শাশুড়ীর মৃত্যুর সময় একি রকম অবস্থা। সবাই চেষ্টা করছিলো। একটা মানুষ দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছে, চোখের সামনে দেখতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। মৃত্যুর প্রহর গুনছিলো সবাই। তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন। আমরা দেখছি তিনি ঘুমিয়ে আছেন, কিন্তু আল্লাহই জানেন ফুফু তখন কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। কত অসহায় আর একা।
এই যে আমরা বেচে থাকি আমাদের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে, আমাদের বাড়ি ঘর, সম্পত্তি, টাকা পয়সা নিয়ে, এগুলো কি আমরা সব মৃত্যুর সময় সাথে নিয়ে যেতে পারবো? মোটেও না। আমি জোর করে নিয়ে গেলেও আমার কোন লাভ নেই। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। এক কৃপণ লোক মৃত্যুর সময় তার বৌকে বললো যে, আমি মরে গেলে আমার ব্যাংকের সব টাকা কবরে রেখে দিবে। বৌ বললো, আচ্ছা দিবো। বৌ আবার স্বামীর কথার অবাধ্য হয়না। যখন লোকটি মারা গেলো বৌ কথা মতই কাজ করলো। বৌ এর প্রতিবেশী তাকে মনে করিয়ে দিলো, তুমি কি তোমার স্বামীর সব টাকা সাথে দিয়ে দিয়েছো? তখন বৌ বললো, হ্যা, সব টাকা তার চেকে লিখে দিয়েছি, এখন সে যখন ইচ্ছা সাক্ষর দিয়ে টাকাগুলো উঠিয়ে নিতে পারবে।
কি সাঙ্ঘাতিক, কি কষ্টের তাই না! আমার চারপাশে যা আছে, যা নিয়ে আমার অহংকার, আমার ব্যাংক ব্যালেন্স, আমার যশ, আমার নিজের ডিগ্রী, আমার ছেলে মেয়ের ডিগ্রী ইত্যাদি কোনটাই সাথে নিতে পারবো না। কেনো? কারণ আমার চারপাশের কোন কিছুই আমার না। এমন কি আমার শরীরটাও কিন্তু আমার না। আল্লাহ এসব আমাকে দিয়েছেন আমার চলার পথের সুবিধার জন্য। উনি দিয়ে দেখছেন আমি এসব দিয়ে কি করি। ব্যাপারটা অনেকটা কোন কিছু ধার দেওয়ার মত। আল্লাহ এসব ধার দিচ্ছেন আমাদের, আবার যখন ইচ্ছা নিয়ে নিচ্ছেন। জিনিসের মালিক যখন চাইবে, তখন তো তাকে ফেরত দিতে হবে। এটাই নিয়ম, এটাই পরীক্ষা।
আর আমরা কি করি? সব নিজের বলে মনে করি আর সব কিছুতেই অধিকার ফলানোর চেষ্টা করি। তখনি বিপত্তি ঘটে। আর কষ্ট পাই। দুনিয়ার সব জিনিস হৃদয়ে ধারন করি বোকার মত। অথচ হৃদয়ে ধারন করবো শুধু আল্লাহকে আর দুনিয়ার উপকরনগুলো থাকবে হাতে। বোকার মত আল্লাহকে হাতে রাখি। ভুলে যাই যে আমরা দুনিয়াতে ক্ষণিকের অতিথি, একজন পথিক।
একজন পথিক চলার সময় সাথে তার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বহন করে। বেশী বোঝা বহন করলে তো তারই কষ্ট। অথচ আমরা দুনিয়াতে এমন ভাবে বাস করি যে, যেন সারা জীবন এখানেই থাকবো। একজন পথিক নিশ্চয় চলার পথের কোন শহরে বা দোকানে ইনভেস্ট করবে না। যেখানে সে চিরদিন থাকবে সেখানেই সে ইনভেস্ট করবে। কিন্তু আমরা পথিক হয়ে কোথায় ইনভেস্ট করছি?
“ এ পার্থিব জীবন তো অর্থহীন কতিপয় খেল তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়; নিশ্চয় আখেরাতের জীবন হচ্ছে সত্যিকারের জীবন। কতো ভালো হতো যদি তারা জানতো!!”—সূরা আনকাবুত, আয়াতঃ৬৪।
আব্বু সারা জীবন এটাই শিখাতে চেয়েছিলেন। ছোট ছিলাম, অবুঝ ছিলাম, তাই ধারন করতে পারিনি তখন। এখন বুঝি। আল্লাহ তুমি আমার আব্বু সহ সকল মুসলিম কে জান্নাতুল ফেরদৌস দান কর। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন