বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১১

সাতক্ষীরার বাঘ মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি জাতিরাষ্ট্র। দীর্ঘদিনের বৈদেশিক শাসন-শোষণ ও পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদেরকে করে স্বাধীন। লাল-সবুজের এক মহান পতাকা এনে দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন জাতিসত্তার স্বাদ পাইয়ে দেয়া মহান মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সকল কালের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ সন্তান। বাংলদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরারও আছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জল ইতিহাস। এই সাতক্ষীরার মাটিতে সংঘঠিত হয়েছিল একাধিক রক্তক্ষয়ী লড়াই। এ মাটিতে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে নাজুমুল, কাজল, খোকনসহ আরও কত শহীদ।
পাকিস্থানী শাসনের নির্মমতার বিরুদ্ধে স্বাধীকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামে সাতক্ষীরায় যেসব আন্দোলন হয়েছে তার সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারিদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান তথা জাহাঙ্গীর এক অনন্য নাম। গল্পে শোনা সাতক্ষীরা কলেজের সেই টগবেগে তরুণ যিনি স্কুলে থাকতেই ঘাতকের দ্বারা পিতৃহারা হয়েছিলেন। অদম্য সাহস, প্রখর বুদ্ধি আর অসাধারণ সততার সাথে তার ছিল দেশমাতৃকার প্রতি নির্মোহ প্রেম। ৬০’র দশক বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের অহংকারের কাল, এই সময়ে ঢাকার পাশাপাশি সাতক্ষীরাতেও ছাত্র-জনতা স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে ক্রমেই যুক্ত হচ্ছিল একদল দেশপ্রেমিক তরুণ ছাত্র-যুবকের দুরন্ত সাংগঠনিক দক্ষতায়। তখনকার দিনে রাজনীতিতে দেশপ্রেম আর আদর্শই ছিল প্রধান, এখনকার দিনের মত ক্ষমতা আর অর্থের মোহ তখনও আসন গাড়েনি ছাত্র রাজনীতিতে। এমনি এক সময়ের মহানায়ক মোস্তাফিজুর রহমান। মহাকুমা ছাত্রলীগের তৎকালীন এই প্রধান এ অঞ্চলে আওয়ামীলীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতির প্রাণ ছিলের। তার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে সাতক্ষীরায় রাজনীতি সচেতন একটি সংবেদনশীল সমাজ স্বাধীনতার আকাঙ্খা নিয়ে ক্রমান্বয়েই সংগঠিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এক ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ সময়ে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারি আওয়ামী লীগের সাথে আদর্শিক বিরোধের কারনে গণমুক্তির আকাঙ্খার এক মহাস্বপ্ন নিয়ে আরও অনেক দেশপ্রেমিক যুবকের মত চির বিদ্রোহী মোস্তাফিজুর রহমান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এ যোগ দেন। শুধু যোগই দেননি মূলত তিনি ছিলে জাসদের রাজনীতিতে সাতক্ষীরার নিউক্লিয়াস। পরবর্তীতে বাসদ গঠনের সময়ও তিনি এই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। যদিও পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি দূরে ছিলেন আমৃত্যু।
মোস্তাফিজুর রহমানের নিস্বার্থ ত্যাগের অসংখ্য কাহিনী আমরা তার ঘনিষ্টজনেরা জানি। তার নিজমুখেই আমি শুনেছি, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পূর্বে তোফায়েল আহমেদ নিজে তাকে আশাশুনি অঞ্চল থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনের জন্য অনুরোধ করেন। আদর্শবান মোস্তাফিজুর রহমান সে প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেন। নানা সময়ে নানান ক্ষমতাবলয় থেকে তাকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করা হয়েছে গণমানুষের পক্ষে তার প্রতিবাদি রুদ্রমূর্তিকে প্রশমিত করতে। কিন্তু আমৃত্যু এই মহৎ প্রাণ মানুষটি ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থেকেছেন দৃঢ়তার সাথে। অসংখ্যবার সাতক্ষীরার মানুষ তাকে দেখেছে দরিদ্রের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি প্রভুসুলভ আচরণে অভ্যস্থ প্রজাতন্ত্রের চাকুরেদেরকে হুঙ্কার দিয়ে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আমার সাথে যখন তার ঘনিষ্ঠতা হয় তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং একই সাথে ঢাকাস্থ সাতক্ষীরা জেলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সমিতির উপর্যুপরি সভাপতি। তার ভাগ্নে ডাঃ মাহবুব আমার স্কুল জীবনের সহপাঠি ও অকৃত্রিম বন্ধু। মোস্তাফিজ মামা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন চিকিৎসারত ছিলেন। সেই সময়ে আমরা সাতক্ষীরার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছেলে-মেয়ে নিয়মিত তাক দেখতে যেতাম। সত্য বোধহয় এই যে, তার কাছ থেকে আমরা সাতক্ষীরার সমাজ ও রাজনৈতিক ইতিহাস সস্পর্কে অভূতপূর্ব সব তথ্যবহুল পাঠ নিতাম। আমরা মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করতাম তার সমাজ বিশ্লেষণের অসাধারণ সক্ষমতা। তিনি সাতক্ষীরা জেলাকে চিনতেন ঠিক নিজের হাতের তলদেশের মত। তার থেকে বেশি এই জেলার গ্রাম-জনপদ-শহরকে চেনে এমন মানুষ আমি আর কাউকে পাইনি। তিনি কথা বলতেন দৃঢ়তার সাথে, আমরা শুনতাম মুগ্ধতার সাথে। তিনি কথার পর কথা সাজিয়ে শোনাতেন অগণিত ইতিহাস। জাতীয় রাজনীতির সাথে দীর্ঘদিনের সংযোগের কারণে তিনি প্রচুর তথ্য রাখতেন এ সম্পর্কেও, আমরা জেনে নিতাম তাও। মোস্তাফিজ মামা বলবেন আমরা লিখে রাখব, এমন একটি পরিকল্পনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের বর্তমান সভাপতি ড. তৈয়েবুর রহমানের পরামর্শে আমি তাকে রাজি করিয়েছিলাম। সে জরুরী কাজটি তার মৃত্যুর কারণে আমরা শুরুই করতে পারিনি। বড় সাধ ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী, পুরোদস্তুর সংগ্রামী এই মানুষটির অভিগ্যতাকে ছাপার হরফে ধরে রাখার।
এই লেখাটির শেষ টানতে ইচ্ছে করছে তার জীবনের শেষ মঞ্চ বক্তৃতা(যা আমি ধারণ করে রেখেছি)-র কিছু অংশ দিয়ে। মৃত্যুর নিকট দূরত্বে দাঁড়িয়ে দ্বীপ্ত কন্ঠে তিনি বললেন,
“...ধর্মান্ধ মানুষ আর বুনো শুকরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বুনো শুকর যেমন বুকে কি বাঁধল তা না দেখেই ছুটতে থাকে ধর্মান্ধ মানুষও তেমনি কোন যুক্তির ধার ধারে না, সে গোয়ারের মত বিপথে চলতে থাকে।”
একই বক্তৃতায় তিনি আত্মপ্রবঞ্চণাকারি কিছু তথাকথিত কমিউনিস্টদের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, “...দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমি অদ্ভুত দু’রকম কমিউনিস্ট দেখেছি, একরকম হচ্ছে মুসলমান কমিউনিস্ট, আরেক রকম হলো হিন্দু কমিউনিস্ট”। 
কঠিন সত্য উচ্চারণের এই দৃঢ়তার কারণেই তাকে আমরা জানি সাতক্ষীরার ‘বাঘ’ বলে। তার মত বাঘের বড় অভাব আমাদের সমাজে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ