বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১১

গল্পিতা

গল্পিতা-১
শ্যামলী পাল অথবা ধলাই নদী

শ্যামলী পাল আমার স্কুলবেলার সহপাঠী ছিল। সে খুব রঙিন রঙিন জামা পড়ে স্কুলে আসতো। লাল অথবা গোলাপী। আর লতাপাতা আঁকা হরেক রকমের জামা। খুব শৈশবের স্মৃতি মনে নেই। তবে তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণি থেকে তাকে এভাবেই দেখে এসেছি মনে হয়। তারপর আরও একটু উপরের ক্লাশে উঠলে সে মুখ খুব লাল করে রাখত মনে পড়ে। পান খেয়ে অথবা লিপিস্টিক দিয়ে। তার গালগুলো ছিল গোলাপী আর ফুলা ফুলা। খুব গাল ফুলিয়ে মাথার বেণী দুলিয়ে কথা বলত। মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তারপর কখন সে ক্লাশ থেকে হারিয়ে গেল মনেই করতে পারিনে। আমিও দূরের শহরে পড়তে চলে গেলাম।তবে মাঝে মাঝে বাড়ি গেলে তার গল্প শুনতে পেতাম। এই বিয়ে হয়ে গেছে.. ঐ গ্রামে থাকে এইসব। কিন্তু কোন গ্রামে মনে রাখার গরজ বোধ করিনি।
আমার বাড়ির পশ্চিমে নীল মির্তিঙ্গা পাহড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অছে যে গাঁ সেখাইেন ছিল তাদের বাড়ি। তাদের গাঁ ঘেষে চলে গেছে ধলাই নদী। শৈশবে তাকে প্রথম যেদিন দেখি বিষ্ময়ে অবাক মানি। কী প্রমত্তা। যৌবনের ঘোলা জল নিয়ে কী সমারোহে পাহারের পাদদেশ দিয়ে শ্যামলীদের গাঁ ঘেসে বয়ে চলেছে। শ্যামলীর মতো গাল ফুলিয়ে,জলের বেণী দোলাতে দোলাতে। তারপর ফিরে আসি বাড়ি। সেখান থেকে শহরে। শহর থেকে আরো আরো শহরে। সেখানে আরো কত কত নদী। পদ্মা,যমুনা, হাডসন,টেমস, আরো কত কত নদী। প্রমত্তা নায়গ্রাকেও দেখি। কত কত সহপাঠী পাই- ড্যানী, সোহানী, মাগফুরা,সুলতানা নক্ষত্রের মতো জ্বল জ্বলে নাম। তাদের কত কত রূপ যৌবন। শ্যামলী অথবা ধলাই কাউকেই মনে পড়ে না। বহুদিন পর এইবার বাড়ি ফিরি। স্ত্রী বলেন, তোমাদের নদী দেখতে যাবো। আমার মনে পড়ে আমাদের একটি নদীও আছে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ আমি এক দুপরে নদী দেখতে যাই। সেই শৈশবে দেখা বেণী দুলানো ধলাই নদী। হা! গিয়ে দেখি সে শীর্ণ ধারা এক –বিগত যৌবনা। এবার আর তীওে দাঁড়িয়ে শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না। নেমে পড়ি জামা কাপড় স্ত্রী পুত্র কন্যা সমেত। সে আমাদের খুব শান্তভাবে তার বুকে গ্রহণ করে। সবাই দাপিয়ে বেড়ায়। আমি ভীড়ের, হল্লার ভেতর হঠাৎ একা হয়ে যাই। মনে পড়ে শ্যামলীরে। বিষন্ন বিকেলে বাড়ি ফিরে আমি।রাতে ঠিক করি কাল আবার নদীকে আর শ্যামলীকে গোপনে খুঁজতে যাবো।
পরদিন পড়ন্ত বিকেলে আবার একা একা দেখতে যাই। কী ভেবে নেমে পড়ি জামা কাপড় সমেত। ধলাই আমাকে শান্তভাবে গ্রহণ করে। আমি গলা ডুবিয়ে বসে থাকি। নদীর বাঁকা ¯্রােত বয়ে যেতে থাকে। সন্ধ্যা হলে উঠে পড়ি। উঠে ভেজা কাপড়ে আধো অন্ধকারে মেটো পথধরে হাটতে থাকি- যে পথ গেছে শৈশবের শ্যামলীর গাঁয়। বাঁশঝাড় ঝোপজঙ্গল হঠাৎ দেখি পুরানো কালি বাড়ি। ভয়ে আমার ভেজা গাঁ হিম হয়ে যায়।জনমানব কাউকে দেখি না। হঠাৎ যেন মাটি ফুড়ে আমার সন্মুখে সন্মুখে এক শাদা বুড়ি হাটতে থাকেন। যেতে েেযতে হঠাৎ তিনি থামেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলেন, কাকে খুঁজো বাবা? আমি বলি শ্যামলীরে। সেতো গেছে বাবা মরে পঞ্চম বাচ্চা হওনের কালে। ঐ যে পেছনে কালি মন্দিরের শ্মশানে তার ছাই ওড়ে। বুড়ি নাই হয়ে যান। আর আমি হু হূ বাতাসের ভেতর কাঁপতে থাকি।

গল্পিতা-২
ইরেজার

শুয়ে ছিলাম সন্ধ্যায়। আমার ৬ বছরের ছেলে খেলা করছিল পাশে। হঠাৎ মনে হল সে কী যেন আমার গায়ে ঘসছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলি কী করছ বাবা? তোমাকে মুছে ফেলছি। ভয়ে আমি অস্থির। না না আমাকে মুছে ফেল না, আমাকে মুছে ফেল না বলে ধড়মড় করে ঊঠে বসি। ছেলেটি আরো উৎসাহ পায়। আমার ডান হাতে ইরেজার চালাতে থাকে। আমি ওয়াদা করতে থাকি- ঠিক আছে আমি আর কখনও তোমার আম্মুর পাশে যাবো না। আমার ছেলেটি তার মায়ের পাশে আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। আমার ওয়াদাতে কাজ হয় না। সে আমার মুখে হাতে এখানে ওখানে ইরেজার চালাতেই থাকে। দেখি সে আমার ডান হাত পুরোটাই মুছে ফেলেছে। আমি আর্তনাদ করে উঠি। বাবা এখন আমার কী হবে? আমি কী করে কবিতা লিখব? আমার তো হাতই নেই! তার মাকে ডাকি। মা বলে ছি বাবা আব্বুকে বিপদে ফেলে না । তাড়াতাড়ি হাত এঁকে দাও। তার একটু মতি হয়। সে কাঠ পেন্সিল নিয়ে আসে। দ্রুত হাত এঁকে দিতে থাকে। সবকিছু ঈশ্বরের মতো যতœ করে আঁকার সময় নেই তার। হয়ত আঁকলো না সবগুলো আঙ্গুল। দিল না হাতের রঙ। তবু হাতখানা তো ফেরৎ পাওয়া গেল। বলি, বাবা আরো কী কী যেন মুছে ফেলেছিলে, এঁকে দাও প্লিজ। তার কি আর হয় সময়। ততোক্ষণে অন্য খেলায় মগ্ন। কিন্তু আমার তো মনে হয় সে আমার মুখের কী কী যেন মুছে ফেলেছিল। হয়ত ভ্রু, কপাল। কাল সকালে আয়নায় দেখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ