বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১১

পরমানু যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ,রাশিয়ার সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চূড়ান্ত চুক্তি

পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার সাথে চ‚ড়াš— চুক্তি করল বাংলাদেশ। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমানু শক্তি ব্যবহারের একটি দেশ হতে যাচ্ছে। আগামী ২০১৭ সাল নাগাদ পরমানু থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে সংশি­ষ্ঠরা আশা করছেন। প্রায় ৫০ বছর আগে শুরু করা প্রক্রিয়ার পর গতকাল বাংলাদেশ পরমানু যুগে ঢোকার চ‚ড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করল।
বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াসেফ ওসমান এবং রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও স্টেট এটমিট এনার্জি করর্পোরেশনের মহাপরিচালক সেগেই ভি. কিরিয়েনকো এই চুক্তিতে ¯^ার করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
রাশিয়া সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের এই চুক্তি অনুযায়ি, পাবনার বাংলাদেশ রূপপুর পারমানবিক প্রকল্প এলাকায় এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি মোট দুই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বা দুই শত কোটি ডলার খরচ হ্েব। রাশিয়া সরকার বাংলাদেশকে এই অর্থ ঋণ দেবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সকল সহযোগিতা দুই সরকারের মধ্যেই হবে। অর্থায়নের জন্য উভয় দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে পরবর্তীতে চুক্তি হবে।
চুক্তি অনুযায়ি, পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি রাশিয়া সরকার সরবরাহ করবে। এই কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় যে বর্জ্য তা রাশিয়া ফেরত নেবে। পারমানবিক কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আগামী বছর থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রশিণ শুর“ হবে। আগামী সপ্তাহে (৬ থেকে ১১ নভে¤^র) আইএইএ এর একটি শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এই প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সফর করবে।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চুক্তির পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারে সংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে বিজ্ঞান প্রতিমন্ত্রী, রাশিয়ার এটমিট কমিশনের মহাপরিচালক, পররাস্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস, বিজ্ঞান সচিব আব্দুর রব হাওলাদারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞান প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বর্তমান সরকার তার মেয়াদেই এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাই। পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে রূপপুরে সম্ভাব্য সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে রাশিয়ান এটমিক কমিশনের মহাপরিচালক কিরিয়েনেকো বলেন, এ চুক্তির আওতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ, বর্জ্য ফিরিয়ে নেয়া, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অর্থায়ন, আইনি কাঠামো তৈরি করা এবং নির্মাণ কাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা দেবে। তিনি বলেন, জাপানের ফুকোশিমা দুর্ঘটনার পর নতুন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমরা নতুন নকশায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। এতে পাঁচটি নতুন ব্যবস্থা যোগ করা হবে। যাতে ঠান্ডা হওয়ার উন্নত ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে উচ্চমাত্রার ভ‚মিকম্পন সহনশীল ব্যবস্থা। সম্ভাব্য খরচ বের করতে হলে আরো সময় নিয়ে কিছু কারিগরি দিক চ‚ড়াš— করতে হবে বলে তিনি জানান। রাশিয়ান সরকার কেন্দ্রটি স্থাপনে ঋণ দেবে। অর্থায়ন নিয়ে পরে চুক্তি হবে। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার নকশাতেই এ কেন্দ্র হবে। রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশে ২৯টি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। একই নকশা এখানেও হবে।
পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস বলেন, সরকার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এই নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশ বিজ্ঞানমন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি কমিশন গঠন করবে যারা এই কেন্দ্র রাশিয়ার সাথে পরিচালনা করবে। রাশিয়ার পক্ষে সে দেশের অটোমস্ট্রয়এক্সপোর্ট কন্ট্রাকটর হিসেবে এবং বাংলাদেশের পক্ষে বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন কাস্টমার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা জ্বালানি ইউরেনিয়াম - ২৩৫ এর পরিমান প্রচলিত প্রচলিত জ্বালানি যেমন কয়লা বা ডিজেলের তুলনায় অনেরক কম। তিন টন কয়লা বা দুই দশমিক ছয় টন তেল পুড়িয়ে যে শক্তি হবে এক গ্রাম ইউরেনিয়াম থেকে সেই শক্তি পাওয়া যাবে। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি খরচ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রর খরচের এক তৃতীয়াংশ আর গ্যাস ভিত্তিক কেন্দ্রের এক পঞ্চমাংশ। এই কেন্দ্র স্থাপন করলে তার খরচ ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে উঠে আসে। বিশ্বে প্রচলিত জ্বালানির চেয়ে পরমানুর জ্বালানির মজুদ অনেক বেশি।
জাপানে পরমানুতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হয় প্রতি ইউনিট ৪ ডলার ৮০ সেন্ট। জাপানে কয়লায় খরচ হয় ৪ ডলার৯৫ সেন্ট ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। কোরিয়ায় পরমানুতে ২ডলার ৩৪ সেন্ট, কয়লায়২ ডলার ১৬ সেন্ট ও গ্যাসে৪ ডলার৬৫ সেন্ট। ফ্রান্সে পরমানুতে ২ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় ৩ ডলার ৩৩ সেন্ট ও গ্যাসে ৩ ডলার ৯২ সেন্ট।
২০০৭ সালের জুন মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোতি দেয়। আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত আটটি উন্নয়নশীল দেশকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোতি দিয়েছে জাতিসংঘ। তারমধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। সে সময় জাতী সংঘের আইএইএ বিভাগের দুজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসেন। তারা কারিগরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করার আশ্বাস দেন। যে কোন দেশ ইচ্ছে করলেই পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে না। এজন্য জাতীসংঘের অনুমোদন লাগে।
বাংলাদেশের উত্তরে রূপপুরে পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ১৯৬১ সালে জমি ইজারা নিয়ে রাখা হয়েছিল। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর্ন্তজাতিকসহ বিভিন্ন কারণে এই প্রকল্প এতদিন আগায়নি। কয়েকবার কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীার পর ১৯৬৩ সালে পাবনার রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে ২৬০ একর বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য এবং ৩২ একর আবাসিক এলাকার জন্য রাখা হয়। ১৯৮০ সালে ১২৫ মেগাওয়াট মতার পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। পরে ১৯৯৯ সালে সরকার রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্রটি ৬০০ মেগাওয়াট করার প্রতিশ্রæতি দেয়। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার এই রূপপুর প্রকল্পটিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউকিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্লান্টের সঙ্গে যুক্ত করে এবং এটি উন্নয়নের জন্য ২০০৫ সালে চীনের নিউকিয়ার করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনি প্রতিশ্রæতিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে ২০০৯ সালের ১৩ই মে একটি সমঝোতা স্মারক এবং ২১শে মে রূপরেখা চুক্তি ¯^ারিত হয়। এ বছরের পহেলা অগাস্ট মন্ত্রীসভা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করে। ৩ শে অক্টোবর অনুমোদন করা হয় নিরাপত্তা ও আইনি রূপরেখা উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ