মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১১

ভিন্নমতকে ঘায়েল করতে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘রাজাকার’ অথবা ‘নষ্ট প্রজন্ম’ বলে গালি দেওয়ার দুর্গন্ধযুক্ত অপকৌশল আওয়ামী লীগের জন্যই আত্মঘাতী হবে!!!

‘রাজাকার’ শব্দটি ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশে খুবই পরিচিত একটি শব্দ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেছিল তাদেরকেই ‘রাজাকার’ হিসেবে চিনেছিলাম(বড়দের কাছে শুনে।) আমার জন্ম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপট প্রত্যক্ষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি ‘রাজাকার’ শব্দটির সঠিক প্রয়োগই দেখেছি। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এর প্রয়োগ বেড়েছে; শুধু বেড়েছে বললে কম হবে - যখন খুশি, যেখানে খুশি, যাকে ইচ্ছা যে পরিস্থিতেতে ইচ্ছা ভিন্নমতকে ঘায়েল করার জন্য ‘রাজাকার’ শব্দটিকে তাদের একটা অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করছেন। শব্দটির প্রয়োগ করতে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা পাতিনেতা সমর্থক সবাই এর ইচ্ছামতো প্রয়োগ করছেন। নিজেদের চিন্তা বা মতের সাথে না মিললেই অথবা ভিন্নমতের কাউকে পেলেই ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন করছেন। আপাত দষ্টিতে মনে হয় ভিন্নমতকে ঘায়েল করার এটাই তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের প্রয়োগ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না ভিন্নমতের মুক্তিযোদ্ধারাও।

এই তো গত ০৯-০৭-২০১১ তারিখে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পালিমা বাসষ্ট্যান্ডে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সন্ধার দিকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পালিমা বাসষ্ট্যান্ডে পৌছলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা তার গাড়ির গতি রোধ করে কাদের সিদ্দিকী কে উদ্দেশ্য করে ’কাদের সিদ্দিকী রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ - সহ আপত্তিকর শ্লোগান দেয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে ‘রাজাকার’ বলেই সম্বোধন করেছিলেন বলে একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে দেখেছিলাম।

বর্তমান সরকারের সমর্থক অনেক মুসলিমকেও ইসলাম ধর্ম বা মুসলমানদের নিয়ে বিদ্রূপ করতে প্রায়ই শোনা যায়। শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়তে গেলে সেখানে ইমামা সাহেবের বয়ানকে অনেকেই ‘মসজিদে জিহাদের ডাক’ বলে সম্বোধন করেন। আসলে এটাকে কটাক্ষ অথবা বিদ্রূপ করেন নাকি অন্য কিছু বোঝাতে চান ঠিক বুঝে ওঠতে পারিনা। এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাইলে ‘জামাতের লোক’ বলে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকেই শুনেছি। আসলে বুঝতে পারছিনা ইসলাম ধর্ম নিয়ে কিছু বলতে গেলে অনেকেই বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরাও এর মধ্যে ‘জামায়াতের গন্ধ’ পান। তারা আসলে কি মনে করেন তা বুঝতে না পারলেও আপাতঃ মনে হয় তাদের ধারণা জামায়াত হচ্ছে ইসলাম ধর্মের স্ট্যান্ডার্ড। আর ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করা বা পালন করার মানেই জামায়াতের সমর্থক। মুখে দাঁড়ি, পরনে পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি থাকলেও জামায়াতের সমর্থক বলে অনেকেই মনে করেন বলেই অনুমান করা যায়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এমনই একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান অপশাসনের বা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কিছু বললেই প্রথমেই তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, লোকটি জামায়াতের সমর্থক। বেশ কয়েকটি এমন পরিস্থিতি আমি প্রত্যক্ষ করেছি; এমনকি নিজেও এই ব্লগেই এমন আক্রমণের শিকার হয়েছি। আওয়ামী লীগের সাথে ভিন্নমত পোষণ করলেই জামায়াতে ইসলামী বা নিজামীর সমর্থক বলে সম্বোধন করে এই ব্লগেই। জামায়াতকে যারা ইসলাম ধর্মের স্ট্যান্ডার্ড মনে করে, সেসব হীনমন্যতা ও দুর্গন্ধযুক্ত মানসিকতার লোকদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়েছে আজ দেড় হাজার বছর, আপনারা বলবেন কি জামায়াতে ইসলামী নামক দলের বয়স কত দিন?

বেশ কিছুদিন আগে(বছর খানেক বা তার চেয়ে কিছু বেশি হবে) নেত্রকোনা জেলায় একটা ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম। সেখানে আলোচনার একপর্যায়ে ডিসি মহোদয় বলেছিলেন, ‘আমারা বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যেখানে দুইজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ঝগড়া হলে বা মতের মিল না হলেও একজন আরেকজনকে ‘রাজাকার’ বলে গালি দেয়। সত্যিই আমাদের সহনশীলতা বাড়ানো উচিত।‘ ডিসি মহোদয়ের কথাটি এখনও আমার খুবই মনে পড়ে।

লক্ষ্য করেছি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা সমর্থক যাদের বয়স এখনও ২৫ বছর পার হয়নি, তারাই ১৫-৪০ বয়সের ভিন্নমতের লোকজনকে অহরহ ‘রাজাকার’ বলে গালি দিচ্ছে। আর বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা সমর্থক যাদের বয়স ৩০ বছর পার হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তো কোন বাঁধাই নেই। যদি কোনমতে বুঝতে পারে যে, লোকটি আওয়ামী লীগের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে তাহলেই হল। কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই সরাসরি একশন, ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন।

এসব ঘটনাবলির জন্য ঐ ২৫ বা ৩০ বছর বয়সী লোকটিকে সম্পূর্ণ দায়ী করতে আমি নারাজ। এই চর্চা চলছে আমাদের ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ মহলে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরও অনেকেই এই চর্চা করে চলছেন। এইতো গত কিছুদিনে আমাদের বর্তমান আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বেশ কয়েকটি গোল টেবিল বৈঠক এবং আলোচনা সভায় স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে দুইটি ধারার রাজনীতি চলছে- একটি স্বাধীনতার পক্ষের এবং অন্যটি স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। আর আওয়ামী লীগ হল সেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।‘
আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলামের কথা অনুযায়ী যারা আওয়ামী লীগের বাইরে তারা সবাই ‘রাজাকার’ বা স্বাধীনতা বিরোধী।

তাহলে গত ডিজিটাল নির্বাচনের দিক থেকে বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করা যায়। আমরা ধরে নিতে পারি আওয়ামী লীগের সাথে যারা মহাজোটে আছেন, আওয়ামী সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। তাহলে গত ডিজিটাল নির্বাচনে মহাজোট মোট ভোট পেয়েছিল ৫৭%; তাহলে বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী ভোট হল কমপক্ষে ৪৩%; এই কথাটা কতজন লোক বিশ্বাস করবে বা জোর করে কতজনকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা যাবে, তারা মানবেন?

কিছুদিন আগে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা ভিশন’ এর ফ্রন্ট লাইন নামক ‘টক শো’ তে আংশ নিয়েছিলেন। সেখানে একজন দর্শক টেলিফোনে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলেন – বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরাও বলেন আওয়ামী লীগের বাইরের সবাই ‘রাজাকার।’ আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময় কত শতাংশ লোক স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল এবং কত লোক ‘রাজাকার’ ছিল? তিনি (বঙ্গবীর) উত্তর দিয়েছিলেন, সে সময়ে খুব বেশি করে হলে পনের লক্ষের মতো (তখনকার মোট জনসংখ্যার ২%) লোক স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল আর তাদের সবাই কিন্তু আবার ‘রাজাকার’ ছিল না।

আওয়ামী সংজ্ঞা অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী ‘রাজাকার’ কমপক্ষে সাড়ে ছ্য় কোটি হবে (২০১১ সালের আদম শুমারির হিসেব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৪৩%)

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রার পর এক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলের প্রজন্মকে ‘নষ্টপ্রজন্ম’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এ সময়ের প্রজন্মকে ঠিক করা সম্ভব নয়। এই নিয়ে ৩১ মে, ২০১১ তারিখে আসুন নষ্ট প্রজন্মের লোকসংখ্যা হিসেব করে তাদের করনীয় নির্ধারণ করি!!! শিরোনামে একটি ছোট লেখা পস্ট করেছিলাম। যেখানে বিভিন্ন উৎসের সাহায্য নিয়ে দেখাতে পেরেছিলাম যে, ১৯৭৬-১৯৯১ এই সময়ের প্রজন্মের জনসংখ্যা ৪ কোটির মতো হবে। আর এখন তাঁদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মসহ গ্রোসলি সাড়ে চার কোটির মতো হবে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ডিজিটাল নির্বাচনের সময় যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই ১০-১৫% লোক আছেন যারা একেক নির্বাচনে একেক দলকে ভোট দেন। তাঁদের একটা অংশ হয়তো আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে অন্যকোন দলকে বেছে নিতেও পারেন। তখন আওয়ামী লীগের ভোটের পরিমাণ থাকবে মোট ভোটের ৫০% এর নিচে। এর সাথে যদি যোগ হয় সেই ‘নষ্ট প্রজন্ম’এর লোকসংখ্যা। তখন জনসংখ্যার পরিমাণটা কত হবে? এতোদিন ধরে বিশেষ করে গত ডিজিটাল নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতা মোহে মত্ত হয়ে যাদেরকে বারবার ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘রাজাকার’ অথবা ‘নষ্ট প্রজন্ম’ বলে গালি দিয়ে ব্যাপক মজা পেয়েছেন, আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন, তারা সবাই যদি একজোট হয় তখন তাদের পরিমাণ হবে ৫০% এর উপরে। তখন নিজেদের অবস্থানটা কেমন হবে একটু ভেবে দেখবেন কী?

বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ, নেতা-পাতিনেতা, কর্মী বা সমর্থকরা এমনকি তাদের দলীয় কিছু বুদ্ধিজীবি যদি মনে করেন যে, দুর্গন্ধযুক্ত মানসিকতার মাধ্যমে ভিন্নমতের সাধারণ মানুষ বা ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘রাজাকার’ অথবা ‘নষ্ট প্রজন্ম’ বলে গালি দেওয়ার মতো একটা অপকৌশল অবলম্বন করলে, তাদের উপর অপবাদ দূর করার জন্য তারা সবাই ‘বাংলাদেশের পিউরিফিকাশন মেশিন’ আওয়ামী লীগে যোগ দিবে বা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে; তাহলে তাদের ধারণা ভুল হয়ে, আশার গুঁড়ে বালি পড়লে পড়তেও পারে। এর প্রমাণ গত পরশুর নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে নারায়ণগঞ্জবাসী প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের পছন্দের প্রার্থীকে তারা ঠিকই বেছে নিয়েছেন। এটাও অস্বাভাবিক নয় যে, জাতীয় নির্বাচনেও এমন প্রভাব পড়তে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, আওয়ামী লীগ যদি ভিন্নমতকে ঘায়েল করার জন্যই ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘রাজাকার’ অথবা ‘নষ্ট প্রজন্ম’ বলে গালি দেওয়ার মতো দুর্গন্ধযুক্ত মানসিকতার অপকৌশল থেকে সরে না আসে, তবে এই অপকৌশলটি তাদের জন্য আত্মঘাতীই হবে।

বর্তমান সমাজের মানুষ অনেক সচেতন, তারা চারপাশের সবকিছুই প্রত্যক্ষ করেন, সবকিছুই বুঝেন। যারা ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘রাজাকার’ অথবা ‘নষ্ট প্রজন্ম’ দোষে দুষ্ট নন, তারা নিশ্চয়ই এই অপবাদ মেনে নিতে প্রস্তুত নন এবং মেনে নিবেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ