সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

আলোর মিছিল

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে: অবহেলিত একটি গ্রামের নাম বাকসাই। ধনু নদী সংলগ্ন সাতটি পাড়া নিয়ে গঠিত। লোকসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। জীবিকা নির্বাহ করে মাছ ধরে। এ গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। গ্রামের চারদিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরেও নেই কোন প্রতিষ্ঠান। বলা যায় বিচ্ছিন্ন একটি অবহেলিত জনপদ এটি। শিশুদের কাজ খাওয়া, খেলা আর ঘুমানো। কিন্তু সমপ্রতি এই গ্রামের শিশুদের ঘুম খেলা কেড়ে নিয়েছে শিক্ষাতরী। এখানেই শিশুরা শুরু করেছে জীবনের প্রথম পাঠ। বাকসাই এখন নবদিগন্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাকসাই গ্রামের ৪ কিলোমিটার পূর্বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বেতেগা গ্রামে আরেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শুষ্ক মওসুমে এ গ্রামের কিছু শিশু এ দু’টি বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করলেও বর্ষা মওসুমে যায় না। উত্তাল হাওর পাড়ি দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিভাবকরা ভরসা না পাওয়ায় বর্ষার সময়টা তাদের বাড়িতেই কাটাতে হয়। ফলে গ্রামের শিশুরা বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ঝরে পড়াদের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় বাকসাই গ্রামসহ কিশোরগঞ্জের দুর্গম হাওর এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ২০১২ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাসমান পাঠশালা ‘শিক্ষাতরী’র কার্যক্রম শুরু করে। একই সঙ্গে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও করিমগঞ্জ এই পাঁচটি উপজেলার দুর্গম ও বিদ্যালয়বিহীন আরও ১১টি গ্রামে প্রাথমিকভাবে ১২টি শিক্ষাতরী চালু হয়। ১২টি শিক্ষাতরীর কার্যক্রমে অভাবনীয় সাড়া পাওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে সেখানে যুক্ত করা হয়েছে আরও ২৬টি শিক্ষাতরী। বর্তমানে ৩৮টি শিক্ষাতরীর মাধ্যমে ১৪টি বিদ্যালয়ে ডাবল শিফটসহ মোট ৫২টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে করিমগঞ্জে ৪টি, ইটনায় ১২টি, মিঠামইনে ১০টি, নিকলীতে ১২টি ও অষ্টগ্রামে ১৪টি ভাসমান শিক্ষাতরী স্কুল চালু রয়েছে। প্রত্যেকটি শিক্ষাতরীর জন্য রয়েছে একটি করে বিশাল আয়তনের রঙিন ট্রলার। ট্রলারের ভেতর মাদুর বিছিয়ে তৈরি করা হয় শিক্ষাতরীর শ্রেণীকক্ষ। ব্ল্যাকবোর্ড, নানা ধরনের চার্ট এবং রকমারি শিক্ষা উপকরণ দিয়ে শ্রেণীকক্ষটিকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ব্র্যাকের করিমগঞ্জের সিনিয়র শাখা ব্যবস্থাপক ডেজি খাতুন জানান, শুকনো মওসুমে সুবিধা অনুযায়ী শিক্ষাতরীর স্থান পরিবর্তন হতে পারে। বর্ষাকালে দূরের পাড়া বা হাটির বালক-বালিকাদের বিদ্যালয়ে আনার জন্য ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকারও ব্যবস্থা রয়েছে। বাকসাই শিক্ষাতরীর শিক্ষক গীতা রানী দাস জানান, সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ক্লাস চলে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাতরীতে এসে আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। বাকসাই গ্রামের বাসিন্দা ও ধনপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রামানন্দ দাস বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ একটি স্কুলের জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছি। কিন্তু স্কুল পাইনি। যে কারণে বাকসাই গ্রামের কমপক্ষে শতাধিক স্কুল গমনোপযোগী ছেলেমেয়ে সব সময় প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে রয়ে যায়। এ অবস্থায় তাদের গ্রামে ব্র্যাকের ভাসমান পাঠশালা ‘শিক্ষাতরী’র কার্যক্রম তাদেরকে আশাবাদী করে তুলেছে। ব্র্যাকের কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের শিক্ষা কর্মসূচির সিনিয়র এলাকা ব্যবস্থাপক মো. কাওছার জানান, কাতারের রানীর ‘ওয়াইজ’ নামের সংগঠন এই প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা করে থাকে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ব্র্যাকের নিজস্ব কারিকুলাম  এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা সরকারি পাঠ্যক্রম অনুসরণ করবে। তিনি জানান, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মূল স্রোতধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সহায়তা করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। কিশোরগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষাতরী’র পাঠদান কার্যক্রম পরিদর্শন করে মনে হয়েছে, এটি হাওর শিশুদের জন্য নতুন দিনের এক স্বপ্নের সূচনা। প্রকৃতির সঙ্গে সর্বদা সংগ্রাম করে যাওয়া হাওরপাড়ের মানুষজন এমনিতে সুবিধাবঞ্চিত। শিক্ষাতরী’র মাধ্যমে সেসব এলাকার শিশুরা শিক্ষার সুযোগ কাজে লাগিয়ে একদিন অবশ্যই দেশের সম্পদে পরিণত হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ