মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১১

আমেরিকার অন্য চিত্র : দারিদ্রতা এবং বেকারত্বে ম্লান এক আমেরিকা



মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি এলাকার একটি রাস্তার পাশে মানুষের লম্বা লাইন। তারা দাঁড়িয়ে আছে সরকারিভাবে খাদ্য বিতরণকারী একটি অফিসের সামনে। সেখানে অশিতীপর বৃদ্ধ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বেকার যুবকরাও। স্বামীহীন মহিলারাও আছেন সঙ্গে তাদের বাচ্চা নিয়ে। এ অফিস থেকে তারা কম মূল্যে রেশনিংয়ের মাধ্যমে খাবার সংগ্রহ করছেন। কারণ, বৈশ্বিক মন্দা এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে আমেরিকার অনেকেরই শপিং মল বা চেইন শপে গিয়ে বাজার করার সামর্থ্য নেই এবং এটিই বাস্তবতা।
এটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র কবলিত এলাকাগুলোর একটি সাধারণ দৃশ্য। সে দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অতি সম্প্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে দেশটির ক্রমবর্ধমান দারিদ্রতা এবং খাদ্য ঘাটতির ভয়াবহ চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৬.২ মিলিয়ন আমেরিকান বর্তমানে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এদের মধ্যে ২.৬ মিলিয়ন নাগরিক গত এক বছরে নতুন করে দারিদ্রতার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। 
১৯৫৯ সালে পরিসংখ্যান প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ৫২ বছরের মধ্যে এটিই আমেরিকার সর্বোচ্চসংখ্যক নাগরিকের দারিদ্রসীমার নিচে অবনমন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেকারত্বের অভিশাপ। ১৪ মিলিয়ন বেকার নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে দেশটির অর্থনীতিকে, যারা মোট জনসংখ্যার ৯.১ শতাংশ। 
কাজ নেই কোথাও, বৈশ্বিক মন্দার অজুহাতে নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে না কোনো কল-কারখানা বা অফিস-আদালতে। যুবকরা কাজ না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে দিন দিন। চাকরি না থাকার কারণে আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে বিবাহবিচ্ছেদ। কাজ না থাকায় অনেকে পা বাড়াচ্ছেন অন্ধকার জগতের দিকে। ফলে সামাজিক সমস্যাগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ফের।
‘এখানে, আমেরিকায় কাজটিই আসল। আমেরিকায় যদি তোমার একটি চাকরি না থাকে তবে তোমার আত্মসম্মান বলতে কিছুই থাকবে না।’ এভাবেই বেকারত্বের অমার্জনীয় প্রভাব নিয়ে বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ এন্ড পভার্টি’র পরিচালক টিমোথি স্মিডিং। ‘আমি যুবকদের নিয়ে শঙ্কিত। বিশেষ করে কলেজ পর্যায়ের ছাত্রদের নিয়ে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য কাজ চাই। তা নইলে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। আপনাকে বুঝতে হবে, সমস্যাটির গ্রাসে প্রভাবিত যুবকশ্রেণী। আর এদের দ্বারাই পরিচালিত হয় একটি জাতি। বিবেচিত হবে তাদের ভবিষ্যত; তাদের উত্থান ঘটবে নাকি পতন।’
আমেরিকায় খাদ্যসঙ্কট প্রসঙ্গে বলছিলেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের গবেষক মার্ক নর্ড। যিনি সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত খাদ্যসঙ্কটের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনের একজন সহকারী সমন্বয়ক ছিলেনÑ ‘আমেরিকায় খাদ্য ঘাটতি মানে এই নয় যে, আমেরিকায় পর্যাপ্ত খাদ্য নেই বরং এর অর্থ হলো, নাগরিকদের পর্যাপ্ত সামর্থ্য নেই খাদ্য সংগ্রহ করার। ১৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। এদের এক তৃতীয়াংশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। গ্রাম এবং শহরতলীর কিছু অঞ্চলকে ধরা হচ্ছে ‘খাদ্য মরুভূমি’ হিসেবে। যেখানে খাবার সংগ্রহ করার মতো বাজার বা সুপার মার্কেট নেই।’
যেসব অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার সংগ্রহ করার সামর্থ্য নেই তাদের জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে কমমূল্যে খাদ্য সংস্থান কর্মসূচি। এসব কর্মসূচি অধিকতর দারিদ্র্য এলাকায় রেশনিংয়ের মাধ্যমে খাবার বিতরণ করছে।
টেনেসিতে এমনই একটি কর্মসূচিতে কর্মরত আছেন মার্সিয়া ওয়েলস। তিনি খাবার বিতরণে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘সম্প্রতি আমি একটি খাদ্য বিতরণকারী সেবা সংগঠনে কাজ করছিলাম। সেখানে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় এমন একজন নারীর সঙ্গে যিনি খাদ্য সামগ্রী নিতে এসেছিলেন তার বড় দুই সন্তানকে নিয়ে। তিনি ১২০ ডলার মূল্যমানের ‘ফুড স্ট্যাম্প’ (সরকার কর্তৃক প্রদত্ত খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহের রসিদ) সংগ্রহ করেন এবং জানান, তাকে পুরো মাস এটা দিয়েই চলতে হবে। যদিও তিনি জানেন, মাস শেষ হওয়ার আগেই তার রসিদের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে।
তিনি আমাদের খাদ্যভাণ্ডারে মাংস দেখে খুশি হয়েছিলেন কিন্তু তিনি তা কিনতে পারলেন না। কারণ, মাংস কেনা অনেক টাকার ব্যাপার। এতে তার রসিদের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। অনেক বয়স্ক লোকই খাবার এবং ঔষধ কেনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে সক্ষম হন না।’
খাদ্য সংগ্রহের এ নাজুক অবস্থা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিকদের মধ্যে ২.৫ গুণ বেশি। যদিও দারিদ্রতা বর্ণবাদকে কটাক্ষ করে দেখা দেয়নি তবুও দারিদ্রতাকে আপনি অন্যকিছুর সঙ্গে তুলনা করতে পারেন না। 
দারিদ্রতার এই পরিসংখ্যান এবং বাস্তব চিত্র দেখে আপনি ভুলেও কল্পনা করতে যাবেন না দিল্লির কোনো বস্তির খণ্ডিত চিত্র। এমন দুঃসহ বিষয় কল্পনা করলে শুধু শুধু আপনার মস্তিষ্কের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না। আপনাকে মনে রাখতে হবে, এটি আমেরিকা এবং তারা একটি লৌকিক ‘লাইফস্টাইল’ নিয়ে বেঁচে থাকতে পছন্দ করে। তাদের ঘরে খাবার না থাকলেও তারা কখনো পার্লারে যেতে ভুল করে না।
কনজারভেটিভ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদন জানাচ্ছে, খাদ্য সঙ্কটে পতিত ৮০ শতাংশ পরিবার এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করে, ৯২ শতাংশের ঘরে মাইক্রোওভেন রয়েছে এবং ৪২ শতাংশ নিজেদের বাড়িতেই বসবাস করে। এক তৃতীয়াংশ দরিদ্র পরিবারের এলসিডি টিভি রয়েছে এবং দুই তৃতীয়াংশের বাড়িতে রয়েছে ডিভিডি প্লেয়ার। সুতরাং আমেরিকান দারিদ্রতা তৃতীয় বিশ্বের ক্লিষ্টতার সঙ্গে তুল্য নয়।
গবেষক টিমোথি স্মিডিং এই গবেষণা-প্রবণতাকে উপহাস করে বলেন, ‘আমি মনে করি হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দুজন কর্মকর্তা লাঞ্চের সময় একটি ডিভিডি সমপরিমাণ মূল্যের চেয়ে বেশি ব্যয়ে লাঞ্চ করেন। আপনাকে বুঝতে হবে, কিছু জিনিস মানুষের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এগুলো দিয়ে আপনি দারিদ্রের মানদণ্ড বিচার করতে পারেন না।’
আমেরিকান সরকার এই দারিদ্র কবলিত নাগরিকদের জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। স্বাস্থ্যবিমা তার একটি। কিন্তু রাজনীতির মুখরোচক বুলি যতোটা সহজে ওবামা প্রশাসন ঘোষণা করতে পারে বাস্তবায়ন ততোটা সহজ নয়। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা পুরো বিশ্বজুড়ে লড়াই করে চলেছে। ইরাক আর আফগানিস্তানে তারা প্রতিদিন ব্যয় করছে কয়েক কোটি ডলার। এগুলো প্রত্যক্ষচোখে দেখা যায়। কিন্তু সারা বিশ্বজুড়ে তারা যে অধিপত্য বিস্তারের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেটিও কম খরুচে নয়। এগুলো দৃষ্টির প্রচ্ছন্নতায় লুকিয়ে থাকে। ট্যাকটিক্যাল এবং ট্যাকনিক্যালÑ উভয়ভাবেই। সুতরাং বিলিয়ন ডলারের নতুন স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের স্বদিচ্ছা কেবল রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার হতে পারে দারিদ্র বিমোচনে তা ফলপ্রসু হওয়া খানিকটা দুর্লভই বটে।
ড. অ্যাডামস গত বছর টেনেসির অধিকতর দারিদ্র কবলিত এলাকায় একটি অলাভজনক চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণ করেছেন। তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার এই স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসা কেন্দ্রে এলাকার রোগীদের অন্যান্য সাধারণ হাসপাতালের চেয়ে নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে।
ড. অ্যাডামস বলেন, ‘২০১০ সালে প্রায় ৫ কোটি মানুষের কোনো স্বাস্থ্যবিমা ছিল না। এ এক বছরে সে সংখ্যা আরো বেড়েছে। এবং তাদের অধিকাংশের বয়সই ৬৫ বছরের নিচে, যে বয়স সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিমা পাওয়ার জন্য আবশ্যক। স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা পূর্ণবয়স্ক এবং কর্মক্ষম দরিদ্রদের জন্য সীমিত অথচ তারা যখন সেটি পাওয়ার আশা করে তখন তা সুদূর পরাহত, অনেক দেরি হয়ে যায়। যখন এটি আর কোনো কাজেই লাগে না।’ 
তিনি আরো বলেন, ‘৫৮ বছর বয়স্ক ডরিস এবং তার স্বামী মিলে একটি রেস্তোরাঁ চালাতেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার ফলে এটি বন্ধ করার আগ পর্যন্ত বছরে তাদের লাভ আসতো ১৩,০০০ ডলার। তাদের কোনো স্বাস্থ্যবিমা ছিল না। ফলে তার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ার পরও তিনি কোনো চিকিৎসা নিতে পারছেন না।’
জিনা বিকোভস্কি নামের এক কর্মহীন তরুণী বলছিলেন তার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের কথা, ‘আমি তো সবসময় একটি আমেরিকান স্বপ্নই দেখতাম। যেখানে নিজের বাড়ি থাকবে, নিজের ব্যবসা থাকবে, থাকবে গাড়ি এবং জীবনকে সহজ করে নেবার যাবতীয় উপকরণ। কিন্তু এখন আমি ভাবি, আমার সে সামর্থ্য নেই এমনকি আমি এখন সে ধরনের স্বপ্নও দেখতে পারি না।
জিনার হবু বর জন হেরিক একটি খণ্ডকালীন চাকরি করেন এবং তার কোনো স্বাস্থ্যবিমা করা নেই। অথচ তার রয়েছে মারাত্মক মৃগীরোগ। প্রতিমাসে তাকে চিকিৎসার জন্য একটি ভালো অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়। এ ব্যাপারে হতাশকণ্ঠে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনেক ব্যয়বহুল এবং প্রতিমাসে আমাকে এটি পরিশোধ করতে হয়। যখন আমার কাছে পরিশোধ করার মতো টাকা না থাকে আমাকে আমার দাদীর কাছ থেকে ধার নিতে হয়। ফলে প্রায়ই আমার পকেট গড়ের মাঠের মতো খা খা করে। কারণ আমাকে চিকিৎসকের সম্মানী দিতে হয়, ঔষধ-পথ্য কিনতে হয়। সবচে বড় কথা, আমি মরতে চাই না।’
ভাবতে কষ্ট হলেও বেকার সমস্যা এবং ক্রমবর্ধমান দারিদ্রতা এভাবেই রাহুর গ্রাসের মত জেঁকে বসছে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক জীবনের ওপর। দূর থেকে দেখতে প্রাচুর্যের ভয়ঙ্করতা হয়তো চোখ ধাঁধিয়ে দেবে কিন্তু ধাঁধানো চোখ সয়ে এলেই দেখা মিলবে জিনা, হেরিক কিংবা ডরিসের মত লোকদের। 
হলিউডের ছবি আপনাকে নিত্য নতুন সব এলিয়েন আর সুপারম্যানদের গল্প শোনাবে। কখনো তারা টেনেসির দরিদ্রতম এলাকাগুলোকে নিয়ে ছবি বানাবে না। আপনার সামনে উপস্থাপিত হবে প্রায়মঙ্গলজয়ী এক আমেরিকার মুখচ্ছবি। 
নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ারের না-ঘুমানো ঝলমলে রাত অথবা লস এঞ্জেলসের বিলাসবহুল হোটেল, ক্যাসিনো হয়তো পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাবার আর চিকিৎসার জন্য কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা ছাড়া তাদেরকে জীবনের দিকে আকর্ষণ করা আদৌ সম্ভব কী-না তা বিশ্বমোড়লদের নতুন করে ভাবা উচিত।

আল জাজিরা অনলাইন এবং ভয়েস অব আমেরিকা অবলম্বনে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ