শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১২

একটি সরেজমিন রোজনামচা


 যুদ্ধাপরাধী নয় বা বাংলাদেশকালে গ্রেনেড হামলা, খুন-ধর্ষণ বা অন্য কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি এমন রক্ষণশীল শরিয়াহ আইনের ধ্যানে বিভোর তরুণের সংখ্যা কিন্তু অনেক, ছাত্রশিবির বা হিযবুত তাহ্রীরের তরুণদের মুখগুলো মনে করুন। জার্মানির ধর্মান্ধ নব্যনাৎসিদের তুলনায় তাদের মাথা ও হাতের সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। অন্যদিকে জার্মানির জনসংখ্যা আট কোটি।

এসব ধর্মান্ধ তরুণের মধ্যে যারা নেহাত ধর্মব্যবসায়ীদের টাকার লোভে জিহাদ ব্যবসা প্যাকেজে যুক্ত, তাদের নিয়ে চিন্তা কম, টাকার জন্য তারা টেন্ডারবাজির জন্য দলবদল করে বা সহি কায়দায় ফেনসিডিল বিক্রি করে। কিন্তু যাদের আসলেই ব্রেন ওয়াশ হয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণ একটি জীবনদর্শন। তারা ভুল বিপ্লবের আলেয়ায় হাতে গ্যাসবোমা নিয়ে ঘুরছে, মুক্তসমাজ গুঁড়িয়ে দিয়ে শরিয়াহ আইন প্রচলন করতে। এখন বুঝতে চেষ্টা করা যাক, কিভাবে এই নিষ্পাপ তরুণদের মগজ ধোলাই হয়েছে।

ওয়াজিরিস্তানের জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো নিসর্গের বেহেশতের শুটিং স্পটের মতো। সেখানে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক আধুনিক জীবনের বিরুদ্ধে ব্রেন ওয়াশ করার সময়, আফগান বা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত বা চাকরি ছেড়ে টাকার লোভে পালিয়ে যাওয়া মার্সিনারি যুদ্ধ প্রশিক্ষকরা আলোচনার আবেগিমুহূর্তে চরস ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে চারপাশ, তরুণদের ঝরনার ধারে নিয়ে গিয়ে বলে, এই নহরের চেয়েও সুন্দর নহর পাবে জান্নাতুল ফেরদাউসে। তারপর সিডি চালিয়ে হলিউডের নায়িকা এঞ্জেলিনা জোলি বা বলিউডের বিপাশা বসুদের মতো পার্থিব হুর দেখিয়ে বলে, আরো সুন্দর তারা, জান্নাত হুরেরা।

চিন্তা করুন, যে ছেলেটি মাত্র হাজার দু-তিনটি ডলারের বিনিময়ে তার ছোট ভাইবোনের রুটির বন্দোবস্ত করেছে, যাকে তার মায়ের আঁচল থেকে ছিঁড়ে কিনে আনা হয়েছে, জীবনের নিষ্ঠুর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আবার এক নতুন জীবনের (মৃত্যুপরবর্তী) আলো-ছায়ায় বুকে বোমার সাসপেন্ডার পরে হেঁটে যায় বেহেশতের দিকে।
এ রকম সংকল্পবদ্ধ তরুণরা ইনটারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদের সময় যে ঋজুতার পরিচয় দেয়, তাতে তাক লেগে যায় তদন্ত বা জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের। তারা পার্থিব চাওয়ার উর্ধ্বে তখন বেহেশতের অপেক্ষা করছে, কারাগার থেকে আত্মা আগেই চলে গেছে বেহেশতের ইমিগ্রেশন রুমে। কারণ তাদের মগজ ধোলাই হয়েছে মস্তিষ্কের রসায়ন (কেমিক্যাল ব্যালেন্স) ওলট-পালট করে দিয়ে।

বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো গরিব বাচ্চাদের একমাত্র গন্তব্য, মাদ্রাসা একটা প্রায় নিরুপায় বিকল্প। সব মাদ্রাসাই জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যে নয় তা বলার অবকাশ নেই। কিন্তু যেহেতু মাদ্রাসাকে ঘিরে সন্দেহের কারণ তৈরি হয়েছে, এই সংশয় কাটাতে গেলে শান্তিপ্রিয় মাদ্রাসার আলেমদের সহযোগিতা লাগবে, অন্তত বিজ্ঞান, ইংরেজি আর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ আর শান্তির ইসলামের দর্শন দিয়ে জিহাদি যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক জঙ্গিভাবনা প্রতিস্থাপিত করে।

আশা করছি, শিক্ষামন্ত্রী এদিকে নজর দেবেন। ধর্মমন্ত্রী মসজিদের ইমামদের একইভাবে কাজে লাগাতে পারেন মসজিদে খুতবার সময় অন্তত দুই মিনিট ইসলামের শান্তি এবং জিহাদের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার জন্য। আমার জানা মতে, সবচেয়ে কঠিন জিহাদ হচ্ছে, নিজের মধ্যে খারাপের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে নিজের প্রতি যুদ্ধ প্রতিনিয়ত। ইসলাম যদি ধর্ম হয়, তাহলে অতীতের মুসলমান খলিফা-বাদশাহদের রাজনৈতিক জিহাদ অপব্যাখ্যার অনুসারী একবিংশের মুসলমানরা হতে পারে না। সেটা জিহাদ দেবতাদের পূজা, কাজেই শিরক।

বাংলাদেশের জিহাদ আঞ্চলিক বলে যাঁরা উড়িয়ে দেন, তাঁরা রমনার বটমূল, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, একুশে আগস্ট, ১৭ আগস্ট ভুলে গেলেন সেই বুড়ির মতো, যার বৃষ্টির দিনেই কেবল ঘরের ছাদ সারানোর কথা মনে পড়ে। একই সঙ্গে ৬৩টি জেলায় বোমা হামলার সামরিক কৌশল হাফরেড জামায়াতে মুজাহিদীন বাংলাদেশের ধর্মান্ধ বাংলাভাইয়ের মাথা থেকে এসেছে, এটা যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা আরেকবার ভেবে দেখুন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সৎ দেশপ্রেমিক যুদ্ধকৌশল বিশেষজ্ঞ আমাকে ই-মেইল করে জানালেন, (স্কুলের বন্ধুতা সূত্রে) বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ আঞ্চলিক। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সম্পর্ক হয়তো তেমন নেই। ই-মেইল পড়ে অবাক হলাম। আমরা বন্ধুরা আসলে সরল নদীর মতো মানুষ। আমাদের শত্রুরা ধর্মান্ধ কালাশি্নকভ হায়েনা মানুষ।

তবে তার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্নেল) কাছ থেকে একটা ভালো পরামর্শ এসেছে। সরকার চাইলে আনসার বাহিনীকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আধুনিক ট্রেনিং দিয়ে প্রতিষেধক অপারেশনে নামাতে পারে। এতে অপরাধীরা ভয় পাবে চুরি-ডাকাতি-খুনের আগে। জিহাদ মাথায় নিয়ে ঘুরছে যেসব অল্প বয়সী তরুণ, তাদের রিকনসিলেয়েশন বা প্রশমন ক্যাম্প খুলে জীবনে ফেরাতে হবে। এত সংখ্যক তরুণকে অন্ধকারে রেখে আমরা সুশীল সমাজ 'আলো আমার আলো' গাইলে তা ইউটোপিয়া মনে হবে। এই শেষের বাক্যটি বাতিঘর শাহরিয়ার কবিরেরও। কিছুদিন আগে করাচিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। করাচিতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার রুহুল আলম সিদ্দিকীও বাতিঘরের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলেন। বাতিঘর ইংরেজিতে বললেন, 'লার্ন টু বি ইনক্লুসিভ'। সবাইকে নিয়ে সুখে বাঁচতে শিখতে বললেন শাহরিয়ার কবির।

সিএনএনের অনৈতিক হলুদ এমবেডেড (যুদ্ধ-ট্যাংকে শায়িত) সাংবাদিকতার সঙ্গে মিলেমিশে দাড়িটুপির মেকআপ পরে যুদ্ধাপরাধী আর ধর্মব্যবসায়ী জিহাদ বিক্রেতারা যে ইসলামোফোবিয়া তৈরি করেছে বাংলাদেশে, গোটা গোলকে তা ভয়ংকর। আমরা এখন দাড়িটুপি দেখলেই জিহাদি ভাবি, বোরকা দেখলেই ভয় পাই বোমা না ফেনসিডিল বহন করছে তাই ভেবে। যাদের মা-খালা-নানিরা বোরকা পরেনি তারাও বোরকা পরছে বেহেশতে বলিউডের নায়ক জন আব্রাহাম বা হলিউডের নায়ক ব্র্যাড পিটের মতো সুদর্শন পুরুষ হুরের পুরস্কার থাকবে না জেনেও। কেন তা জানা দরকার, বোঝানো দরকার, পর্দা বাইরে নয় মানুষের মনে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ