নানামুখী সমস্যার কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরাজ করছে টালমাটাল অবস্থা। এক সঙ্কট না কাটতেই আবির্ভূত হচ্ছে আরেক বিপদ। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম দিকে অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখা গেলেও এখন অর্থনীতির সূচকগুলো ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। দুর্বল অবকাঠামো, বিনিয়োগ সঙ্কোচন, উৎপাদনশীল খাতে প্রতিবন্ধকতা, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট, বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অর্থনীতি চরম অস্থিরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে এতদিন ইতিবাচক প্রচার চালালেও এখন সরকার নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। চলমান সঙ্কট মোকাবেলায় জ্বালানি তেলের মূল্য আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কিছুটা কমলেও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সঙ্কটকে তা আরও ঘনীভূত করবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তাঁদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে কৃষি উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে। আর এর ফলে বাড়বে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসাবাণিজ্যের পরিচালন ব্যয়। এ সবকিছুর সামগ্রিক ফল গিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য, যাতায়াত খরচসহ জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। এমনিতেই দেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির যে হার তা ইতোমধ্যে বিশ্বের গড় হারের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে। মূলত বেশি দামে জ্বালানি তেল আমদানি করে কম দামে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে (রেন্টাল পাওয়ার) সরবরাহ করতে গিয়েই সরকার বিপাকে পড়েছে। মোট আমদানি ব্যয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে জ্বালানি তেল আমদানিতে। খাদ্য আমদানি কমলেও জ্বালানি তেল আমদানি বেড়েই চলেছে। এজন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে, আবার জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে সরকারের অর্থ সঙ্কট বাড়ছে। ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, কমছে বেসরকারী খাতের ঋণ গ্রহণের সুযোগ।
অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রম্নত হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে সরকারের কৌশল প্রয়োগের সুযোগ কমে গেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার জন্য সরকার তাদের দেয়া নানা শর্তের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী হয়ে গেছে। এ কারণে সঙ্কট মোকাবেলায় দেশের বাসত্মব পরিস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, "অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও বর্তমানে বেশকিছু মৌলিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো মূল্যস্ফীতি। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রম্নত অবমূল্যায়ন ঘটছে। আবার ভর্তুকি কমাতে গিয়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। সরকারের কাছে হয়ত-বা এর বিকল্প ছিল না। কিন্তু এর যে প্রভাব পড়বে তা বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকা-কে চাপে ফেলবে। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি অন্যান্য দেশের মতো নয়। আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা এখনও আমদানিনির্ভর। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে অর্থনীতি বেশ চাপের মুখে রয়েছে।"
বিশেস্নষকদের মতে, গত সরকারের আমল থেকে শুরম্ন হওয়া তীব্র বিদু্যত সঙ্কট, গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তা, পুঁজিবাজারের নিম্নগতি, বৈদেশিক বিনিয়োগের সিংহভাগ মুনাফা হিসেবে ফেরত চলে যাওয়া, শিল্প খাতে পুঁজিপ্রবাহ হ্রাস, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এসব প্রবণতা মুদ্রাস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলায় সাধারণ মানুষের আয়-ব্যয়ের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বড় রকমের পার্থক্য। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি করে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। তবে এ সিদ্ধানত্ম অর্থনীতির মন্দা দূর করতে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে_ এ প্রশ্নও এখন বড় হয়ে উঠছে। কারণ ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে দেখা দিয়েছে মন্দার আশঙ্কা। এর প্রভাবে রফতানি আয়, জনশক্তি রফতানি, রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নানামুখী সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। রফতানি আয়েও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রম্নত অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির মতো অবস্থা তৈরি না হলে প্রবৃদ্ধির এ হারই হতে পারত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিদর্শন। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার উর্ধমুখী হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত সঙ্কটগুলোর কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। অনেক দিন ধরেই মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছে। পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় দারিদ্র্য বাড়ছে। ফলে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার মতো কোন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না।
সরকারের রাজস্ব আদায় এবং রফতানি আয় বাড়লেও সেই তুলনায় বেড়েছে ব্যয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকার ঋণ নিতে না পারায় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। এতে বেসরকারী খাতের সঙ্গে সরকারের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। গত বছর সরকার একই সময়ে ঋণ গ্রহণ করেছিল ১ হাজার ১শ' কোটি টাকা। মূলত ভাড়াভিত্তিক বিদু্যত কেন্ত্রগুলোতে (রেন্টাল পাওয়ার পস্ন্যান্ট) ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে গিয়েই সরকার সঙ্কটে পড়েছে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে এ কারণেই।
ঋণ করে সরকার সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি চরম সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের মতে, সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি আরও ব্যাপক হারে বাড়বে। বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় কমবে। এর ফলে বাজারে চরম সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় পণ্য বিক্রি ও সঞ্চয় কমে যাবে। সরকার বেশি ঋণ করায় বেসরকারী খাতে ঋণের যোগান কমে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে এবং বাজার থেকে টাকা তুলতে না পারলে পণ্যমূল্যে সেটা প্রভাব ফেলে। ফলে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি হবে। এতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রকৃত সম্ভাবনার তুলনায় কমে যাবে। শুধু তাই নয়, তেলের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ শতাংশের কাছাকাছি পেঁৗছে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার তুলনায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ অবস্থায় সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে অর্থনীতিতে চরম সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
দেশের আর্থিক খাতে গত কয়েক মাস ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যাংকিং খাতে অব্যাহত তারল্য সঙ্কটই এর মূল কারণ। পর্যাপ্ত তারল্য বা নগদ অর্থ না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংক নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিশেষ করে তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের সমস্যায় রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের ঋণ গ্রহণ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বড় ধরনের অর্থ সঙ্কটে পড়েছে।
অন্যদিকে আর্থিক খাতের আরেক অঙ্গ পুঁজিবাজারে প্রায় এক বছর ধরে মহামন্দা বিরাজ করছে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যনত্ম ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক পড়েছে ৪২৬৯ পয়েন্ট। একই সময়ের মধ্যে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩২৫০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানির শেয়ারের দর ও আয়ের (পিই) অনুপাতের গড় ছিল ১৪.৫১। বাজারের উর্ধগতির ফলে ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছে পিই অনুপাত ২৯.১৬-এ উঠে যায়। সেখানে দর কমতে কমতে সর্বশেষ হিসাবে অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৩-এর কাছাকাছি। সেই হিসাবে বলা যায়, ২০০৯-১০ সালে ব্যাপকভাবে ফুলেফেপে ওঠা শেয়ারবাজার এখন ২০০৬-এর পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সরকারের আর্থিক সঙ্কটের আরেকটি বড় কারণ প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণ না পাওয়া। সাধারণত বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক ও অভ্যনত্মরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার বিদেশী ঋণ পাওয়ার লৰ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। এর মধ্যে আগে নেয়া ঋণ ও তার সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-অগাস্ট) যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ-সহায়তা এসেছে, আগে নেয়া ঋণ ও সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে তার চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত আইএমএফের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে সরকার তাদের শর্ত পূরণের জন্য জ্বালানি তেলের ওপর দেয়া ভর্তুকি কমিয়ে দিচ্ছে। ঋণ দেয়ার ৰেত্রে এ সংস্থাটি যে ৭টি শর্ত দিয়েছে তার অন্যতম হলো ভর্তুকি কমিয়ে দেয়া। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে ভর্তুকি হ্রাসের কোন কারণ নেই। ভর্তুকি কমাতে গিয়ে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে। এমনকি পরোৰভাবে বাড়ি ভাড়া, পরিবহন ব্যয়_ এমনকি রিঙ্া ভাড়া পর্যনত্ম বেড়ে যাবে। এ ব্যয় বৃদ্ধির সামগ্রিক চাপ পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর। দেশের রফতানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আনত্মর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের প্রতিযোগিতা সৰমতা কমে যাবে। রফতানি আয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে ভর্তুকি না কমিয়ে সরকারের উচিত বিকল্প উৎস থেকে অর্থসংস্থানের চেষ্টা চালানো।
এদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের ৰেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ধারবাহিকভাবে বাড়ছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ ঘাটতির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুই মাসে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ শুধু সেপ্টেম্বর মাসে ঘাটতি বেড়েছে ১৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ভারসাম্য ও রিজার্ভের ওপর চাপ মোকাবেলার পথ হচ্ছে প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) ও রফতানি আয় বাড়ানো। কিন্তু ইউরোপে ঋণ সঙ্কট আর মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সে পথে বাধা সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। প্রধান দশটি রফতানিকারক দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স। এর মধ্যে ইতালি ও গ্রিসে ঋণ সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। ইউরোপের এ সঙ্কট বাংলাদেশের রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রফView this link তানি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আনত্মর্জাতিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, বাহরাইন ও সিরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স আয় কমে গেছে আগের মাসের চেয়ে। সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স এসেছে ৮৪ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। গত আগস্ট মাসে এ খাতে এসেছিল ১১০ কোটি ১৭ লাখ ডলার। সে হিসাবে রেমিটেন্স এক মাসে কম এসেছে ২৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে এফবিসিআইর উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে সৃষ্ট মন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। কারণ নানা দিক থেকেই আমাদের অর্থনীতি এসব দেশের ওপর বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রথমত, আমাদের প্রধান প্রধান রফতানি খাতের বাজার মূলত ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ওইসব দেশে সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতা দ্রম্নত কমে যাচ্ছে। ফলে আমাদের রফতানি পণ্যের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরজুড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রার মূল্যমান নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান প্রেৰাপটে ইউরোর ৰেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে। ইউরো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে। এতে আনত্মর্জাতিক বাণিজ্যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমাদের আনত্মর্জাতিক বাণিজ্য বেশিরভাগই ডলারনির্ভর। এরপর রয়েছে ইউরোর অবস্থান। ফলে এ দু'টি মুদ্রা সঙ্কটে পড়লে আমাদের আমদানি-রফতানি, রিজার্ভসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা তৈরি হবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাদের প্রচুর সংখ্যক লোক রয়েছে। মন্দার প্রভাবে তাদের আয় কমে যাবে। এর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে নানা দিক থেকে পড়বে। রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৯৬৪ কোটি ডলরে। গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম রিজার্ভের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। রিজার্ভের নিম্নগতির পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে কমছে টাকার মান। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই প্রায় ৮ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে টাকা। গত জুনে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৭৪ টাকা ৭০ পয়সা। নবেম্বরে এসে আনত্মঃব্যাংক ডলার বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ৭৬ টাকা ৬৫ পয়সা। অন্যদিকে কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার ৭৯ টাকা ১০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৯ টাকা ৭০ পয়সা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, জাতীয় অর্থনীতিকে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে দূরদর্শিতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। অর্থর্নীতির এ কঠিন সময় মোকাবেলায় ঋণ নেয়ার প্রবণতা হ্রাস, টাকা ও ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় হ্রাস, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, ঋণ ও আমানতে সুদের ব্যবধান কমিয়ে আনাসহ কার্যকর পদৰেপ গ্রহণ করা জরম্নরী। এর সঙ্গে শিল্প বিকাশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারলে বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করা সম্ভব।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে এতদিন ইতিবাচক প্রচার চালালেও এখন সরকার নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। চলমান সঙ্কট মোকাবেলায় জ্বালানি তেলের মূল্য আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কিছুটা কমলেও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সঙ্কটকে তা আরও ঘনীভূত করবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তাঁদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে কৃষি উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে। আর এর ফলে বাড়বে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসাবাণিজ্যের পরিচালন ব্যয়। এ সবকিছুর সামগ্রিক ফল গিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য, যাতায়াত খরচসহ জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। এমনিতেই দেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির যে হার তা ইতোমধ্যে বিশ্বের গড় হারের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে। মূলত বেশি দামে জ্বালানি তেল আমদানি করে কম দামে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে (রেন্টাল পাওয়ার) সরবরাহ করতে গিয়েই সরকার বিপাকে পড়েছে। মোট আমদানি ব্যয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে জ্বালানি তেল আমদানিতে। খাদ্য আমদানি কমলেও জ্বালানি তেল আমদানি বেড়েই চলেছে। এজন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে, আবার জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে সরকারের অর্থ সঙ্কট বাড়ছে। ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, কমছে বেসরকারী খাতের ঋণ গ্রহণের সুযোগ।
অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রম্নত হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে সরকারের কৌশল প্রয়োগের সুযোগ কমে গেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার জন্য সরকার তাদের দেয়া নানা শর্তের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী হয়ে গেছে। এ কারণে সঙ্কট মোকাবেলায় দেশের বাসত্মব পরিস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, "অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও বর্তমানে বেশকিছু মৌলিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো মূল্যস্ফীতি। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রম্নত অবমূল্যায়ন ঘটছে। আবার ভর্তুকি কমাতে গিয়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। সরকারের কাছে হয়ত-বা এর বিকল্প ছিল না। কিন্তু এর যে প্রভাব পড়বে তা বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকা-কে চাপে ফেলবে। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি অন্যান্য দেশের মতো নয়। আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা এখনও আমদানিনির্ভর। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে অর্থনীতি বেশ চাপের মুখে রয়েছে।"
বিশেস্নষকদের মতে, গত সরকারের আমল থেকে শুরম্ন হওয়া তীব্র বিদু্যত সঙ্কট, গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তা, পুঁজিবাজারের নিম্নগতি, বৈদেশিক বিনিয়োগের সিংহভাগ মুনাফা হিসেবে ফেরত চলে যাওয়া, শিল্প খাতে পুঁজিপ্রবাহ হ্রাস, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এসব প্রবণতা মুদ্রাস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলায় সাধারণ মানুষের আয়-ব্যয়ের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বড় রকমের পার্থক্য। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি করে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। তবে এ সিদ্ধানত্ম অর্থনীতির মন্দা দূর করতে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে_ এ প্রশ্নও এখন বড় হয়ে উঠছে। কারণ ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে দেখা দিয়েছে মন্দার আশঙ্কা। এর প্রভাবে রফতানি আয়, জনশক্তি রফতানি, রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নানামুখী সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। রফতানি আয়েও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রম্নত অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির মতো অবস্থা তৈরি না হলে প্রবৃদ্ধির এ হারই হতে পারত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিদর্শন। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার উর্ধমুখী হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত সঙ্কটগুলোর কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। অনেক দিন ধরেই মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছে। পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় দারিদ্র্য বাড়ছে। ফলে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার মতো কোন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না।
সরকারের রাজস্ব আদায় এবং রফতানি আয় বাড়লেও সেই তুলনায় বেড়েছে ব্যয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকার ঋণ নিতে না পারায় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। এতে বেসরকারী খাতের সঙ্গে সরকারের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। গত বছর সরকার একই সময়ে ঋণ গ্রহণ করেছিল ১ হাজার ১শ' কোটি টাকা। মূলত ভাড়াভিত্তিক বিদু্যত কেন্ত্রগুলোতে (রেন্টাল পাওয়ার পস্ন্যান্ট) ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে গিয়েই সরকার সঙ্কটে পড়েছে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে এ কারণেই।
ঋণ করে সরকার সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি চরম সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের মতে, সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি আরও ব্যাপক হারে বাড়বে। বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় কমবে। এর ফলে বাজারে চরম সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় পণ্য বিক্রি ও সঞ্চয় কমে যাবে। সরকার বেশি ঋণ করায় বেসরকারী খাতে ঋণের যোগান কমে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে এবং বাজার থেকে টাকা তুলতে না পারলে পণ্যমূল্যে সেটা প্রভাব ফেলে। ফলে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি হবে। এতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রকৃত সম্ভাবনার তুলনায় কমে যাবে। শুধু তাই নয়, তেলের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ শতাংশের কাছাকাছি পেঁৗছে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার তুলনায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ অবস্থায় সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে অর্থনীতিতে চরম সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
দেশের আর্থিক খাতে গত কয়েক মাস ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যাংকিং খাতে অব্যাহত তারল্য সঙ্কটই এর মূল কারণ। পর্যাপ্ত তারল্য বা নগদ অর্থ না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংক নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিশেষ করে তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের সমস্যায় রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের ঋণ গ্রহণ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বড় ধরনের অর্থ সঙ্কটে পড়েছে।
অন্যদিকে আর্থিক খাতের আরেক অঙ্গ পুঁজিবাজারে প্রায় এক বছর ধরে মহামন্দা বিরাজ করছে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যনত্ম ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক পড়েছে ৪২৬৯ পয়েন্ট। একই সময়ের মধ্যে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩২৫০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানির শেয়ারের দর ও আয়ের (পিই) অনুপাতের গড় ছিল ১৪.৫১। বাজারের উর্ধগতির ফলে ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছে পিই অনুপাত ২৯.১৬-এ উঠে যায়। সেখানে দর কমতে কমতে সর্বশেষ হিসাবে অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৩-এর কাছাকাছি। সেই হিসাবে বলা যায়, ২০০৯-১০ সালে ব্যাপকভাবে ফুলেফেপে ওঠা শেয়ারবাজার এখন ২০০৬-এর পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সরকারের আর্থিক সঙ্কটের আরেকটি বড় কারণ প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণ না পাওয়া। সাধারণত বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক ও অভ্যনত্মরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার বিদেশী ঋণ পাওয়ার লৰ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। এর মধ্যে আগে নেয়া ঋণ ও তার সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-অগাস্ট) যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ-সহায়তা এসেছে, আগে নেয়া ঋণ ও সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে তার চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত আইএমএফের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে সরকার তাদের শর্ত পূরণের জন্য জ্বালানি তেলের ওপর দেয়া ভর্তুকি কমিয়ে দিচ্ছে। ঋণ দেয়ার ৰেত্রে এ সংস্থাটি যে ৭টি শর্ত দিয়েছে তার অন্যতম হলো ভর্তুকি কমিয়ে দেয়া। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে ভর্তুকি হ্রাসের কোন কারণ নেই। ভর্তুকি কমাতে গিয়ে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে। এমনকি পরোৰভাবে বাড়ি ভাড়া, পরিবহন ব্যয়_ এমনকি রিঙ্া ভাড়া পর্যনত্ম বেড়ে যাবে। এ ব্যয় বৃদ্ধির সামগ্রিক চাপ পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর। দেশের রফতানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আনত্মর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের প্রতিযোগিতা সৰমতা কমে যাবে। রফতানি আয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে ভর্তুকি না কমিয়ে সরকারের উচিত বিকল্প উৎস থেকে অর্থসংস্থানের চেষ্টা চালানো।
এদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের ৰেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ধারবাহিকভাবে বাড়ছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ ঘাটতির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুই মাসে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ শুধু সেপ্টেম্বর মাসে ঘাটতি বেড়েছে ১৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ভারসাম্য ও রিজার্ভের ওপর চাপ মোকাবেলার পথ হচ্ছে প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) ও রফতানি আয় বাড়ানো। কিন্তু ইউরোপে ঋণ সঙ্কট আর মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সে পথে বাধা সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। প্রধান দশটি রফতানিকারক দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স। এর মধ্যে ইতালি ও গ্রিসে ঋণ সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। ইউরোপের এ সঙ্কট বাংলাদেশের রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রফView this link তানি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আনত্মর্জাতিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, বাহরাইন ও সিরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স আয় কমে গেছে আগের মাসের চেয়ে। সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স এসেছে ৮৪ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। গত আগস্ট মাসে এ খাতে এসেছিল ১১০ কোটি ১৭ লাখ ডলার। সে হিসাবে রেমিটেন্স এক মাসে কম এসেছে ২৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে এফবিসিআইর উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে সৃষ্ট মন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। কারণ নানা দিক থেকেই আমাদের অর্থনীতি এসব দেশের ওপর বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রথমত, আমাদের প্রধান প্রধান রফতানি খাতের বাজার মূলত ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ওইসব দেশে সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতা দ্রম্নত কমে যাচ্ছে। ফলে আমাদের রফতানি পণ্যের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরজুড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রার মূল্যমান নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান প্রেৰাপটে ইউরোর ৰেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে। ইউরো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে। এতে আনত্মর্জাতিক বাণিজ্যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমাদের আনত্মর্জাতিক বাণিজ্য বেশিরভাগই ডলারনির্ভর। এরপর রয়েছে ইউরোর অবস্থান। ফলে এ দু'টি মুদ্রা সঙ্কটে পড়লে আমাদের আমদানি-রফতানি, রিজার্ভসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা তৈরি হবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাদের প্রচুর সংখ্যক লোক রয়েছে। মন্দার প্রভাবে তাদের আয় কমে যাবে। এর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে নানা দিক থেকে পড়বে। রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৯৬৪ কোটি ডলরে। গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম রিজার্ভের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। রিজার্ভের নিম্নগতির পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে কমছে টাকার মান। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই প্রায় ৮ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে টাকা। গত জুনে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৭৪ টাকা ৭০ পয়সা। নবেম্বরে এসে আনত্মঃব্যাংক ডলার বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ৭৬ টাকা ৬৫ পয়সা। অন্যদিকে কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার ৭৯ টাকা ১০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৯ টাকা ৭০ পয়সা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, জাতীয় অর্থনীতিকে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে দূরদর্শিতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। অর্থর্নীতির এ কঠিন সময় মোকাবেলায় ঋণ নেয়ার প্রবণতা হ্রাস, টাকা ও ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় হ্রাস, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, ঋণ ও আমানতে সুদের ব্যবধান কমিয়ে আনাসহ কার্যকর পদৰেপ গ্রহণ করা জরম্নরী। এর সঙ্গে শিল্প বিকাশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারলে বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করা সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন