মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১১

ভারতে দ্রৌপদী বা কয়েক ভাইয়ের এক বউ প্রথা এখনও প্রচলিত

ভগপত, ৩১ অক্টোবর: মহাভারতে দ্রৌপদী ছিল পাঁচ স্বামী। মা কুন্তির আদেশে পাঁচ ভাই, যাদের বলা হয় ‘পঞ্চ পান্ডব’, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের স্ত্রী ধ্রুপদীকে।

এ তো গেল পুরাণের কথা। কিন্তু স্ত্রী ভাগের এই ঘটনা শুধু পুরাণেই নয়, এখনো প্রচলিত আছে। ভারতের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই দ্রৌপদী প্রথা অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নের মতো। বিশেষ করে কিশোরী এবং তরুণীদের কাছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের গ্রামগুলোতে গেলে দেখা যায়, অনেক পরিবারেই রয়েছে একজন করে দ্রৌপদী। অর্থাৎ, একই পরিবারের একাধিক ছেলের জন্য স্ত্রী রয়েছে একজন।

উত্তর প্রদেশের ওই গ্রামগুলোতে কন্যা শিশু জন্মালে তাকে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই মাতৃগর্ভে থাকাকালীন বা জন্মের পরপরই তাদের মেরে ফেলা হয়। এটা ওই সব অঞ্চলের জন্য কোনো অপরাধ নয়, এটা অনেক দিন থেকে চলে আসা একটি প্রথা। আর এই প্রথা মানতে গিয়ে ভারতের ওইসব অঞ্চলে এখন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে নারীর সংখ্যা। তাই, বিবাহযোগ্য ছেলেদের জন্য বউ খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। কিন্তু ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা এই সমস্যার সমাধানও খুঁজে বের করেছেন। এই সমাধানের নামই হলো ‘দ্রৌপদী প্রথা’। অর্থাৎ কোনোভাবে পরিবারের একটি ছেলেকে বিয়ে দিতে পারলেই হলো। এরপর ওই পরিবারের বাকি ছেলেদেরও স্ত্রী হয়ে যায় নতুন বউ। একাধিক স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে তাকে বাধ্য করা হয়।

সম্প্রতি এমনই এক এ যুগের ‘দ্রৌপদী’কে খুঁজে পেয়েছিলেন রয়টার্সের প্রতিনিধি নিতা ভাল্লা। ওই ধ্রুপদীর নাম ‘মুন্নি’। এ ধরনের ধ্রুপদীর সঙ্গে সচরাচর কথা বলা যায় না। কারণ এরা বেশির ভাগই রক্ষণশীল দরিদ্র হিন্দু পরিবারের বউ। যারা কোনো পুরুষ ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে পারে না। আর যদি বেরও হয় তাহলে মাথায় টানতে হয় দেড় ফুট লম্বা ঘোমটা।

রয়টার্সের নিতা ভাল্লা উত্তর প্রদেশের ভগপত জেলার একটি সরকারি হাসপাতালে দেখা পেয়েছিলেন ‘ধ্রুপদী’ মুন্নির। যে তিন মাস পর বাড়ির বাইরে পা রেখেছিলেন, চিকিৎসকের কাছে আসবেন বলে। অনেক লুকিয়ে এবং ভয়ে ভয়ে মুন্নি তার কথাগুলো জানায় নিতা ভাল্লাকে ।

মুন্নি জানান, যখন শৈশব শেষে মাত্র কৈশরে পা দিলেন ঠিক তখনি তার বিয়ে হয়ে যায়। জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে সংসার করতে হয় একই পরিবারের তিন ছেলের সঙ্গে এবং তাকে বাধ্য করা হয় প্রতিটি ছেলের সংসারে অন্তত একটি করে ছেলে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য।

মুন্নি বলেন, ‘‘আমার স্বামী এবং তার মা-বাবা আমাকে তাদের মনের মতো করে অন্য ছেলেদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। তারা যখন যার ঘরে আমাকে যেত বলে, আমাকে তখন সেখানেই যেতে হয়। যদি আমি কিছুর প্রতিবাদ করি তাহলে অনেক মার খেতে হয়।’’

এখন মুন্নির বয়স ৪০, তিন স্বামীর ঘরে তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনো ওই একই কারণে প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। কিন্তু এত কিছুর পরও আইনের সাহয্য নিতে পারে না এসব ধ্রুপদীরা। কারণ ছোটবেলা থেকেই এসব মেয়েদের এমনভাবে মানুষ করা হয় যে বাইরের জগত সম্পর্কে তারা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে থাকে। আর যারা একটু বুঝতে পারে তারা বাধা পড়ে যায় চার দেয়ালের মাঝে। কড়া নজরদারি এবং মৃত্যুর হুমকির কারণে চুপচাপ সইতে থাকে সব ধরনের নির্যাতন। আবার অনেকে এই নির্যাতন সইতে না পেরে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।

২০১১ সালে ভারতের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের এই ভগপত নগরের ১০০০ পুরুষের বিপরীতে রয়েছে ৮৫৮ জন নারী। কিন্তু ওই জেলায় সবচেয়ে ভয়াবহ হারে কমছে কন্যা শিশুর সংখ্যা। ২০০১ সালে এক হাজার ছেলে শিশুর বিপরীতে যেখানে ৮৫০ কন্যা শিশুর জন্ম হয়েছিল, সেই সংখ্যা এখন পৌঁছেছে ৮৩৭-এ। শুধু ভগপত জেলাই না, একই অবস্থা হরিয়ানা, গুজরাট, পাঞ্জাব এবং রাজস্থানেও।

ভগপত জেলার এক অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল জানান, শুধু যে ভগপত জেলার কিশোরীরাই ‘ধ্রুপদী প্রথা’র শিকার তা না। ঝাড়খন্ড এবং উত্তর প্রদেশের অনেক দরিদ্র গ্রাম থেকে মাত্র ১৫০০০ (সর্বোচ্চ) রূপির বিনিময়ে একাধিক ছেলের জন্য একটি বউ কিনে আনে অনেক পরিবার।

কিছু সচেতন ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও তাদের সংখ্যা অনেক কম। রক্ষণশীল সমাজের সামনে তাদের নীতি কথা কাজে আসে না। উল্টো রক্ষণশীল সমাজ এই ‘ধ্রুপদী প্রথা’র অনেক ভালো দিকও বের করেছে। তাদের মতে, এর ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে না, আবার সম্পত্তি, জায়গা-জমি ভাগ বাটোওয়ারার ঝামেলাও থাকে না।

আর কন্যা শিশুর সংখ্যা কমে যাওয়াকে সাধুবাদ জানিয়ে ওই রক্ষণশীল সমাজ জানায়, এটা সমাজ এবং দরিদ্র পরিবারের জন্য ভালো দিক এবং আর্শীবাদ স্বরূপ। তাদের মতে, কন্যাদায়গ্রস্থ হওয়ার চেয়ে কন্যা সন্তান জন্ম না নেয়াটাই শ্রেয় এবং এর ফলে একটি দরিদ্র পরিবারের বোঝা অনেক কমে যায়। সূত্র: রয়টার্স।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ