মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১১

ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুসলমান নামধারী অনেক রাষ্ট্রনায়কই ছিল কাফির ও ইসলাম বিদ্বেষী । তুরস্কের কামাল, মিশরের নাছেরের মতো ইরাকের সাদ্দামও ছিল একই পথের যাত্রী। অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা লাভের দরকার বর্তমান মুসলমানের

রূহের জগৎ আলমে আরওয়াহ। অনেক প্রতীকী ঘটনার স্থল সেটি। একটি এরূপ- ‘দেখা গেল অনেক রূহ মহান আল্লাহ পাক উনাকে সিজদা করল। আবার অনেক রূহ করল না। এরপর সিজদা দেবার ঘটনা আবারও ঘটল। এবারেও অনেকে করল অনেকে করল না। কিন্তু এ দু’বার সিজদার ঘটনায় একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেল। প্রথমবার যারা সিজদা করেছে তাদের থেকে অনেকে দ্বিতীয়বার সিজদা করেনি। আবার দ্বিতীয়বার যারা সিজদা করেছে তাদের মাঝে অনেকে প্রথমবার করেনি।’
এ ঘটনার ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাফসীরে বলা হয় যে, যারা প্রথমে সিজদা করেনি পরে করেছে তারা প্রথমে কাফির থাকলেও পরে ঈমানদার হবে। আর যারা প্রথমে সিজদা করেছে কিন্তু দ্বিতীয়বার করেনি তারা মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও, মুসলমান হিসেবে বেড়ে উঠলেও, মুসলমান নামে পরিচিতি থাকলেও পরবর্তীতে তারা মূলত ঈমান হারাবে, মুসলমান পরিচয়ে বা স্বপরিচয়ে কাট্টা কাফির হবে।
বলাবাহুল্য, এ যমীনে এর উদাহরণ একটি দুটি নয়; অগণিত, অসংখ্য। কুরআন শরীফ-এ বর্ণিত বালাম বিন বাউর ছাড়াও এর মিছদাক অনেক নামধারী শাইখুল হাদীছ, দরবেশ, মাওলানা, মুফতীরাও রয়েছে। অনেক নামধারী কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিকও রয়েছে। আবার অনেক ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রনায়কও রয়েছে। তারা তাদের জীবদ্দশায় দেশ ও পৃথিবীতে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও মূলত ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কাট্টা কাফির।
কাজেই আজকের কথিত সাদ্দাম হোসেনকে নাস্তিক্যবাদী দর্শনের প্রবক্তা এবং হারাম আমলে অভ্যস্ত তথা মদ-নারীতে আসক্তরূপে মানতে যাদের কষ্ট হয় তাদের উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমান প্রজন্ম এবং সাধারণ শিক্ষিত প্রায় সকলেই তুরস্কের ‘কামাল লা’নাতুল্লাহকে তুরস্কের জাতীয় নেতা ও কর্ণধার বলে বিশেষ মূল্যায়ন করে। কিন্তু হাক্বীক্বত ইতিহাস কী বলে? ইসলামের আলোকে তার স্থান কোন স্তরে পর্যবসিত হয়?
তা উপলব্ধির জন্য সে যে কত নিষ্ঠুরভাবে ও নির্মমভাবে ইসলাম উঠিয়ে অনৈসলামকে জারি করেছিল নিম্নে তার একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দেয়া গেল-
কামাল তার দেশের নারীদের পর্দা ত্যাগ করতে ও অভিশপ্ত বৈদেশিকদের গায়ে গা মিশিয়ে নৃত্য করতে বাধ্য করে। সে তার স্ত্রীকে খোলামুখে পুরুষের পোশাকে সর্বত্র ঘুরিয়ে বেড়াত।
১৯২৪ সালে কামাল পাশা বৃত্তি ও ওয়াক্ফ সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত করে আলিমদের অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত করে। প্রথমে বিদ্যালয়ে কয়েক ঘণ্টা কুরআন শরীফ ও ধর্মশিক্ষাদানের ব্যবস্থা রাখে। ১৯২৫ ঈসায়ীতে এ নিয়মও উঠে গেল। মুসলমান রাখতে চাইলে তখন হতে পুত্র-কন্যাদেরকে দ্বীনি ইলম শেখানোর ভার অভিভাবকদের উপর পড়ল।
কামাল সরকারের মনে হলো, প্রত্যেক দরবেশই নতুন শাসনতন্ত্রের শত্রু। দরবেশদের খানকা শরীফ ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ও কুসংস্কারের বিকাশ ক্ষেত্র, এ অজুহাতে বিপ্লবী আদালতের সুপারিশক্রমে ১৯২৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মহাসভা করে সমস্ত তেক্কা (কবর) ও তুর্বা (খানকা) বন্ধ এবং দরবেশ প্রতিষ্ঠান তারা ভেঙে দিল। শায়েখ, দরবেশ প্রভৃতি উপাধি ও তাদের রীতিনীতি গ্রহণ, এমনকি তাদের বিশিষ্ট পোশাক পরিধানও দ-নীয় বলে ঘোষিত হলো। মাদ্রাসার ওয়াকফের ন্যায় খানকা এবং কবর-মাযার দরগাহর সম্পত্তিও সাধারণ শিক্ষা খাতের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। খানকা ও তেক্কাগুলো বৈষয়িক বিদ্যালয়রূপে ব্যবহৃত হতে লাগল। ৭ই সেপ্টেম্বর আরেক আইনের দ্বারা উলামার সংখ্যা ভীষণভাবে হ্রাস করা হলো। এখন হতে কেবল ধর্ম বিভাগের সরকারি চাকুরেদেরই উলামার পাগড়ি ও পোশাক পরার অধিকার রইল। অপর কেউ এটা পরিধান করলে ফৌজদারীতে সোপর্দ হবে বলে হুকুম জারি হলো।
মুসলমানী চান্দ্র বৎসর কামালবাদীদের নিকট অসুবিধাজনক মনে হলো। ১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারা হিজরী সনের পরিবর্তে ইংরেজি আন্তর্জাতিক সময় ও পঞ্জিকা গ্রহণ করল। এর ফলে পাশ্চাত্যের সাথে পত্রাদি লিখার সুবিধা হলেও মুসলিম জগতের কিংবদন্তীর সাথে তুরস্কের একটি দৃঢ়বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল।
মূর্তি নির্মাণ সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী; তথাপি ১৯২৬ সালের ৩রা অক্টোবর ইস্তাম্বুলে কামালের মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। তুরস্কে এ দৃশ্য সর্বপ্রথম। পরের বৎসরের (১৯২৬ ঈ.)৪ঠা নভেম্বর আঙ্কারার যাদুঘরের সম্মুখে আরও একটি মূর্তি স্থাপিত হলো।
পারিবারিক আইনই ছিল ইসলামী আইনের সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ। নতুন দেওয়ানী আইন প্রবর্তিত হওয়ায় তাও বাতিল হয়ে গেল। এটা ইসলামের উপর ‘মরণ-আঘাত’ বলে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা তদপেক্ষাও গুরুতর।
রাষ্ট্র্রকে সম্পূর্ণ বৈষয়িক করার পথে আর দুটি মাত্র বাধা ছিল। ইসলাম তখনও রাজধর্ম বলে স্বীকৃত হত; একটি আলাদা ধর্মনৈতিক বিভাগেরও অস্তিত্ব ছিল। ১৯২৮ সালের ১০ এপ্রিল শাসন বিধি হতে ধর্ম সংক্রান্ত সমস্ত কথাই বাদ দেয়া হলো। ফলে ইসলাম আর তুরস্কের রাজধর্ম রইল না। পূর্বে প্রতিনিধিরা মহান আল্লাহ পাক উনার নামে হলফ নিতেন; এখন হতে নিতে আরম্ভ করলেন আত্মসম্মানের নামে। প্রত্যেক বালেগ পুরুষ ও বয়ঃপ্রাপ্তা নারী ইচ্ছানুযায়ী ধর্মান্তর করার অধিকার পেল।
৩রা অক্টোবর আরবীর বদলে ল্যাটিন বর্ণমালা গৃহীত হওয়ায় মুসলিম জগতের সাথে তুরস্কের আর একটি প্রধান বন্ধন টুটে গেল।
১৯৩৪ সালের ২৬শে নভেম্বর আর একটি আইনে সমস্ত তুর্ক তাদের বে, আগা, পাশা, হানুম, এফেন্দি প্রভৃতি আরবী-ফারসী পদবি ও আহমদ, মুস্তফা প্রভৃতি আরবী নাম বাদ দিয়ে প্রাচীন তুর্ক নাম ও উপাধি গ্রহণে আদিষ্ট হলো। প্রত্যেক তুর্ক পুরুষের পদবি হলো এখন হতে ‘রায়’ ও বিবাহিতা-অবিবাহিতা নির্বিশেষে প্রত্যেক মহিলার ‘বায়ান”। কামাল নিজে মুস্তফা নাম ও গাজী উপাধি ত্যাগ করে আতাতুর্ক (তুর্কদের জনক) ও ইসমত ইনোনু’ (ইনোনুর যুদ্ধ জয়ী) উপাধি গ্রহণ করলো। ২৪শে নভেম্বর মহাসভার এক অধিবেশনে কামাল এই নতুন উপাধিতে ভূষিত হলো।
১৯৩৫ সালে মসজিদের বাইরে ইমাম-মুফতীদের পাগড়ি ও জুব্বা পরা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। শুধু ইমামতি করার সময়ই ধর্মীয় পোশাক পরার অনুমতি মিলল।
প্রচলিত দেশীয় তথা আরবী পোশাকের নিন্দা করে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হলো, ‘আমরা হ্যাট মাথায় দিব; ইউরোপের ভ্রমণ পোশাক হতে আরম্ভ করে দরবারী পোশাক পর্যন্ত সমস্তই পরিধান করব।’ যে ইতস্তত করবে সে মূর্খ বলে অভিহিত হবে। কামাল যেখানেই গেল, সেখানেই হ্যাট তার সঙ্গে চলল; সর্বত্রই এজন্য প্রবল প্রচার কার্য চলতে লাগল।
ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তুর্কীরা আরবদের মতো পাগড়ি ব্যবহার করত। অথচ কামাল বলল, “তুরানী পোশাকের পুনরুজ্জীবিত করার দরকার নেই। সভ্য ও আন্তর্জাতিক (প্রকৃতপক্ষে জলদস্যু ও লুটেরা ইংরেজদের পোশাক) পোশাক আমাদের জন্য উপযুক্ত পোশাক, তা পরিধান করব। পায়ে জুতা, উপরে প্যান্ট, ওয়েস্ট কোট, শার্ট, টাই, কোট এবং সর্বোপরি এদের সাথে মিলিয়ে রৌদ্র প্রতিরোধক শিরস্ত্রাণ যার আসল নাম ‘হ্যাট’ তা হবে আমাদের জাতীয় পোশাক।”
কামাল সর্বপ্রথম এরূপ পোশাক পরে এনেবালো ও কাস্টমানোয় গমন করে। কামালের অনুকরণে প্রথমে সরকারি কর্মচারীরা ‘হ্যাট’ পরিধান করতে থাকে। গ্রামের জনসাধারণ ও ইসলামপন্থীগণ হ্যাট পরিধানকে ইসলাম বিরোধী মনে করলেও ১৯২৫ সালের ২৫শে নভেম্বর ফেজ ও পাগড়িকে জাতীয় পোশাক হিসেবে বাতিল এবং হ্যাটসহ ইউরোপীয় পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করে জনৈক কামালবাদী সংসদে একটি খসড়া আইন উপস্থাপন করলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়।
অতঃপর ‘হ্যাট ল’ কঠোর হস্তে প্রয়োগ করা হয় এবং যারা এই আইন অমান্য করলো তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলো। যে হ্যাট পরল না, তাকে কারাগারে নিক্ষেপ বা ফাঁসি-গাছে লটকানোর হুকুম দেয়া হলো। কামালের ভয়াবহ যন্ত্র ‘বিপ্লবী আদালত’ প্রত্যহ শত শত ধর্মপ্রাণ লোককে ধৃত, কারারুদ্ধ বা প্রাণদ-ে দ-িত করতে লাগল। এর সাথে ইসলামী সালামও উঠে গেল। এর পরিবর্তে ‘সুপ্রভাত’, ‘বিদায়’ ও হ্যান্ডশেক রেওয়াজ প্রবর্তিত হলো।
সরকারের আদেশে কুরআন শরীফ তুর্কী ভাষায় অনূদিত হলো, মসজিদে তুর্কী ভাষায় নামায পড়া এবং আযান দেয়ার প্রচলনও হলো। কামালের আমলে মক্তব-মাদ্রাসা লোপ ও ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দান বন্ধ হওয়ায় তার কাঙ্খিত ইউরোপীয় শিক্ষা বিপ্লব সম্পূর্ণ হলো। একমাত্র ইস্তাম্বুলেই ৬০০ মসজিদ ভিত্তিক বিদ্যালয় তথা মক্তব ছিল; আজ তার একটিরও অস্তিত্ব নেই।
অতএব, পাঠক! এখানেই বিবেচ্য বিষয় যে, মুসলমান নামধারী রাষ্ট্রপতিও কিভাবে ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি করতে পারে! কাজেই আজকে যারা সাদ্দামকে ইসলামবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে মানতে অপ্রস্তুত তাদের উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া এবং আরো বিশ্বাস করা যে, সাদ্দামই তার ষড়যন্ত্রের দ্বারা ইরাককে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ