বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১১

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের সাধারন ক্ষমা নিয়ে একজন আইনজীবির মিথ্যাচার এবং প্রকৃত ঘটনা



বাংলাভিশনের এক টক শোতে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি বলছেন – শেখ মুজিব যুদ্ধপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। যারা বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য জানেন তারা কথাটা যে কত বড় মিথ্যাচার তা স্বীকার করবেন। জামায়াতের নেতাদের রক্ষার জন্যে খন্দকার মাহবুব হোসেনের কেন এই মিথ্যাচার?

আসল ঘটনা কি ঘটেছিলো বঙ্গবন্ধুর “সাধারন ক্ষমা”য়?

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যখন পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরনপণ সংগ্রামে লিপ্ত – তখন “ জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ” একটা সংগঠন হিসাবে নীতিগত কারনে সেই মুক্তির সংগ্রামের শুধু রাজনৈতিক ভাবে বিরোধীতিই করেনি – রাজাকার, আল-বদর, আলশাসম বাহিনী তৈরী করে সক্রিয় ভাবে পাকহানাদারদের হত্যা, ধর্ষন, লটপাট এবং অগ্নিসংযোগে সহায়তা করেছে। দেশের মানুষ যখন মুক্তি আশায় অসহনীয় কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছিল – তখন জামাত একটা সংগঠন হিসাবে তাবেদার মন্ত্রী সভায় গিয়েছে, পাতানো নির্বাচনের অংশগ্রহন করেছে। এর সবই প্রমান মিলে তাদের পত্রিকা “দৈনিক সংগ্রাম”এর ১৯৭১ সালের সংখ্যাগুলোতে।

এরই প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর জামাতসহ স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতার পরপরই জামাতের অনেক নেতাকর্মী জেলে যায়, অনেকে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান নেয়। বিদেশে থাকা জামাত নেতারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যতদিন না দেশে তাদের জন্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয় – ততদিন তারা বিদেশে বসে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যক্রম চালাতে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ১৯৭৫ সালের হত্যাকান্ড পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

তারপর সামরিক শাসক মে: জে: জিয়াউর রহমানের সাথে আঁতাত করে এরা দেশে ফিরে আসে। তখন থেকেই প্রচার শুরু হয় বঙ্গবন্ধু এদের ক্ষমা করে দিয়েছে। এটা একটা বিরাট ভুল ও প্রপাগান্ডা। সাধারন ক্ষমার আওতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী সাধারন কর্মীদের ক্ষমা করা হয় – যাতে এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সাধারন ক্ষমার আওতায় সেই ৩৪ হাজার ৬০০ রাজাকার, মুসলিমলীগ কর্মী, জামাত কর্মীদের ক্ষমা করা হলেও তাদের পুরানো বিশ্বাসের রাজনীতি করা অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। তাদের সেই অধিকার ফিরে পাবার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

অনেকের কাছে প্রশ্ন যে স্বাধীনতার পরপরই কেন বিচার করা হলো না। এই প্রশ্ন আসার কারন হলো দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসকরা আমাদের ইতিহাস বিকৃতি করেছে এবং অনেক কিছু গোপন করে রেখেছিলো। ফলে একটা প্রজন্মের কাছে অনেক কথাই অষ্পষ্ট থেকেছে। এখানে ষ্পষ্ট করা দরকার যে - স্বাধীনতার পরপরই Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (P.O. No. 8 of 1972), এর আওতায় বিচার কাজ শুরু হয় - সেই বিচারের পরিসংখ্যান হলো -

১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আটক হয় - ৩৭ হাজার ৪ শত ৯১ জন

ট্রাইবুনাল গঠিত হয়- ৭৩ টি ( সারা বাংলাদেশে )

১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উক্ত ট্রাইবুনাল গুলোতে দায়ের করা মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মোট ২ হাজার ৮ শত ৪৮ টি মামলা ।

দোষী প্রমাণিত হয় - মোট ৭৫২ জন

মামলায় খালাশ পায় - ২ হাজার ৯৬ জন ।

আইনগত ব্যাবস্থায় দ্রুততা আনার জন্য সে সময় ৭৩ টি ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা করা হলেও প্রতিদিন ৩-৪ টির বেশী মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয়নি এবং মাসে যার পরিমাণ ছিলো ১৩০ টির মত মামলা ।

পরে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে সামরিক ফরমানে আইনটি বাতিল করেন - যা ৫ম সংশোধনীর সুবাদে সংবিধানের অংশ হয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, সাধারন ক্ষমা ঘোষনায় সুস্পষ্ঠ ভাবে উল্লেখ ছিল যে,

“এই আদেশ বলে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা), ৩০৪ ধারা (হত্যার চেষ্টা), ৩৭৬ ধারা (ধর্ষন), ৪৩৫ ধারা (অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্বারা ক্ষতি সাধন) ৪৩৬ ধারা (বাড়িঘর ধ্বংসের অভিপ্রায়ে অগ্নিসংযোগ বা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্মের চেষ্টা) মোতাবেক অভিযুক্ত বা দন্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না”

এখানে যেমন ঢালাও ভাবে ক্ষমা করা হযনি – তেমনি বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার সময়েও অনেক অপরাধীর বিচার চলছিলো। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সামরিক আদেশে সেই বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নির্বাহী আদেশ দন্ডপ্রাপ্তদের জেল থেকে মুক্তি দেন।

এরপর পঞ্চম সংশোধনীর সুবাদে জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। আজ দেখি বিএনপির নীতিনির্ধারকগন জামায়াতের পক্ষে উকালতি করতে কোর্টে যাচ্ছেন। বিএনপির প্রধান আদালতের রায়ের আগেই জামায়াতের নেতাদের নিষ্পাপ হিসাবে ঘোষনা দিচ্ছেন।

খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জার কথা যে স্বাধীন দেশের টিভিতে বসে পরাজিত শক্তির পক্ষে দেশের সর্বোচ্চ আইনজীবি ফোরামের নেতা অবলীলায় মিথ্যাচার করছেন ইতিহাস নিয়ে – যে ইতিহাসের সাথে ৩০ লক্ষ মানব সন্তানের মৃত্যু আর ৩ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম জড়িত।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ