শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৩

হজবঞ্চিত দু’সহস্রাধিক

হজে যাচ্ছেন বলে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন। আত্মীয়স্বজন জানেন তারা হজে যাবেন। টিকিট-ভিসার অনিশ্চয়তার পরও ঢাকায় এসে উঠেছেন হোটেলে। প্রতিদিন যাচ্ছিলেন হজক্যাম্পে। মনের ভেতরে ইচ্ছা ছিল, শেষ চেষ্টার পরও যদি যাওয়া যায় সৌদি আরবে। তাহলে নসিব হবে মহানবীর রওজা মোবারক জিয়ারত। হজ আদায়ের স্বপ্নও পূরণ করতে পারবেন। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় ছিল না। সব প্রস্তুতির পরও অনেকে যেতে পারেননি। তারা চোখের পানি ফেলেছেন। গতকাল শেষ ফ্লাইট ছিল হজের। সেই ফ্লাইট আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আশাহত হন। ভেঙে পড়েন কান্নায়। হজক্যাম্পে বসে কাঁদতে দেখা গেছে অনেককে। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এসে মানববন্ধন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। হজ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-র হিসাবে হজবঞ্চিত যাত্রীর সংখ্যা ২ শতাধিক। এর মধ্যে একটি ট্রাভেলসের ১৮২ জন। তবে সব মিলিয়ে এই সংখ্যা দু’হাজারেরও বেশি। সরকারি হিসাবে হজে যেতে পারেননি ২,১১৫ যাত্রী। সরকার ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী এবছর ৯০,০০২ যাত্রী হজ পালনে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ নির্ধারিত হজ ফ্লাইট পর্যন্ত সেখানে পৌঁছেছেন ৮৭,৮৮৭ জন। বাকিরা এবছর আর যেতেও পারবেন না। এদের বেশির ভাগ এজেন্সির প্রতারণার শিকার। তাদের মধ্যে সাউথ এশিয়ান ট্রাভেলসের শতাধিক যাত্রী, আল মুকাররম হজ গ্রুপের ১৮২ জন, রফিক ট্রাভেলসের ৬০ জন, শুভ্রা ট্রাভেলসের ২ জন এবং সন্দ্বীপ ট্রাভেলসের কয়েকজন যেতে পারেননি বলে যাত্রীরা জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের গোলাম ফারুক বলেন, এক সপ্তাহ আগে আমাদের ঢাকায় আনা হয়েছে। বলা হয়েছিল, হজে পাঠানো হবে। আমরা হজ ক্যাম্পেও যাই। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করেনি ট্রাভেল এজেন্সি। তারা আজকাল করে সপ্তাহ পার করেছে। এখন তো আর খোদার ঘরে যেতেই পারবো না।
হাব মহাসচিব এম আবদুল্লাহ বলেন, যে দু’শতাধিক যাত্রী যেতে পারেননি, তাদের জন্য আমরা শেষ পর্যন্তও চেষ্টা করেছি। তারা এজেন্সি ও গ্রুপ লিডারের প্রতারণার শিকার। এদের খুঁজে না পাওয়ায় হাব তাদের জন্য কিছু করতে পারেনি। হাব জানায়, মেরেডিয়ান ট্রাভেলস নামের একটি এজেন্সিতে ১৬০ জনের মতো যাত্রী আটকা পড়েছিলেন। হাব উদ্যোগ নিয়ে তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ওই এজেন্সি তাদের সদস্য না হওয়ায় তারা কিছু করতে পারেনি।
এদিকে যখন এই অবস্থা, তখন হজক্যাম্পের কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের চিত্র অন্যরকম। যাত্রীরা হজে যেতে না পেরে হজক্যাম্পে কান্নাকাটি, কর্মকর্তাদের  খোঁজে দৌড়াদৌড়ি আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ঠিক তখন হজ অফিসার মো. বজলুল হক বিশ্বাস ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উড়াল দিয়েছেন সৌদি আরবে। যাত্রীদের সমস্যায় ফেলে হজ পালনের জন্য বুধবার সৌদি আরবে গেছেন হজ অফিসার। সমস্যার সমাধান না করে তার এভাবে চলে যাওয়ায় অনেক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি আশকোনা হজ অফিসে বুধবার থেকে কোন কর্মকর্তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
গতকাল ভোর ৪টা ২০ মিনিটে হজের শেষ ফ্লাইট ৫৮০ যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ে। আর কোন ফ্লাইট নেই। তবে আজ শুক্রবার পর্যন্ত নিয়মিত ফ্লাইটে কিছু সংখ্যক ভিআইপি ও বিশেষ ব্যক্তিরা যাবেন। কিন্তু যারা আটকা পড়েছেন তারা এবছর আর যেতে পারবেন না। হাব ও কয়েকটি এজেন্সির ব্যক্তিরা দাবি করেন, গত বছর কোন যাত্রী আটকা পড়েনি। চলতি বছর সরকার কর্তৃক গণহারে নতুন লাইসেন্স দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক এজেন্সির কোন নাম-ঠিকানাও নেই। হাবেরও সদস্য না। কিন্তু তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হজযাত্রী সংগ্রহ করে। শেষ পর্যন্ত যারা যেতে পারেননি তারা তাদের মাধ্যমেই হজ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন। এর বাইরে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স জটিলতা, বয়স ও মেডিকেল চেক আপে আটকে পড়েন অনেকে। হাবের প্রাক্তন মহাসচিব ও হজ বিশেষজ্ঞ এম. রশিদ শাহ সম্রাট বলেন, যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা ছাড়া আরও অনেকে চেষ্টা করে এবং আগ্রহ দেখিয়েও এবার নানা কারণে যেতে পারেননি। সরকার ও হজ ক্যাম্পের বদান্যতার অভাবে অনেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর মূল কারণ বাছ-বিচার না করে যারে-তারে হজের লাইসেন্স দেয়া। অব্যবস্থাপনা ও যাত্রী হয়রানি- এর একটি অন্যতম কারণ। তিনি জানান, হজে যাবেন এই আশায় অনেকে শেষ দিনেও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। থেকেছেন হোটেলে। এরা এখন বাড়ি ফিরবেন কিভাবে? স্বজনদের কাছে মুখ দেখাবেন কিভাবে; তা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন।
হাব বলেছে, নাম-ঠিকানাহীন এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে অনেকে কম টাকায় হজে যেতে চেয়েছিলেন। যেখানে ২ লাখের বেশি প্যাকেজ সেখানে কেউ কেউ দেড় লাখ ও ১,৮০০০ টাকায়ও এজেন্সির কাছে বুকিং দিয়েছিলেন। তারাই শেষ পর্যন্ত প্রতারিত হয়েছেন। অনেক এজেন্সি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। এর সংখ্যাও কম নয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এরকমই একটি এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়ে রাস্তায় নামেন ১৮২ যাত্রী। ময়মনসিংহের আল মুকাররম হজ গ্রুপ নামের ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে তারা প্রতারণার অভিযোগ এনে দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। তাদের অভিযোগ, হজের খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় টাকা ওই ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়েছেন তারা। ইতিমধ্যে পাসপোর্ট ও ভিসা পেয়েছেন। কিন্তু ট্রাভেল এজেন্সির মালিক তাদের বিমান টিকিট বুঝিয়ে দেননি। এমনকি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করেনি। এক সপ্তাহ ধরে টিকিটের জন্য তারা হজ ক্যাম্পে অবস্থান করেন। মানববন্ধনে হজযাত্রী হামিদা আক্তার জানান, বুধবার পল্টনসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সি ও আশকোনা হজ অফিসে গিয়ে কান্নাকাটি ও বিক্ষোভ করেও কোন কাজ হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের কথা শোনার মতোও কোন কর্মকর্তা হজ অফিসে নেই। অসহায় হয়ে তারা হজক্যাম্পে চোখের পানি ফেলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ