রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর আজ

আজ সেই ২৮ অক্টোবর। সাত বছর আগে এই দিনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার দিনে পুরানা পল্টন মোড়ে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। ওইদিনের সংঘর্ষে রাজধানীতে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছয়জন এবং ছাত্রমৈত্রীর একজন কর্মী প্রাণ হারায়। আরা সারাদেশে নিহত হন অন্তত ১৩ জন।
সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ মেরে লাশের ওপর নৃত্য উল্লাস করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়েছিল তখন।
এই দিনে যে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও পাশবিক কায়দায় আওয়ামী লীগ ও তার শরীকরা নরহত্যায় মেতে উঠেছিল তা শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে হতবাক করেছে। এ নির্মম হত্যাকান্ড ও পাশবিকতায় কেঁদেছে বাংলাদেশ, কেঁদেছে বিশ্বমানবতা।
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তাণ্ডবতা। সারাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারান অন্তত ১৩ জন। আহত হন হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী।
চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিল। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। 
হঠাৎ করেই সকাল ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের নেতৃত্বে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা হাতে বিশাল মিছিল নিয়ে পল্টন মোড়ে আসে। একই সময় এডভোকেট সাহারা খাতুনের নেতৃত্বে বিজয় নগর থেকে আরেকটি মিছিল পল্টন মোড়ে আসে। এসময় তারা একযোগে ধর ধর বলে জামায়াত ও শিবিরের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। জিপিও এলাকায় অবস্থানরত ১৪ দলের শত শত কর্মী লগি-বৈঠা নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়।
28 october-2১৪ দলের কর্মীরা প্রকাশ্যে গুলী করা ছাড়াও লগি-বৈঠা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একের পর এক আঘাত হানতে থাকে নিরীহ জামায়াত ও শিবিরের কর্মীদের ওপর। মঞ্চ গুড়িয়ে দিতে এগিয়ে যেতে থাকে বায়তুল মোকাররম উত্তর সড়কের দিকে। এ হামলায় পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এইচবিএম ইকবাল ও তার বাহিনী নিয়ে যোগ দেয়।
আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের মুহুর্মুহু গুলীবর্ষণ, বোমা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর আহতদের সারি বেড়েই চলছিল। আহতদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগরী অফিসে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহতদের নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দফায় দফায় হামলা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এ সময় বারবার পুলিশকে অনুরোধ করা হলেও তারা রাস্তার পাশে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অনেক পুলিশকে সেদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর চত্বরের ভিতরে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
দুপুর পৌনে ২টার দিকে ১৪ দলের লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা হামলা জোরদার করে পল্টন মোড় থেকে সিপিবির অফিসের সামনে চলে আসে। এ সময় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কয়েকজন জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা কোন ভূমিকা পালন করেনি। একই সময় বিজয়নগর, পুরানা পল্টন মসজিদ গলিসহ আশপাশের এলাকা দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে।
লগি বৈঠার বাহিনীর হামলায় পিছু হঠতে বাধ্য হয় জামায়াত শিবির। শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করায়। একই লগি বৈঠার হামলায় মারা যায় জসিম উদ্দিনসহ ৬ জন। আহত হন সহস্রাধিক।
পুরো ঘটনায় নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিপুল সংখ্যক পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ২৮ অক্টোবরের আগ থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল, লগি-বৈঠা, কাস্তে বা অন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ও বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রকাশ্য দিবালোকে লগি, বৈঠা ও মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেদিন যে হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল
28 october-1
তা ইতিহাসে বিরল। মৃত লাশের উপর নৃত্য করার দৃশ্য দেখে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করা হয়েছে।
জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব থেকে শুরু করে সারাবিশ্বে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতার বিচার হওয়াতো দূরের কথা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলাই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঘটনার শিকার নিহতদের পরিবারের লোকজন ও ভুক্তভোগীরা। তারা বলছেন, দেশে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্যই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। তারা মনে করেন এই দেশেই কোনো একদিন এই অন্যায়ের সুবিচার হবে। সে দিনের প্রত্যাশায় আছেন তারা।
উল্লেখ্য ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে লগি, বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই আহ্বানে সাড়া দিয়েই আওয়ামীলীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সে দিনও মুক্তাঙ্গনে আওয়ামীলীগের সভাস্থল থেকে বারবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, “জামায়াত শিবিরের উপর হামলা কর” ওদের খতম কর”।
১৪ দলীয় জোট ও আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন বারবার উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলার জন্য তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীকে উৎসাহিত করছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ