শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১১

লোকমান হত্যা, চলছে অন্য খেলা, বাচ্চুর স্ত্রীর বোরকা রহস্য


লোকমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন চলছে অন্য খেলা। অভিযোগ উঠেছে হত্যাকাণ্ড থেকে ১ নং আসামি সালাউদ্দীন বাচ্চুকে বাঁচাতে কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। তাছাড়া যে কোন একজন আসামিকে রাজসাক্ষী করে বাচ্চুকে বাঁচানোর দেনদরবার চলছে। পরিকল্পনা করা হয়েছে যে, কোন আসামি খুনের সব দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবেন মন্ত্রী রাজু। বাচ্চু পলাতক থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন বাচ্চুর স্ত্রী নাসরিন আহমেদ হেনা। নিহত মেয়র লোকমানের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন নাসরিন আহমেদ হেনা এরই মধ্যে বোরকা পরে এসে একাধিকবার নরসিংদী পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেছেন। ওদিকে আসামি গ্রেপ্তার নিয়ে লুকোচুরি খেলছে পুলিশ। এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলেও তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। মতিন সরকারের গ্রেপ্তারের বিষয়টি এখনও স্বীকার করেনি পুলিশ। শুক্রবার গণমাধ্যমে মতিন সরকারকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, তিনি মতিন সরকারের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছুই জানেন না। তদন্ত সূত্র জানিয়েছে- রিমান্ডে থাকা সেলিম, টিপ্পন কাজী ও আশরাফকে কঠোর গোপনীয়তায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও চিত্র সিডি আকারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে। তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও চিত্রে মন্ত্রী রাজু ও তার ভাই বাচ্চুর হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। ওদিকে ঘটনার দিন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের আশপাশে আচমকা বিদ্যুৎ চলে যায়। ফলে লোকমানকে গুলি করে অন্ধকার গলিতে সহজেই হারিয়ে যেতে সক্ষম হয় কিলাররা। অবশ্য পল্লীবিদ্যুৎ বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সেদিন ওই এলাকায় লোডশেডিংয়ের কোন রুটিন ছিল না। রেজিস্টারেও লোডশেডিং করার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করা হয়নি। তারপরও বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। পল্লীবিদ্যুৎ বোর্ডের ডিজিএম আবুল হাসানকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট বোর্ডের জিএম কবির হোসেনের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়ে পল্লীবিদ্যুৎ বোর্ডের জিএম কবির হোসেন বলেন, তদন্ত রিপোর্ট এলেই বোঝা যাবে আসলে সেদিন কিভাবে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। গ্রেপ্তারকৃত আশরাফ সরকারকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে কয়েক জন আওয়ামী লীগ নেতার ব্যাংক হিসাব পরীক্ষা করা হচ্ছে। আশরাফের বড়ভাই মতিন সরকার ও মোবারক হোসেন মোবার ব্যাংক হিসাব পরীক্ষা করে ১০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা জমা হয়েছে একদিনেই। পুলিশ বলছে, লোকমানকে হত্যার জন্য বেশ কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এসব টাকার উৎস কোথায় তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রীর ভাই বাচ্চু ও মন্ত্রীর এপিএস মুরাদের ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে পাঠানোর পরও পুলিশকে তা সরবরাহ করা হচ্ছে না। ওদিকে মামলার ৮নং আসামি শিল্পপতি তারেক আহমেদ সৌদি আরব থেকে মালয়েশিয়া চলে গেছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। লোকমান হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যাক্ষ মোবারক হোসেন মোবা, আওয়ামী লীগ নেতা কবির সরকার ও সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। লোকমানের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, নরসিংদী জেলা প্রশাসনের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেপথ্যে থেকে কাজ করছে। এর মধ্যেই প্রায় প্রকাশ্যেই মন্ত্রীর পক্ষে মঠে কাজ করছেন নরসিংদী জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজম। তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে মন্ত্রী রাজুর বিরুদ্ধে লিখতে নিষেধ করেছেন। নিষেধ অমান্য করা হলে দেখে নেয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি। এর আগে মন্ত্রীর ভাইকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তিনি নরসিংদীতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে নরসিংদী সদর আসনের এমপি নজরুল ইসলাম হিরু বলেছিলেন, মন্ত্রী ও তার ভাই কোনভাবেই এ হত্যাকাণ্ডে জাড়িত থাকতে পারেন না। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এমপির এ বক্তব্যের পর নরসিংদীতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ওদিকে নরসিংদী পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দীনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত রিমান্ডের আসামিদের তিনি একাই জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। দরজা বন্ধ করে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আসামিদের সঙ্গে কথা বলছেন। সেখানে কাউকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হচ্ছে না। খোদ তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ইন্সপেক্টর মামুনুর রশিদকেও জিজ্ঞাসাবাদের সময় থাকতে দেয়া হচ্ছে না। যোগাযোগ করা হলে মামুনুর রশিদ বলেন, স্যার কৌশলগত কারণে কাউকে থাকতে দিচ্ছে না। এটি তদন্তের স্বার্থেই করা হচ্ছে। তবে জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নরসিংদী জেলা প্রশাসনে এখন অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। কে কোন তথ্য মন্ত্রীকে জানিয়ে দেন এ ভয় পেয়ে বসেছে তাদের। এ কারণেই এসপি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। অবশ্য রিমান্ডে থাকা আশরাফ সরকার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দীন। গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে। আশরাফের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সেসব তথ্য এ মুহূর্তে প্রকাশ করা ঠিক হবে না বলে জানান তিনি। ঘটনার দিন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উপস্থিত ১৪ জন নেতা-কর্মীকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জুবায়ের আহমেদ জুয়েল বলেন, পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমরা যা দেখেছি তা বলেছি। তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, ওই ১৪ জনের মধ্যেই এক বা একাধিক ব্যক্তি ঘাতকের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে থাকা কলভি প্রিন্টিং প্রেস সাধারণত ৬টার মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেলেও সেদিন রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা ছিল। এ বিষয়টি রহস্যজনক। পুলিশ ধারণা করছে এ প্রেসের মধ্যেই কিলাররা প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল। অবশ্য প্রেসের মালিক মনোয়ার হোসেন খান ওরফে মইনকে আসামি করা হয়েছে। মইন মামলার ৬নং আসামি। যোগাযোগ করা হলে নিহত পৌর মেয়র লোকমানের ছোটভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ বলেন, আমার ভাইকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে কয়েক মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা এঁকেছিল ঘাতকরা। কয়েক জন আসামিকে গ্রেপ্তার করায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের আস্থা আছে। তিনি আমাদের নিরাশ করবেন না। তবে অবিলম্বে প্রধান আসামি সালাউদ্দীন বাচ্চুকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি। গত ১লা নভেম্বর নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর নানা নাটকীয়তা শেষে মামলা নেয় পুলিশ। মামলার প্রধান আসামি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন রাজুর ছোটভাই সালাউদ্দীন বাচ্চু। এছাড়া মামলা এজাহারভুক্ত ১৪ আসামির বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নেতা। ওদিকে রাজুর পদত্যাগ নিয়ে নরসিংদীতে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ