মুর্শিদাবাদ আর বিহারের ভাগলপুরের মাঝখানের অঞ্চল দামিন-ই-কো বা সাঁওতাল পরগানা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জেগে উঠেছিল ১৫৬ বছর আগে, ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সংগ্রামের এই গৌরবমাহাত্ম্য ও তাৎপর্য সম্যকভাবে অনুধাবন করতে আমাদের বহু বছর লেগেছে। জনগণের ইতিহাস রচনার পথিকৃত সুপ্রকাশ রায় সাঁওতাল হূল বা বিদ্রোহকে সঠিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নতুন ধারার ইতিহাস চর্চায়। সাঁওতাল জনগণের এই জাগরণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন (মু্ক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক) :

সাঁওতাল বিদ্রোহের সংবাদ পাইয়া বাংলা ও বিহারের বিদ্রোহী সাধারণ মানুষ সাঁওতালদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে লাগিল। বিদ্রোহী সাঁওতালদের সহায় হইল বাংলা ও বিহারের গরীব জনসাধারণ। সাঁওতালদের সাহায্য দিতে আগাইয়া আসিল বাংলাদেশের বহু কামার, চামার, ডোম, প্রভৃতি মোমিন সম্প্রদায়ের গরীব মুসলমান ও গরীব হিন্দু জনসাধারণ। … সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবল সাঁওতালদেরই বিদ্রোহ নয়, অথবা সামান্য একটা স্থানীয় ঘটনাও নয়, এই বিদ্রোহ ইংরেজ শাসন ও শোষণে ভারতের পূর্বাঞ্চলের দলিত-পিষ্ট দিন-মজুর, গরীব চাষী ও কর্মহারা কারিগরদের মিলিত বিদ্রোহ, আর বিদেশী ইংরেজ শাসন ও জমিদার-মহাজনেগোষ্ঠী এই বিদ্রোহের সাধারণ শত্রু।

সাঁওতাল বিদ্রোহ আত্মশ্লাঘার লাভ করার মতো কোনো সামান্য ও সাময়িক বিষয় ছিল না। ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে এই বিদ্রোহের অসীম তাৎপর্য ও শিক্ষার কথাকে প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডি. রাঘবাইয়া, শ্রীউমাশঙ্কর এবং সুপ্রকাশ রায়ের মতো ইতিহাসবেত্তা ও বিশ্লেষকরা। ডি. রাঘবাইয়া এ বিদ্রোহের তাৎপর্য সম্পর্কে বলেছেন (ট্রাইবাল রিভোল্টস, ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস এ উদ্ধৃত) :

এটা নিশ্চিত বলা যায় যে ১৮৫৭ সালের জাতীয় অভ্যুত্থানের নেতারা ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের কাছে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং তার পরবর্তী পর্বে যেসব ঘটনার উদ্ভব হতে পারে তার গুরুত্ব অনুমান করতেও প্রচুর সাহায্য পেয়েছিলেন।

সাঁওতাল হুলের তাৎপর্য বিষয়ে সুপ্রকাশ রায়ের উপলব্ধিও প্রায় একই। ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বইতে তিনি লিখেছেন :

সাঁওতাল  উপজাতির এই স্বাধীনতার যুদ্ধ যে পাশ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণকে এবং দুই বৎসর পরের মহাবিদ্রোহে (১৮৫৭) স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা যোগাইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। বর্তমানকালে ‘অসভ্য ও বন্য’ বলিয়া পরিচিত যে উপজাতি একশত বৎসরের অধিককাল পূর্বে সমগ্র ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শিক্ষা ও প্রেরণা দান করিয়াছিল, তাহাদের অতীত ইতিহাস ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের কাহিনী আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের মূল্যবান উপাদান।

‘সাঁওতাল উপজাতির এই স্বাধীনতার যুদ্ধ’ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত ইতিহাসকাহিনীতে স্বীকৃত হয়ে উঠলেও এবং ‘তাহাদের অতীত ইতিহাস ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের কাহিনী আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের মূল্যবান উপাদান’ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাহিত্যচর্চায় সাঁওতালদের এই অবদান ও বীরত্বগাঁথা বলা চলে সেই বিদ্রোহের ১১৭ বছরের আগে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিকভাবে উঠে আসেনি।

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস শীর্ষক নাতিদীর্ঘ বইটি এ বিদ্রোহের ইতিহাসবিষয়ক বাংলা ভাষায়  রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাঁওতাল হূলকে সামগ্রিকতার আলোকে তুলে ধরার জন্য তৎকালীন এবং সমসাময়িক নানা ধরনের প্রামাণিক দলিল ও তথ্যসূত্র তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর বইতে। এখানে তিনি ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি ভাষার গ্রন্থাদি, সরকারি দলিলপত্র, গেজেটিয়ার, সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, মানচিত্র, আলোকচিত্র, ব্যবহার করার পাশাপাশি সাঁওতালী গ্রন্থাদি ও সাময়িক পত্রিকা থেকে তথ্যের যে ব্যবহার করেছেন তা বইটির অন্যতম সবলতার দিক। তৎকালীন বাংলা সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকা থেকে শুরু করে ইতিহাসের অবদান সম্বলিত বিষয়াদি তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর রচনায়।

বাংলা সাহিত্যের কথায় বলা যায় যে, সাঁওতাল বিদ্রোহ তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল তার একটি প্রাসঙ্গিক উল্লেখ পাওয়া যায় ‘পূর্ববঙ্গ-গীতিকা’ (৩য় খণ্ড, ২য় সংখ্যা) থেকে সমসাময়িক কবি কৃষ্ণদাস রায় এর ’সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া’টির উদ্ধৃতি থেকে। একে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘সাধারণ মানুষের এক মূল্যবান দলিল’ হিসেবে। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-নাট্যচর্চা ক্ষীণভাবে হলেও পরবর্তী সময়েও মুক্ত থাকেনি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে বাংলার প্রথিতযশা বিভিন্ন শিল্পীর রচিত নানা সৃজনশীল ও চেতনা উদ্রেককারী কাজ থেকে। চল্লিশের দশকে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদের তুলিতে উঠে এসেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে সাদা-কালোতে আঁকা অনবদ্য এক প্রতিবাদের ছবি। এই বিদ্রোহ বর্তমানকালের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে উঠে এসেছিল আমাদের অবিস্মরণীয় গণগায়ক আর লোকসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে। নাটকের জগতকেও আলোড়িত না করে পারেনি সাঁওতাল বিদ্রোহ। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরবর্তী সময়ে ‘নান্দিকার’ এর প্রতিষ্ঠাতা অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের সৃষ্টিতে গত শতকের ষাটের দশকে কলকাতার রঙ্গমঞ্চ আলোড়িত হয়ে উঠেছিল ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’য়ের মাদলধ্বনিতে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ এভাবে কখনোই হারিয়ে যায়নি আমাদের স্মৃতিপট থেকে; যা প্রকৃতপক্ষে নির্দেশ করে প্রজন্ম পরম্পরায় আমাদের চেতনাজগতের উপর এই বিদ্রোহের অসামান্য ছাপ ফেলে যাবার কথা। থেকে-থেকে, ধীরে-ধীরে, বিরতি দিয়ে হলেও সাঁওতাল বিদ্রোহ জেগে ওঠে নানাভাবে আমাদেরকে জাগরিত করতে। এটা শুধু শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেই বোধ করি সত্য নয়। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষব্যাপী আদিবাসী মানুষদের যে সংগ্রাম জায়মান রয়েছে, তার পেছনে যে এই বিদ্রোহসহ তার পরের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহের ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত’ এই চেতনা বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে আদিবাসী সংগ্রামী জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে তা অনুমান করার কোনো প্রয়োজন হয় না।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ১১৭ বছর পরে হলেও আমাদের প্রতিরোধ-ইতিহাসের এই তাৎপর্যময় কীর্তিগাঁথা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রেক্ষিতে সাহিত্যে রূপ পেয়েছিল ১৯৭২ সালে। এই অসাধারণ মূল্যবান কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল স্বর্ণ মিত্র ছদ্মনামে এক তরুণ সাহিত্যিকের কলমে। মুর্শিদাবাদ থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় বামপন্থী পত্রিকা ‘অনীক’ এর বিশেষ সংখ্যায় (সেপ্টেম্বরিে-নভেম্বর ১৯৭২) ক্রোড়পত্র হিসেবে প্রকাশ হয়েছিল সাঁওতাল হুল নিয়ে স্বর্ণ মিত্রের ১৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’। স্বর্ণ মিত্রের উপন্যাসটি ‘অনীক’ পত্রিকাতে প্রকাশ হবার পর আজ অবধি তা বই আকারে বৃহত্তর পাঠককুলের হাতে না পৌঁছানোতে এ উপন্যাসটির অস্তিত্ব অনেকাংশেই অজানা থেকে গেছে।



‘রাজনীতির প্রত্যক্ষ যোগাযোগে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা, তার আলোয় পথ চেনা — এই উদ্দেশ্যে স্বর্ণ মিত্র লিখেছিলেন  সাঁওতাল বিদ্রোহের কাহিনী, কানু-সিধুর কথা — ‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’ (সত্তর দশকের বাংলা উপন্যাস, ইরাবান বসুরায়। অনিল আচার্য সম্পাদিত ‘সত্তর দশক’ ১ম খণ্ড থেকে উদ্ধৃত)। ‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’ উপন্যাসটি ১৮৫৫ সালে ভাগনাদিহি গ্রাম থেকে সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব এর নেতৃত্বে সাঁওতাল পরগনার মানুষের জেগে ওঠা দিয়ে শুরু হয়ে এই বিদ্রোহ-পরবতী সর্ব ভারতব্যাপী মহাবিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে যাত্রাকে ইঙ্গিত করে শেষ হয়েছে:

সেই কর্ষিত পথ ধরে খবর ছড়ায় কুলে কুলে–ভারতবাসী মরতে জানে, জানে না আত্মসমর্পণ!
রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি সেইসব নিষিদ্ধ আলোচনা করে সিপাইয়ের দল।
তাঁবুতে-তাঁবুতে তাদেরও বিক্ষোভ গুঞ্জরিত হোতে থাকে ক্ষুধায় যন্ত্রণায়।
ক্রমশ সুস্পষ্ট হোয়ে ওঠে তাদের কাছে–নোতুন জীবনের সুতীব্র সংকেত।
রাত্রির অন্ধকারে জেগে, ব্যারাকে-ব্যারাকে গোপন কাহিনী শোনে বিদেশীর শেকলে বাঁধা হাজার সিপাইয়ের দল–কেমন কোরে মরলো সিদু? চাঁদ-কানু-ভৈরব?  দামিন-ই-কো’য় এখনও নাকি মাদলের ধ্বনি শোনা যায়?

গত শতকের সত্তররের দশকে নকশাল আন্দোলন সমাজকে পাল্টাবার জন্য সবকিছুকে দেখা ও ব্যাখ্যা করার যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ঘরানা তৈরি করেছিল, তথা ধ্যানধারণা বদলাবার যে লড়াই সৃষ্টি করেছিল, ‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’ প্রকাশের সময় এর ভূমিকাতে যা লেখা হয়েছিল তা সেই সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করে :

‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’ সেই অগ্নিঝরা লড়াইয়ের দিনগুলিরই উপন্যাস-রূপ। প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা অতীত ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ের নোংরা ঘেটে সাজিয়েগুছিয়ে রচনা করে ‘ঐতিহাসিক’ উপন্যাস। আর আমরা ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করি অতীতের বিপ্লবী গণসংগ্রামের ঐতিহ্যকে বর্তমানের বিপ্লবী লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত কোরে। ‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’ তারই এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।

‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’ প্রসঙ্গে একটি কথা হয়তো জোরের সঙ্গে কবুল করা যায়। আদিবাসীদের সংগ্রাম নিয়ে সত্তর ও আশির দশকে মহাশ্বেতা দেবীর রচিত ‘অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৭) বা ‘বিরসা মুণ্ডা ও তার তীর’ (১৯৮০) প্রভৃতি উপন্যাস যেভাবে আদিবাসীদের সংগ্রামের দিকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চোখ দান করেছিল, সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে স্বর্ণ মিত্রের উপন্যাসটি সে ধারার একটি অগ্রবর্তী কাজ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ‘অতীতের বিপ্লবী গণসংগ্রামের ঐতিহ্যকে বর্তমানের বিপ্লবী লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত কোরে’ সাহিত্য রচনার এই দৃষ্টিভঙ্গিটি স্বর্ণ মিত্র অর্জন করেছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের দেয়া ‘ঠিকভাবে দেখতে শেখার’ (মহাশ্বেতা দেবীর প্রবন্ধ ‘সত্তর দশক এবং তারপর” থেকে উদ্ধৃত) চোখের জোরে।

প্রাসঙ্গিকভাবে ‘দামিন-ই-কো’র ইতিকথা’র লেখক সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে। স্বর্ণ মিত্রের আসল নাম উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। গত শতকের ষাটের দশকে ভারতবর্ষে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, ‘নকশাল আন্দোলন’ নামে পুরানো সমাজব্যবস্থা ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ওরফে স্বর্ণ মিত্র ছিলেন সে সংগ্রামের একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী। কলকাতার ছাত্রজীবন ছেড়ে সত্তর দশকে তিনি চলে গিয়েছিলেন সাঁওতাল পরগানার গ্রামে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি সক্রিয় ছিলেন সাহিত্য রচনায়। অস্থির ওই সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে ‘স্বর্ণ মিত্র’ ছদ্মনামে লিখতেন বিভিন্ন প্রগতিশীল পত্রিকার জন্য। ’দামিনি-ই-কো’র ইতিকথা’ ছাড়া তাঁর অপর উপন্যাস ‘গ্রামে চলো’ রচিত হয়েছিল ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার’ বা বিপ্লবের জন্য কলকাতা ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। ‘‘গ্রামে চলো’ অভিজ্ঞতার রূপায়ণ — মধ্যশ্রেণীর পরিচিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে জীবনকে পাল্টে নেওয়ার যে নিদর্শন সত্তর দশকে দেখা গিয়েছিল স্বর্ণ মিত্র তাকেই ধরে রাখেন উপন্যাসের শান্ত চেহারায়’ (ঐ, ইরাবান বসুরায়)। ১৯৭৬ সালে ভারতে জরুরি অবস্থার অবসান হলে সাঁওতাল পরগানার গ্রাম থেকে ফিরে রাজবন্দীমুক্তি আন্দোলনের জন্য ‘মুক্তি চাই’ নামের প্রামাণ্যচিত্র বানাবার সময় থেকে আবার নিজ নামে মূলত চলচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী–‘চোখ’, ‘দেবশিশু’, ’ময়না তদন্ত’, প্রামাণ্যচিত্র ‘দেবব্রত বিশ্বাস’ প্রভৃতি ছিল তাঁর তৈরি করা উচ্চ প্রশংসিত চলচিত্র।  উৎপলেন্দুর সবকটি ফিচার ফিল্মের গল্গ তাঁর নিজেরই লেখা, শুধু নিজের গল্প নিয়ে সিনেমা বানাবার এমন ঘটনা একজন চলচিত্র নির্মাতার জন্য বিরল। বহুদিন পর সত্তর দশকে রচিত তাঁর গল্পগুলো ‘চোখ ও অন্যান্য গল্প’ নামে সংকলিত হয়েছে ২০১০ সালে; যার মধ্যে ‘বাঘ শিকার’, ‘প্রসব’ এর মতো সাড়া জাগানো গল্পগুলো আছে।

নিজের গল্প নিয়ে তৈরি ছবি ‘চোখ’ < আর ‘দেবশিশু’ >


সাঁওতাল বিদ্রোহ, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন, যেমন আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে বেঁচে থাকবে, তেমনি দুই ভিন্ন শতকের সংগ্রামের ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাবার অনুঘটক হিসেবে সাহিত্যিক স্বর্ণ মিত্রও বেঁচে থাকবেন তাঁর ‘দামিনি-ই-কো’র ইতিকথার’ মাধ্যমে।
———————————
‘সংস্কৃতি’ অগাস্ট ২০১১ সংখ্যার জন্য লিখিত। ১৫.৮.১১