সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

আওয়ামী লীগ ও রাজাকার

সারাজীবন রাজনীতি করেছি। যখন যেটাকে ন্যায় বলে মনে হয়েছে সমর্থন করেছি, অন্যায় হলে প্রতিবাদ করেছি। অনেক বুদ্ধিমানের মতো সুবিধার আশায় কখনও চুপ করে থাকিনি। যখনই কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর যত্ন নিয়ে দু’কথা লিখতে যাই, তখনই এমনসব ঘটনা সামনে এসে দাঁড়ায় যা এড়িয়ে যেতে পারি না। লিখেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হত্যার নানা ষড়যন্ত্র নিয়ে। কিন্তু মানবতার দুরবস্থা দেখে বুকটা বড় বেশি আঁতকে উঠেছে। হরতালের দিনে এক মানব সন্তানের বুকে পা দিয়ে এক পুলিশের দাঁড়িয়ে থাকা দেখে। এটা সিনেমায় কোনো জালেমের অভিনয় হলে মানাত। কিন্তু একটা সভ্য সমাজে যে দেশের স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, 
কত মা-বোন আব্রু হারিয়েছে, সেই দেশে মানবতা এভাবে বুটের নিচে দলিত হলে বড় বেশি আত্মার অবমাননা অনুভব করি। ভাবতে বড় কষ্ট হয়। স্বাধীনতায় ভূমিকা রেখে তবে কি কোনো অন্যায়, কোনো ভুল করেছি? পাকিস্তান আমলেও বিনা প্রতিবাদে মানবতাকে এভাবে কেউ পদদলিত, লাঞ্ছিত করতে পারত না। ওভাবে একটি মানুষ রাস্তায় পড়ে গেলে তার বুকের ওপর পুলিশ যদি বুট পায়ে দাঁড়ায় তাহলে মানবতা থাকে? মনুষ্যত্ব থাকে? জীবদেহে আল্লাহর বাস। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তবে কি বাংলাদেশে অধম পুলিশ স্রষ্টাকে পদপিষ্ট করছে? মন ভাঙলে যদি মসজিদ ভাঙার চাইতে ঘোরতর অপরাধ হয়, আল্লাহর গৃহে আল্লাহর বুকে এভাবে পদাঘাত একি স্রষ্টা সহ্য করবেন? মানবতা, বিশ্ববিবেক নীরব থাকবে? না, এভাবে মনুষ্যত্বকে, মানবতাকে, স্রষ্টাকে পদদলিত করা যায় না। এ ব্যাপারে অবশ্যই সোচ্চার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
একজন রাজনৈতিক মানুষ হিসেবে রাজনীতিকে লাঞ্ছিত, অপমানিত করলে বড় বেশি ব্যথা পাই। আমি জামায়াতের পাকিস্তানপ্রীতি বিরোধী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ এসব মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের বিচারে হাজার বছরের প্রয়োজন হলেও আমাদের তা করতে হবে। কিন্তু তাই বলে বর্তমান রাজনীতির কারণে কোনো জামায়াতি অহেতুক অপমানিত, লাঞ্ছিত হোক তা কারও কাম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতিদের কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করি। এখনও মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে তাদের যেকোনো ভূমিকা নিন্দার চোখে দেখি। কিন্তু সেদিন পত্রিকায় ডাণ্ডাবেড়ি পরা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলামের ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছি। কই বঙ্গবন্ধুর খুনের দুর্ধর্ষ আসামিদেরও তো ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে তোলা হয়নি? তবে কি অতি উত্সাহী পুলিশের এসব কর্মকাণ্ড মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার কোনো ষড়যন্ত্র? জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে একটি নিবন্ধিত দল। তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো নেতাকে গ্রেফতার করে হাতে হ্যান্ডকাফ, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি এসব করে কোর্টে তোলা গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো উপাদান হতে পারে না। এটা সভ্যতার কোনো স্বাক্ষর নয়। দেশের প্রচলিত আইনের অধীনে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম ও প্রচার সম্পাদক অধ্যাপক তাসনীম আলমকে গ্রেফতার করে কোর্টে হাজির করা হয়েছিল। তাদের পনের দিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে। সে যে কোনো দলেরই হোক, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এভাবে অপদস্ত করা কোনো মতেই ঠিক নয়। রাজনৈতিক নেতাদের পুলিশের রিমান্ড আবার কী? সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতারা তো সব সময়ই জনগণের রিমান্ডে থাকেন। তাই বড় দুঃখে দেশের একজন ধাত্রী হিসেবে, সাধারণ নাগরিক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদন করছি, মানবতার বুকে পা রেখে স্রষ্টাকে পদদলিত করা আপনার বিরুদ্ধে এও এক মহা ষড়যন্ত্র। জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। সেখানে সাংবাদিকদের বলেছেন, চোর চোট্টাদের সঙ্গে কি বসব? আপনি বিরোধী রাজনীতিকদের যদি চোর চোট্টা বলেন, রাজনীতি তো তাদের সঙ্গেই আপনাকে করতে হবে। বিরোধী দলের মাননীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এমনিতেই তার কথাবার্তা ভালো না। সাধারণ লোকজনও ওধরনের অসংলগ্ন কথাবার্তা খুব একটা পছন্দ করে না। আপনার কথার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও আপনাকে ডাকাতের মা বলেছেন। পুরুষ হয়ে জন্মেছিলাম। আল্লাহ না করলে তো আর এই বয়সে মহিলা হতে পারব না। জীবন শুরু করেছি রাজনীতি দিয়ে। রাজনীতি কলুষিত হলে, রাজনীতির মর্যাদাহানি হলে বড় বেশি কষ্ট হয়, ভীষণ দুঃখ পাই। এই বয়সে রাজনীতির বাইরে অন্য কোন নীতিতে যাব সে সুযোগ কোথায়? তাই বড় পদে আছেন, একটু বড়-র মতো আচরণ করুন, রাজনীতিটাকে মহিমান্বিত করুন। যাওয়ার কালে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
’৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে হঠাত্ করে শবনম মুশতারীর মা আমাদের টাঙ্গাইলের আকুরটাকুর পাড়ার হানাদারদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া ভাঙাচোরা বাড়িতে হাজির হন। তিনি খুবই জড়সড় ও দ্বিধা নিয়ে আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন। কেবলই দেশ স্বাধীন হয়েছে। চিত্রটাই আলাদা। এক সময়ের অচেনা কাদের সিদ্দিকীর তখন সারাদেশ জোড়া পরিচিত নাম। মার কাছে বসে থাকা তালিম চাচীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। অতবড় যুদ্ধজয়ী কাদের সিদ্দিকী তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে পারে, পাকিস্তানের দালাল আইনে অভিযুক্ত স্বামী জেলে থাকায় ভুলেই গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে একটু সুস্থ হয়ে বললেন, ‘হুজুর মওলানা ভাসানীর কাছে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই তোমার কাছে এলাম।’ তারা তিন-চারজন ছিলেন, শবনম মুশতারী ছিল কিনা বলতে পারব না। পাকিস্তান বেতারে গান গাওয়ায় তখন শবনম মুশতারীরা সবাই ব্ল্যাকলিস্টেড। দেশের বিখ্যাত পল্লীগীতি গায়ক আবদুল আলীমও ব্ল্যাকলিস্টেড। সারা বছর পাকিস্তানিদের বেতন খেয়ে ১৪ ডিসেম্বর নিহত হয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী আর বেঁচে থাকলে কোলাবরেটর। আমি জানতাম না কোলাবরেটর অ্যাক্টে চাচা তালিম হোসেন জেলে বন্দি। পায়ে হাত দিয়ে সালাম টালাম করায় চাচী বেশ সাহস পেয়েছিলেন। এক সময় তিনি বললেন, ‘তোমার চাচা পাঠিয়েছেন হুজুরকে আর তোমাকে বলতে।’ সঙ্গে একটি কাগজ পাঠিয়েছেন। পাকিস্তানের পক্ষে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি। তাতে একত্রিশ জনের স্বাক্ষর। এক নম্বরে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী আর একত্রিশ নম্বরে কবি তালিম হোসেন। মাঝে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ যেমন ছিলেন তেমনি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নামও ছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাগ্যবান কবীর চৌধুরী বাংলা একাডেমীর ডিজি ছিলেন। আসলে একেই বলে ভাগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে কতজন স্বাধীনতা পুরস্কার পেল? আর যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে, বঙ্গবন্ধুর কাছে লক্ষাধিক অস্ত্র জমা দিয়ে আমি এখন পাই রাজাকারের পুরস্কার! চাচী বললেন, ‘বাবা, আমাদের সাহস ছিল না আমরা দেশ ত্যাগ করতে পারি নাই। স্বাধীনতার জন্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারি নাই। এজন্য যা শাস্তি হওয়ার হবে তাতে কোনো ক্ষোভ দুঃখ নেই। তোমার চাচা শুধু জানতে চেয়েছে একই কাজ করে যারা মরে গেছে তারা শহীদ হলো, আর পাকিস্তানে মাত্র দু’দিন বেশি বাঁচার কারণে তোমার চাচা দালাল হলো কি করে? এটা বুঝতে পারছেন না বলে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী চাকরিরত যারা ছিলেন তারা সবাই নভেম্বর মাসের বেতন নিয়েছে, তোমার চাচাও নিয়েছে। পাকিস্তানিদের পক্ষে বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি দেখে, একই কাজ করে কেউ শহীদ, কেউ কোলাবরেটর হয় কি করে?’ আমি তো থ’। মা চাচী আম্মার জন্য খাবার ব্যবস্থা করছিলেন। এ সময় হুজুর মওলানা ভাসানীর দূত এসেছিল। চাচীকে নিয়েই গিয়েছিলাম সন্তোষে। গিয়ে শুনলাম তিনি কবি তালিম হোসেনের কথা বলতেই ডেকেছেন। কারণ কবি তালিম হোসেন তার খুবই অনুরক্ত ভক্ত।
হুজুর আমাকে পেয়ে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন। আক্রমণাত্মক সুরে বললেন, ‘কাদরী, এসব কি? স্বাধীন হয়েই সারিনি এখনই এত জুলুম? তালিম হোসেন কত বড় কবি, কত কত লেখা তার, তাকে তোমরা দালাল বলে জেল দিয়েছো! আর যারা মরেছে তাদের শহীদ বলেছো? মুক্তিযুদ্ধে কোনো রাজাকার দালাল মরে নাই? হানাদার মরে নাই? এরকম হলে পরিণতি ভালো হবে না।’ অনেকক্ষণ হুজুরের বকাঝকা শুনে কোনোভাবে তার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলাম। তখনও আমার ঢাকায় থাকার স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। ঢাকায় এলে প্রথম প্রথম উঠতাম বেইলী রোডের সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানে এলে যে সার্কিট হাউসে উঠতেন সেই সার্কিট হাউসে এবং তার ব্যবহৃত কক্ষে স্থান পেয়ে নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হতো। মনে হতো স্বাধীনতা কত মহান। ২২ ডিসেম্বর ’৭১ থেকে বহুদিন পর্যন্ত সেখানে থেকেছি। পরবর্তী সময়ে বর্তমান গণভবন বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। ওটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল স্টেট গেস্ট হাউস। ওখানেও কাটিয়েছি অনেক দিন। একদিন সেখান থেকে ঢাকার জেলে গেলাম। তখন এখনকার মতো মোবাইলের যুগ ছিল না। ফোনের সংযোগও সব খানে তেমন একটা ছিল না। কালেভদ্রে ফোন পাওয়া যেত। তাই জেলখানায় আগেই লোক পাঠিয়ে ছিলাম। জেলে দেখা-সাক্ষাতের নিয়মকানুন অনেক আগে থেকেই আমাদের রপ্ত ছিল। সেই ’৬২-’৬৩ থেকে জেলখানা আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি। চুরি চামারি করে আমার পরিবারের কেউ কখনও জেলে যায়নি। সব সময় রাজনৈতিক অভিযোগে আমাদের জেলে যেতে হয়েছে। ’৬৮-তে বড় ভাইকে দেখতে ঢাকা জেলে বহুবার গেছি। সে সময় জনাব আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দুম্বা রেজা খুব সম্ভবত কাজী ফিরোজ রশীদরাও ছিলেন। জনাব আবদুর রাজ্জাক এখন লন্ডনে মৃত্যুশয্যায়। তার লিভার বদল করা দরকার। রাজনীতি কত নির্মম, লন্ডন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কত বছর জননেতা আবদুর রাজ্জাকের পোটলা বইছে, সে এত দিনে একবারও আবদুুর রাজ্জাককে দেখতে যায়নি। আমেরিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গেলেন, সাহায্য করলেন। ফেরার পথে জননেতা আবদুর রাজ্জাককে দেখে আসলে কি ক্ষতি হতো? হয়ত এটাই তার শেষ দেখা হতে পারত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ড. কামাল হোসেন এবং আবদুর রাজ্জাকই কিন্তু দলের ঐক্য ধরে রাখতে তাকে সভানেত্রী বানিয়েছিলেন। ’৭১-এর যুদ্ধের সময় আমার চরম বিরোধীরাও কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনীতে উপযুক্ত স্থান পেয়েছে। অর্থমন্ত্রী, পূর্তমন্ত্রী হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু কেউ জননেতা আবদুর রাজ্জাককে দেখতে যাননি এবং কোনো সাহায্য করেননি। 
বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী জেল থেকে বাংলায় অনার্স পাস করেছেন। অনার্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন ঢাকা থেকে। টাঙ্গাইলের গিয়াস সিদ্দিকী তখন লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতা করতেন। অনার্সের জন্য যত নোট লাগত তার বেশিই তিনি দিয়েছেন। আর জেলখানায় লেখাপড়ায় যে সহযোগিতা দরকার সেই শিক্ষকের কাজটি করেছেন শেখ ফজলুল হক মনি ভাই। আগে ব্রিলিয়ান্টরা রাজনীতি করত। গুণ্ডা তখনও ছিল, তারা নেতৃত্ব দিত না। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল ব্রিলিয়ান্টদের হাতে। মাসলম্যানেরা তাদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বে সদাসর্বদা চলত। নিজেদের উহ আহ টু টা করার কোনো উপায় ছিল না। আমার এক খুবই প্রিয় বন্ধু, একেবারে ছোটখাটো, দেহ-গতরে প্রায় আমার অর্ধেক। কুমিল্লার দাউদকান্দির দাশপাড়ার নজরুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে গ্রেফতার হয়ে চরম নির্যাতনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারা গেছেন। সেই নজরুল ’৬৯-এ যখন ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি তখন ঢাকা কলেজের সেন্টু দেখতে দানবের মতো নজরুলের পিছে পিছে ঘুরত, তার আঙ্গুলের ইশারায় চলত, আমার কাছে বড় অবাক লাগত। আর দূরে যাব কেন। আমিও তো নজরুলের চাইতে দেহ-গতরে প্রায় দেড়গুণ ছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে ওর কোনো কথাই ফেলতাম না। সোজা কথায় নজরুল আমাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব করত। ও এক সময় টাঙ্গাইল বিবেকানন্দ স্কুলে সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় আমার বন্ধু হয়। পাড়ায় আমি ছিলাম সবার হিরো। ছোটখাটো ফুলের মতো সুন্দর নজরুল আমার পিছে পিছে ঘুরত। খেলার মাঠে আমাকে ঘেঁষে বসে থাকত। দূরে থাকলে ডাক দিলে চিলের মতো উড়ে আসত। সেই নজরুল যখন ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আমি তখন টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের এক খণ্ডাংশের সাধারণ সম্পাদক। তখন দেহের স্থান ছিল না, স্থান ছিল মেধা আর মননের। তাই পূর্ব পরিচিত জেলখানার রীতিনীতি নিয়মকানুন জানা থাকায় ঢাকা জেলে কোনো অসুবিধা হয়নি। তখন টাঙ্গাইলের জননেতা আবদুল মান্নান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কে যেন স্বরাষ্ট্র সচিব। তবে জনাব আবদুল খালেক ছিলেন পুলিশের আইজি। জেলখানায় পুলিশের কোনো মায় মাতব্বরি নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর জেল কর্তৃপক্ষ। সে সময় আইজি প্রিজন কে ছিলেন ৪০ বছর পরে আজ তা মনে নেই। যেতেই ৩০-৪০ জন কারারক্ষী দিয়ে গেটে গার্ড অব অনার দিলেন, ফুলের তোড়াও দিলেন। সিংহ দরজা খুলে সুপারের কক্ষে নিয়ে বসালেন। এক দুই মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানের কোলাবরেটর অভিযোগে অভিযুক্ত কবি তালিম হোসেনকে নিয়ে আসা হলো। চাচাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা দেখে তিনি যেমন বেকুব হলেন তেমনি জেলের বড় বড় কর্মকর্তারা অবাক হলেন। যার নামে সারাদেশ কাঁপে, দালাল আইনে গ্রেফতার একজন আসামিকে জেলের মধ্যে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে—এ আবার কেমন মানুষ! বসতে বসতেই চা-নাস্তা এলো। কেন জানি না স্বাধীনতার পর আমার পেটে খুব কষ্ট ছিল। হয়তো এমন হতে পারে যুদ্ধের সময় অমানুষিক পরিশ্রম করেছি। স্বাধীনতার পর সে তুলনায় কিছুটা অলস জীবন। সে জন্য অমন হতে পারে। তাই শুধু চা খেয়ে চাচার সঙ্গে কথা সারলাম। জনাব তালিম হোসেন সত্যিই একজন জ্ঞানী-গুণী বিদগ্ধ মানুষ। তাকে চিনি অনেকদিন ধরে। কিন্তু অমন গভীরভাবে তার কথা শুনিনি কখনও। ঘণ্টাখানেক তার কাছে ছিলাম। তিনি একবারও জেলে থাকার জন্য কোনো অনুযোগ অভিযোগ করলেন না। তার স্ত্রীর মতো শুধু বললেন, ‘বাবা দেশের স্বাধীনতা কারও চাইতে কম চাইনি। কিন্তু আমরা নির্বিবাদী মানুষ। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অনেকের মতো ঘর ছাড়তে পারিনি। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ গড়তে পারিনি। আগেও যেমন নিজের জগত্ নিয়ে পড়ে থেকেছি, যুদ্ধের সময়ও তাই ছিলাম। এতে যা অপরাধ হওয়ার হয়েছে। তার জন্য সবার যে শাস্তি হবে আমি সে শাস্তি মাথা পেতে নেব। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে কষ্ট হচ্ছে আমরা একসঙ্গে যারা পাকিস্তানের গোলামি করলাম, বেতন নিলাম তাদের কেউ কেউ মরে গিয়ে শহীদ হলো আমরা বেঁচে থেকে দালাল হলাম। এতে কেমন যেন স্বস্তি পাচ্ছি না। বাবা, অপরাধ যা কিছু করার আমরা একসঙ্গে করেছি। কেউ অতিরিক্ত কিছু করিনি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চাইতে পাকিস্তান আমলে আমি মাত্র এক বা দু’দিন বেশি বেঁচেছি, চাকরি করেছি। শহীদরা ১৩ তারিখ রাতে মারা গেছে। ১৪ আর ১৫ বলতে গেলে এই দু’দিন তো পাকিস্তানিদের দৌড়াদৌড়িই সার। ওই এক-দেড় দিন আমাদের কারোরই কিছু করার ছিল না। এখন মৃত্যু ভাগ্যে জোটে নাই তার জন্য কিইবা করতে পারি? যারা মরে গেছেন তাদের চাইতে যারা বেঁচে আছে তাদের সম্মান-অসম্মানের ব্যাপারটা বড় নয় কি? তাই তোমার চাচীকে হুজুর এবং তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম। পারলে বঙ্গবন্ধুকে ওই বিবৃতিটা দেখিয়ে একটু জিজ্ঞেস কর। ওতে ৩১ জনের স্বাক্ষর আছে। এক নম্বরে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আমার নম্বর একত্রিশ-এ।’ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ