রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১১

রায়পুরায় গোপন বৈঠকে লোকমান হত্যার পরিকল্পনা


রোজার ঈদের পরদিন রায়পুরায় বৈঠকের মাধ্যমে লোকমান হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সাবেক আওয়ামী লীগের এক মন্ত্রীর এপিএস রিয়াজুল কবিরের নেতৃত্বে রায়পুরায় ওই গোপন বৈঠক বসেছিল। লোকমান হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত ১৪ আসামির অনেকেই উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। আর ওই বৈঠকেই লোকমান হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন রায়পুরা উপজেলার চরসুবুদ্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. ইলিয়াস মোল্লা। রায়পুরা উপজেলার সিরাজনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শনিবার আয়োজিত এক শোক সভায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি প্রশাসনের প্রতি বিষয়টি তদন্ত করার আহ্বান জানান ওই বৈঠক থেকে। এ বিষয়ে গত রাতে পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দীন বলেন, বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। এছাড়াও অনেক বেনামি চিঠির মাধ্যমে নানা তথ্য আসছে। সে সবও আমরা খতিয়ে দেখছি। উল্লেখ্য, মামলার ১নং আসামি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দীন বাচ্চুর বাড়ি রায়পুরার আদিয়াবাদে। ওদিকে লোকমান হোসেনের হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে পেরেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী, কিলার ও পেছনের মদতদাতাদেরও শনাক্ত করেছে তারা। পুলিশ বলছে কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা পরিষ্কার হয়েছে। নেপথ্যে কারা কাজ করেছে এবং এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে তাও পরিষ্কার। কিলাররা ক্রমাগত অবস্থান পরিবর্তন করায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। তবে আগামী ২-১ দিনের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন নরসিংদীর পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দীন। গতকাল এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তারকৃত হাজী সেলিম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে সাহায্য করছে। আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ৪ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
ফোন কল ট্র্যাক: নরসিংদীর বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদসহ প্রায় শতাধিক ব্যক্তির মোবাইল ফোন কল ট্র্যাকিং করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মোবারক হোসেন মোবা। সে মামলার ৩নং আসামি। তবে মোবা পলাতক। বর্তমানে সে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের আগে এমনকি হত্যাকাণ্ডের দিনও মোবার মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকটি কল এসেছে, যা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাব জানিয়েছে, তারা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করে কিলারদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছেন। তবে ঘটনার সময় যে-ক’জন কিলার উপস্থিত ছিল তারা সবাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের কাছে থাকা মোবাইল সংযোগও তারা বদলে ফেলেছে। অপরদিকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধানে নরসিংদীর আনাচে কানাচে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। একই সঙ্গে কিলারদের সহায়তাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য শহরের মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। একই সঙ্গে চলছে গোয়েন্দা তৎপরতা এবং বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে নজরবন্দি রাখা হয়েছে। গত রাতে ভেলানগর চেকপোস্ট থেকে একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, গ্রীন সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। নজরবন্দির তালিকায় স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ রয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
মোবার সংশ্লিষ্টতা: লোকমান হত্যা মামলার ৩নং আসামি মোবারক হোসেন মোবা এক সময় লোকমানের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। মোবারক, মেয়র লোকমান ও কবির সরকার বাল্যবন্ধু ছিলেন। বছর দেড়েক আগে পেশাদার কিলার মোবার সঙ্গে লোকমানের বিরোধ বাধে। শোনা যায়, পৌরসভা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জের ধরে এ বিরোধ বাধে। এছাড়া শহরে ছিনতাই, ডাকাতি ও টেন্ডারবাজিসহ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। লোকমান মোবাকে ভাল হয়ে যেতে বলেন। কিন্তু মোবা অপরাধ জগৎ থেকে ফিরে না এসে রাজুর গ্রুপের সঙ্গে হাত মেলায়। এছাড়া ২০০৪ সালের পৌর নির্বাচনে লোকমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হত্যা মামলার আরেক আসামি মতিন সরকার। পরে লোকমান বিপুল ভোটে জিতে যান। ওই নির্বাচনে মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু মতিন সরকারকে সমর্থন দেন। এরপর আবারও রাজিউদ্দিন আহমেদের পরিবারের সঙ্গে লোকমান পরিবারের বিরোধের সূত্রপাত হয়। পেছন থেকে ইন্ধন দিতে থাকে মতিন সরকার।
৪ দিনের রিমান্ডে সেলিম: মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে টঙ্গী থেকে গত বুধবার গ্রেপ্তারকৃত সেলিমকে ৪ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গতকাল নরসিংদীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহার আদালতে গ্রেপ্তারকৃত সেলিমকে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মনজুর করেন। মোবারক হোসেন মোবার ভাইঝি জামাই হলো এই সেলিম। গ্রেপ্তারকৃত সেলিম পুলিশকে জানিয়েছে, লোকমান হত্যার সঙ্গে মোবা জড়িত। নরসিংদী পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দীন জানান, বুধবার গাজীপুরের টঙ্গী থেকে সেলিমকে আটক করা হয়েছিল। গতকাল তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আমাদের ধারণা সে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। উল্লেখ্য, গত ১লা নভেম্বর রাতে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের ভিতরে ঘাতকরা নরসিংদী জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার ২ দিন পর অনেক নাটকীয়তা শেষে মামলা নেয় পুলিশ। মামলায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন রাজুর ভাই সালাউদ্দীন বাচ্চুকে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলায় মোট আসামি ১৪ জন। হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিনের মাথায় আটককৃত সেলিমকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। তবে এজাহারভুক্ত কোন আসামিকেই এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গোপালগঞ্জে গ্রেপ্তার ১
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিপন কাজী নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে নরসিংদী পুলিশ। সে গোপালগঞ্জ সদর থানার গোপীনাথপুর গ্রামের শরিফপাড়ার খোকন কাজীর ছেলে। নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত হালদার জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত তিপন কাজী একাধিক মামলার আসামি। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক ছিল। গতকাল তিপনকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করার পর নরসিংদীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে নরসিংদীর কুমিল্লাপাড়া স্থায়ীভাবে বসবাস করে। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ