শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১১

ইরানে হামলার প্রস্তুতি---ইসরাইল-ঈঙ্গ-মার্কিন রণ-উদ্যোগে ছড়িয়ে পড়ছে শঙ্কা


ইরানে পরমাণু কর্মসূচি সমপ্রসারিত হচ্ছে এই অভিযোগে দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইসরাইল যৌথভাবে হামলার নীলনকশা প্রণয়ন করছে। মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পর পশ্চিমা শক্তিগুলো হঠাৎ করেই ইরানকে টার্গেট করেছে, এতে মধ্যপ্রাচ্য পরিসি'তি জটিল হয়ে উঠছে। ইরান জানিয়েছে, যেকোনো হামলা মোকাবেলায় তারা ‘পূর্ণ প্রস'ত’ রয়েছে। খবর ডেইলি মেইল, গার্ডিয়ান, ইউএস টুডে ও অন্যান্য সূত্রের।
ব্রিটেন ও ইসরাইলের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী পত্রিকা গতকাল জানায়, ইরান চারটি পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে- এই খবরের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যুদ্ধের প্রস'তি নিচ্ছেন। ইসরাইলও খুব দেরি হওয়ার আগেই ইরানে হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্ররোচিত করছে। ইসরাইলের প্রভাবশালী পত্রিকা হারেজ জানায়, হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি, তবে ৮ নভেম্বরের পরে হঠাৎ করেই যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতে পারে।
ব্রিটেনের ডেইলি মেইল জানায়, আফগানিস্তান ও লিবিয়া যুদ্ধের কারণে ব্রিটেন চাপের মুখে থাকলেও ইরান হামলায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, ‘ব্রিটিশ সরকার মনে করে, ইরানি পরমাণু কর্মসূচি মোকাবেলা এবং আঞ্চলিক সঙ্ঘাত এড়ানোর সর্বোত্তম পন'া হলো যৌথভাবে চাপ প্রয়োগ ও ব্যবস'া গ্রহণ।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাই, তবে সব বিকল্পই হাতে থাকবে।’ বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান জানায়, ইরানে স'ল হামলার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বিশেষ বাহিনীর কিছু সদস্য এই অভিযানে প্রয়োজন হতে পারে। পত্রিকাটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবস'ানে ক্ষীপ্রগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করছে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
পত্রিকা জানায়, ইরানে হামলার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ ইউনিটকে নির্দেশও দিয়েছে।
সমরবিদেরা রাজকীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও সাবমেরিনগুলোতে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমানগুলোতে পেভওয়ে৪, ব্রিমস্টোন বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা করছেন। গার্ডিয়ানও জানিয়েছে, ইরানে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের জন্য ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনী পরিকল্পনা প্রণয়ন জোরদার করেছে।
হোয়াইটহলের পদস' ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি দিয়ে ডেইলি মেইল জানায়, ‘ইরানকে এখন আগ্রাসী দেখাচ্ছে, তবে কেন তা আমরা জানি না।’
পশ্চিমা গোয়েন্দারা আরো জানান, ইরান হয়তো তাদের গোপন পরমাণু অস্ত্রগুলো সুরক্ষিত বাঙ্কারে লুকিয়ে রেখেছে, যা প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
ডেইলি মেইল ও গার্ডিয়ান উভয় পত্রিকা জানায়, বারাক ওবামা এখন আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। ফলে তিনি এখন ইরান আক্রমণের কথা হয়ত চিন্তা করবেন না। কিন' যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান আক্রমণে রাজি করাতে ইসরাইল চাপ দিতে পারে। ইসরাইল অনেক আগে থেকেই ইরানকে সবচেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্র মনে করে আসছে।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে গার্ডিয়ান আরো জানায়, ইরানে আক্রমণ চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ ভূখণ্ড দিয়াগো গার্সিয়া ব্যবহারের অনুমতি চাইতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য সঙ্ঘাতে আগেও যুক্তরাষ্ট্র ওই ভূখণ্ড ব্যবহার করেছে।
গার্ডিয়ান জানায়, হোয়াইটহল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছেন, লিবিয়া বিপ্লবের পর ইরানের দিকে আবার মার্কিন ও ব্রিটিশদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে।
পত্রিকাটি আরো জানায়, ৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস'ার (আইএইএ) প্রতিবেদন পাওয়ার পরই যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। আইএআইএর ওই প্রতিবেদনে ইরানের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচির সর্বশেষ অবস'া জানা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ পত্রিকাটি জানায়, ওই প্রতিবেদন ‘দৃশ্যপট পরিবর্তন’ করে ফেলতে পারে।
হোয়াইট হলের এক কর্মকর্তা জানান, ওবামা সিদ্ধান্ত নিতে খুব দেরি করবেন না। তিনি চাইবেন না নির্বাচনের খুব কাছাকাছি সময়ে কিছু করতে। কাজেই এখনই তিনি হামলার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে অস্বীকার করেছে। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জে কার্নে বলেন, ‘আমি এ ধরনের জল্পনা-কল্পনার ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাব না। আমরা আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেলের দিকে দৃষ্টি রাখছি।’
সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ওবামা ও নেতানিয়াহু ইতোমধ্যেই ইরানে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মর্মে প্রকাশিত খবরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘এটা বুঝতে খুব বেশি মেধার দরকার হয় না যে, দুই ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।’ তবে পরদিনই তিনি ভিন্ন ইঙ্গিত দেন।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইহুদ বারাক মঙ্গলবার পার্লামেন্টে বলেন, ইসরাইল একাই ইরানে হামলা চালাতে পারে। তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে এমন পরিসি'তির সৃষ্টি হতে পারে যাতে করে ইসরাইল অন্য কারো ওপর ভরসা করা ছাড়াই তার নিজস্ব শক্তিতে তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।’
এ দিকে ইসরাইলি পত্রিকা হারেজ জানিয়েছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইরানে হামলা চালানোর জন্য মন্ত্রিসভার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। জ্যেষ্ঠ এক ইসরাইলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ওই সংবাদপত্রে বলা হয়, নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইহুদ বারাক ইরানের পরমাণু স'াপনায় হামলা চালাতে অনিচ্ছুক মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্মতি আদায়ে কাজ করছেন। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এএফপিকে জানান, তারা একটি উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা চালানো সম্ভব। হারেজ জানায়, নেতানিয়াহু ও বারাক এ হামলা চালানোর ব্যাপারে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যানের সমর্থন পেয়েছেন। তবে ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে হারেজের খবরে বলা হয়, বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রিই এ ধরনের হামলায় আগ্রহী নন। এ ক্ষেত্রে খুব একটা বেশি অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানরাও এ হামলার বিরোধী। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানের বিরোধিতা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু ও ইহুদ বারাক ইরানে হামলার সিদ্ধান- নিয়েছেন।
ছাড় দেয়া হবে না : এদিকে ইরান হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলেছে, ইসরাইল হামলা চালানোর হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না। ইসরাইল হামলা চালালে তাদের অবশ্যই শাসি- পেতে হবে। ইরান সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল হাসান ফিরোজাবাদি যেকোনো ইসরাইলি হামলার সমুচিত জবাব দেয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি ইরানের আধা সরকারি বার্তা সংস'া ফার্সকে বলেন, ‘আমরা যেকোনো হুমকি এমনকি তা খুব স্বল্পমাত্রার এবং দূরবর্তী হলেও সেটাকে কঠোর হুমকি বলেই বিবেচনা করি। আমরা পূর্ণ সতর্কতায় রয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের শাস্তি দেবো এবং তারা যেকোনো ভুলের জন্য অনুতাপ করবে।’
এ ছাড়া ইরান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল হিজাজি ফার্স বার্তা সংস'াকে বলেন, ‘বর্তমানে ইরানের বাহিনী আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী এবং বিদেশী বাহিনী ভালোভাবেই জানে যে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেকোনো অবৈধ ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনবে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইহুদি মিত্রের কাছ থেকে প্রবল হুমকির কথা উল্লেখ করে বার্তা সংস'া জেনারেল হিজাজির উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী এই অঞ্চলের সব মার্কিন রণতরী ও ঘাঁটিতে হামলা চালাতে সক্ষম।
ইরান অবশ্য বারবার বলে আসছে তারা কোনো পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ করছে না।
যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী : ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি মঙ্গলবার বলেছেন, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। এর ১০০টি অকাট্য প্রমাণ তাদের আছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হত্যার পরিকল্পনা করার অভিযোগ তোলার পর খামেনি এ অভিযোগ করলেন।
১৯৭৯ সালে তেহরানে মার্কিন দূতাবাসের বিরুদ্ধে ছাত্র বিপ্লব স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে খামেনি বলেন, ‘ইরান ও এ অঞ্চলে সন্ত্রাসের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত থাকার অকাট্য দলিল আছে।’
তিনি বলেন, ‘ওই ১০০ তথ্যপ্রমাণ প্রকাশ করে বিশ্ববাসীর কাছে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারি।’
তবে কখন, কার কাছে এ তথ্যপ্রমাণ দেবেন তা বলেননি খামেনি।
গত মাসে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট দু’জন ওয়াশিংটনের এক হোটেলে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল বলে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে।
তবে ইরান এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিতেই ইরানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছে বলে এ সময় মন-ব্য করেছিলেন খামেনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ