বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১১

কাদের সিদ্দিকী’র ‘দৈত্য’নীতি

'’৭১-এ হানাদার বাহিনীর আতঙ্ক কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে আমরা অনেকটাই জানি। কিঞ্চিৎ জানতাম মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান সম্পর্কে। জানতাম না যুদ্ধের সময় তার দৈত্যনীতি নিয়ে। ৩১ মে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ তার কলামে (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি: ধলাপাড়া অভিযান) জানলাম কতটা পাশবিক তিনি ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দ্বৈতনীতি তিনি কিভাবে ধারণ করতেন। আসুন তার সুবিশাল কলামের কয়েকটি লাইনে চোখ বুলাই-

“ধলাপাড়ার রাজাকার কমান্ডার জসিম চৌধুরীর বাড়িতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। .......... অত্র এলাকায় চৌধুরীরা খুবই ধনাঢ্য সম্পদশালী পরিবার। .... খবর মতো (ড্যাক্‌সের ভিতর) নির্দিষ্ট স্থানে গুলিসহ রিভলবার এবং অনেক গুলি পাওয়া গেল।... ওই ড্যাক্‌সে নগদ ৮/১০ লাখ টাকা ছিল। সোনার পরিমাণ ৬/৭ মণ। (সেগুলো স্পর্শ না করায় গৃহিনীদের মনোভাব) .... এরা তো ..... শুধু অস্ত্রের জন্য এসেছে! দু’তিন জন মহিলা ... নানা স্থান থেকে গুলি বন্দুক নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিল। ..... আপ্যায়নের ধুম পড়ে যায়। ... কারও কিছু খাবার উপায় ছিল না। কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল অভিযানে গিয়ে কারও বাড়িতে কোনো কিছু খাওয়া যাবে না। ....... রিপোর্ট করল, অভিযান সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। ... রিপোর্ট শেষে যোদ্ধাদের চেক করতে গিয়ে দেখা গেল ১৪-১৫ বছরের ছোট একটি ছেলে। তার গায়ে .. একটি শাল ... যার দাম তখন বড় জোর ৭০-৮০ টাকা ছিল। তাকে যেই জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এটা তুমি পেলে কোথায়?’ .... খুব সন্ত্রস্তভাবে বলল, ‘চৌধুরী বাড়িতে।‘-কেন নিয়েছিলে-আর কেনই বা ফেরত দাওনি? .... ‘গেঞ্জি গায়ে ছিলাম। বৃষ্টি হওয়ায় ঠান্ডা লাগছিল ... গায়ে দেয়ার মতো কোনো কাপড় আছে কিনা বললে চাদরটি দিয়েছিলল।... শাল গায়ে সে কখন ফিরে এসেছে, অভিযান সফলতার কারণে হয়তো বুঝতেই পারেনি। ...... এখন কি হবে প্রশ্ন করতে বাবু নামের ছোট্ট ছেলেটি অস্ফুটভাবে বলেছিল, ‘আইনমত আমাকে গুলি থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না’। সত্যিই ... কেউ তাকে বাঁচাতে পারেনি।

পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলের সমন্বয়ের দায়িত্ব (১০-১১ দিনের জন্য) দেযা হয়েছিল শওকত মোমেন শাহজাহানকে। এরই মধ্যে সে পাহাড় তছনছ করে ফেলেছিল। .. বাড়িঘর ভেঙে খাট-পালঙ্ক, চকি-চৌকাঠ, বিছানাপত্র ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল। নলুয়ায় ৪-৫ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ..... সেই সময় যার তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকার উপর চাঁদা নিয়েছিল। না হলেও দেড়-দুইশ’ জনকে গরু-খাসি, ধান-চাল দেওয়ার জন্য হুমকিপত্র দিয়েছিল। .... তবে সে সবসময় একজন নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মী ছিল। ’৭১-এর জুলাই মাসের শেষ দিকে ওইসব অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ... বিচার সভা বসালে তার অপরাধ বিচার বিবেচনা করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। দন্ড অনুমোদনের জন্যে আমার কাছে এলে সিদ্ধান্তটা বড় কঠোর বলে মনে হয়। .... আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের একজন পুরানো কর্মী। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে চিনি।..... অকপটে স্বীকার করে এবং এও বলে, সে কাজগুলো করেছে তা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করেনি। তার দায়িত্ব মনে করেই করেছে। তাই তার মৃত্যুদন্ডের বিষয়টি পুন:বিবেচনা জন্য স্থগিত রাখা হয়।.... শাহজাহানকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেয়া হয়। ... সেপ্টেম্বরের শেষে ... তাকে হেড কোয়ার্টারের বেসামরিক প্রশাসনে যুক্ত করা হয়। ... স্বাধীনতার পরে যারা আমার সাথে ছায়ার মতো থেকেছে তাদের মধ্যে শওকত মোমেন শাহজাহান একজন। যদিও সে বর্তমাসে সরকারি দলে থেকে আমার চরম বিরোধিতা করে এবং ’৯৯-এ ভোট কারপি করে বিশ্ব রেকর্ড করেছে।”

একটি শালের জন্য ১৪-১৫ বছরের একটি বাচ্চাকে মৃত্যুদন্ড। আর বিশ্বস্ত রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় একজন খুনে-লুটেরা’কে (কমান্ডারদের বিচারে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত) ২ মাসের কারাদন্ড দিয়ে প্রশাসনে যুক্ত করা এবং নিজ ছায়ায় রাখা! মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে পানি পান নিষেধ ছিল (টাগের্ট এরিয়ায়) তখন শান্ত এলকায় লুটপাট আর খুন করা দায়িত্ব মনে করা! কাদের সিদ্দিকী ‘বজ্রকথন’-কে মনে হয় ‘বস্ত্রকথন’। নিজে কতগুলো মহামূল্যের বস্ত্রের যোগ্য আর কার কার (ক্ষমতাবান) বস্ত্র হরণ করা যায়, এসবই তার লেখায় প্রকাশ পায়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ