সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

আতঙ্ক- রেলকর্মীর পর এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী খুন

বেসামাল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। নৃশংস খুন, ডাকাতি, অর্থলুট ও সশস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। খুন, ডাকাতি   
, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। রাজধানীতে ছিনতাই ও ডাকাতি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। অহরহ হচ্ছে পথে-ঘাটে ও বাসাবাড়িতে চুরি। যদিও চলতি মাসের ২রা অক্টোবর পবিত্র ঈদুল আজহা ও শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তার ঘোষণা দিয়েছিলেন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহম্মেদ। বলেছিলেন, রাজধানীতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভবিষ্যতে যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই ঘোষণার চারদিনের মাথায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মতো সুরক্ষিত কার্যালয়ে টিকিট কাউন্টারের কর্মকর্তা ইসরাফিল হোসেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ১৭ লাখ টাকা লুটে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। রোমহর্ষক এ খুনের ঘটনায় খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে শনিবার রাতে মোহাম্মদপুর থানাধীন নূরজাহান রোডে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী এনামুল হক (২৪)-কে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এতে নগরবাসীর মনে নানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সামনে ঈদ ও পূজায় নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত অনেকে। তবে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু এ বিষয়ে বলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দু’একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও জড়িতদের  গ্রেপ্তার করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, পবিত্র ঈদ ও পূজা উদযাপন  নির্বিঘ্ন করতে রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে- যাতে রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় কর্মসূচির নামে কোন মহল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। সূত্রমতে, সমপ্রতি ঘটে যাওয়া অন্তত ডজনখানেক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি র‌্যাব, ডিবি ও থানা পুলিশ। বিশেষ করে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর উত্তর যাত্রাবাড়ীর নিজ বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের শিকার ‘ও’ লেভেল পাস করা বখতিয়ার (২০)-এর আসামিদের ধরতে পারেনি পুলিশ। ডাকাতির ঘটনা বললেও এই খুনিরা কারা- তা ২৪ দিনেও শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা।
২৮শে সেপ্টেম্বর রমনা থানাধীন মগবাজার রেলক্রসিং সংলগ্ন এসকে টাওয়ারের সামনে ইউনিক গ্রুপের সাবেক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ মাসুদ মুন্না (৪০)-কে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এর আগে ২৯শে সেপ্টেম্বর রাতে মগবাজারে সাব্বির আহমেদ সাকের (৪৫) নামে এক ঠিকাদারকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ডেসা’র ১ কোটি টাকার একটি কাজের দরপত্র নিয়ে প্রতিপক্ষরা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এর আগের দিন ২৮শে সেপ্টেম্বর দুপুরে রূপনগর থানাধীন ট ব্লকের ৮৭/৮৮ নম্বর বাড়ির নিজ ড্রয়িং রুমে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী জাফরুল হককে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, এটি আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীদের কাজ। ওই এলাকার একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নির্দেশনা মোতাবেক চারজনের কিলার গ্রুপ জাফরুল হককে হত্যা করে পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচন, ঈদ ও পূজাকে সামনে রেখে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে অপরাধীরা। এরই ধারাবাহিকতায় খুন ও গোলাগুলির ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারের শেষ সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঢাকার বাইরে বদলি হয়েছেন বেশির ভাগ পুলিশ কর্মকর্তা। অনেকেই নিজের ঘর গোছানোয় ব্যস্ত। এর বাইরে যারা আছেন, তাদের বেশির ভাগ কর্মকর্তা হরতাল ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় অস্থির হয়ে উঠছে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ড। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমপ্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ধরন এবং অপরাধ সংগঠনের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে বোঝা যাচ্ছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই শুরু হয়েছে। এছাড়া, বিচ্ছিন্ন অপরাধী গ্রুপগুলো তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে গুলি করে ও কুপিয়ে মানুষ হত্যা করছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠা পেশাদার অপরাধীদের সামলাতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল অপরাধীরা। গত আগস্ট মাসে  বাসায় ঢুকে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিমকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেপ্তার করতে পারেনি জড়িত কাউকে। ৩১শে আগস্ট রাজধানীর পল্লবী থানাধীন ৯২ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম ইউনিটের যুবলীগ সভাপতি শাহ আলী ওরফে রকিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ঈদুল ফিতরের আগে রাজধানীর গুলশানে ফিল্মি স্টাইলে হত্যা করা হয় যুবলীগ নেতা মিল্কিকে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত তারেক খোদ র‌্যাবের হেফাজতেই হত্যার শিকার হন। যদিও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী যুবলীগের দুই নেতা এখন পর্যন্ত লাপাত্তা। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশেই এখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। বিশেষ করে ক্ষুদ্রাস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পুলিশের তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন অন্তত এক ডজন মানুষ খুন হচ্ছে। সেই হিসাবে গত অক্টোবর ও চলতি মাসে দেশজুড়ে তিন শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, অনেক হত্যাকাণ্ডের রহস্যও উদ্ঘাটিত হচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের ধরনও বদলে গেছে। রাজধানীর মাতুয়াইলে ময়লার ভাগাড়ে পাওয়া গেছে অন্ততপক্ষে চারটি লাশের খণ্ডিত অংশ। এর আগে ১৬ই আগস্ট রাজধানীর ওয়ারীতে ক্ষুদ্রাস্ত্রের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সিয়াম (১৫)। একই দিন সাভার ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা শারীরিক প্রতিবন্ধী শামীম হোসেন ফকিরকে পিটিয়ে হত্যা করে। সূত্র জানায়, সরকারের শেষ সময়ে আত্মগোপনে থাকা পেশাদার সন্ত্রাসীরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে বিরোধী দলের সংশ্লিষ্ট অপরাধীরাও স্ব-স্ব এলাকায় আধিপত্য ফিরে পেতে চেষ্টা করছে। এ কারণে প্রতিপক্ষদের টার্গেট করে তাদের হত্যা করছে। এছাড়া, নিজ দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেয়া, নির্বাচনী প্রতিপক্ষসহ জায়গা-জমি দখল নিয়ে বিরোধ প্রভৃতি কারণেও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, চলতি বছরের ৯ মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দুই সহস্রাধিক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ২৮২, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫১, মার্চ মাসে ৩১৭, এপ্রিলে ৩০২, মে মাসে ২৭৬, জুন মাসে ২৭২, জুলাই মাসে ৩১২, আগস্ট মাসে ৩২২ ও সেপ্টেম্বর মাসে ৩২৫ জন নিহত হয়েছেন।
তদন্তে অগ্রগতি দাবি, স্টেশনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বুকিং কাউন্টারের সহকারী ইসরাফিল হোসেন (৬০) খুনের ঘটনায় তদন্তে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আগামী দু’একদিনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটন ও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তদন্তে সহযোগিতা করছেন। এদিকে ইসরাফিল হোসেনের খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করা, বুকিং কাউন্টারের নিরাপত্তা জোরদারসহ নানা দাবিতে গতকাল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন বুকিং কাউন্টারের সহকারীরা। এসময় তারা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমালোচনা করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। হত্যাকাণ্ড ও টাকা লুটের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা গতকাল স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের বুকিং সহকারী, নিহত ইসরাফিল হোসেনের সহকর্মী ও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে হত্যাকাণ্ডে নিহতের পরিচিত কেউ জড়িত, এটা তারা নিশ্চিত হতে পেরেছেন। এমনকি রেলওয়ের নিজস্ব লোকজনদের দ্বারা এ হত্যাকাণ্ড ও টাকা লুটের ঘটনায় ইন্ধন রয়েছে তদন্তে তা-ও উদঘাটিত হয়েছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। এবিষয়ে কমলাপুর জিআরপি (গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ) থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবদুল মজিদ মানবজমিনকে বলেন, ঘটনার পর থেকেই আমরা বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের হিসেবে দেখছি। এরকম একটি সুরক্ষিত কক্ষে পরিচিত কারও দিকনির্দেশনা ছাড়া দুর্বৃত্তরা কিভাবে প্রবেশ করলো, অপরাধ সংঘটিত করে বেরিয়েও গেল কিভাবে তা রহস্যজনক।
ঈদুল আজহা ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরুর পর থেকেই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। বুকিং কাউন্টারের আশেপাশে ১৬টি সিসি (ক্লোজ সার্কিট) ক্যামেরা। তবে কাউন্টারের প্রবেশমুখে ও ভেতরে কোন সিসি ক্যামেরা নেই। নেই নিরাপত্তা বাহিনীর কোন সদস্য। কাউন্টারের পাশেই র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৩ অস্থায়ী ক্যাম্প। প্রতিদিনের মতো ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিউটি ছিল নিয়মিত। এছাড়া, রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)’র বেশ কিছু সদস্য প্রতিদিন তিন শিফটে এই এলাকায় তাদের দায়িত্ব পালন করেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যে কক্ষে ইসরাফিল খুন হয়েছেন সেই কক্ষের সামনের মূল গেটটি কাঠের। এরপর কলাপসিবল গেট। করিডোর পার হয়ে রুমের ভেতরে আরও একটি কলাপসিবল গেট। এটি পার হলেই বুকিং কাউন্টার। সাধারণ লোকজন কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর কারও এই কাউন্টার কিংবা কক্ষে ঢোকার অনুমতি নেই। ২০টি কাউন্টারের টিকিট বিক্রির অর্থ এই কক্ষটিতে দায়িত্বরত বুকিং সহকারীর নিকট জমা রাখা হয়। তিনি বুঝে নেয়ার পর প্রধান বুকিং সহকারী এই অর্থ বুঝে নেন। একাধিক বুকিং সহকারী দাবি করেছেন এখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি থাকলেও অনেকেই এ নিয়ম মানেন না। টিকিটের জন্য খোদ রেলওয়ের নিজস্ব লোকজনদের তদবির ও আনাগোনায় অনেক সময় দায়িত্ব পালন করাই দায় হয়ে পড়ে। তাছাড়া, মূল গেটের সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর কোন সদস্য না থাকায় সাধারণ মানুষও টিকিট বা অন্য কোন প্রয়োজনে যখন তখন বুকিং কাউন্টারে অবাধে প্রবেশ করে। একাধিক বুকিং সহকারী মানবজমিনকে জানান, ঈদ ও দুর্গা পূজা উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট বিক্রির পর থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। শুক্রবার বিকাল তিনটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত টিকিট বিক্রির ১৭ লাখ ১৮ হাজার টাকার পুরোটাই নিহতের কক্ষে একটি লকারে রাখা ছিল। এছাড়া, পাশের কক্ষের লকারে ছিল টিকিট বিক্রির আরও প্রায় ২০ কোটি টাকা। কর্তৃপক্ষকে বুকিং কাউন্টারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও তারা কর্ণপাত করেনি। এবিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. খায়রুল বশীর মানবজমিনকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম ঘটেছে। এভাবে বুকিং কাউন্টারের ভেতরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা খুন করে টাকা লুট করে নিয়ে যাবে সেটা বিস্ময়কর। একটু আতঙ্ক থাকবে তাই স্বাভাবিক। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
নিহত মো. ইসরাফিল হোসেন কর্মজীবনে সৎ ছিলেন। ১৯৮৫-১৯৮৬ সাল থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি বুকিং কাউন্টারে দায়িত্ব পালন করেছেন। এজন্য অবসরের পরও আবার তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, স্টেশনের বুকিং কাউন্টারগুলোতে টিকিট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হয়। ইসরাফিল হোসেন বরাবরই এর বিরোধিতা করেছিলেন। তার এক সহকর্মী জানান, শুক্রবার বুকিং কাউন্টারের এক সহকারী প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি টিকিট নিজের পকেটে পুরে নেন। বিষয়টি ইসরাফিল হোসেনের নজরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রেলওয়ের ডিআরএম সরদার সাহাদাৎ আলীকে অবহিত করেন। তিনি এসে ওই সহকারীর পকেট থেকে টিকিটগুলো উদ্ধার করেন। এনিয়ে ওই সহকর্মীর সঙ্গে ইসরাফিল হোসেনের কথা কাটাকাটি ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের ধারণা এ ঘটনাও খুনের কোন যোগসূত্র হতে পারে। শুক্রবার ইসরাফিল হোসেনের দায়িত্ব ছিল টিকিট বিক্রির ক্যাশ সংগ্রহ করে লকারে জমা রাখা। প্রথম শিফটে তিনি সাড়ে তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় শিফটে রাত ৯টা থেকে আবারও দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ের মধ্যে বিক্রীত টিকিটের ২৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫১০ টাকা বুকিং মাস্টারের নিকট বুঝিয়ে দেন। এরপর ১২টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত প্রতিদিনের মতো এই কক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন ইসরাফিল হোসেন। কক্ষে তিনি একাই ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে খুনিরা এই সময়ের মধ্যে কলাপসিবল গেটের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে টাকা লুট করে নিয়ে যায়। স্টেশনের নিরাপত্তার বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. সাখাওয়াৎ হোসেন খান মানবজমিনকে বলেন, এধরনের ঘটনা এই স্টেশনে প্রথম। একটু আতঙ্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে আমরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য। যাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা আর না ঘটে। আর খুনি যেই হোক শিগগিরই তা উদঘাটিত হবে বলে তদন্ত কমিটি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কমলাপুর রেলওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, মো. ইসরাফিল হোসেনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। লাশের গায়ে হাতের ছাপ ও অন্যান্য পরীক্ষার জন্য আলামত ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ