দ্বিতীয়
বিশ্ব যুদ্ধের পর কলোনীগুলোতে স্বতফুর্ত জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ঘটে।
স্বাধীকার আন্দোলন দাপটের সাথে মাথা তুলে দাড়ায়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই
কলোনীগুলো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে নেয়। নব্য
স্বাধীন দেশগুলোতে আমেরিকা তার শক্তিশালী পুঁজি নিয়ে হুড়মুড় করে প্রবেশ
করে। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বে সহযোগী পুজিতান্ত্রিক দেশগুলো
মিলে প্রতিষ্ঠা করল জাতিসংঘ। প্রতিষ্ঠানটির স্থায়িত্বের নিমিত্তে
অর্থনৈতিক ভিত্তি অত্যাবশ্যাক ছিল। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর পাঁচ সহযোগী
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মিলে জাতিসংঘ তার অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনা করল।
প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশীরভাগ পুজি বা অংশীদারিত্বই আমেরিকার। এসব আর্থিক
প্রতিষ্ঠানকে ভিত্তি করেই আমেরিকা তার পূর্ণ বিকশিত পুঁজি নিয়ে তৃতীয়
বিশ্ব নামের দেশগুলোতে প্রবেশ করল। উন্নয়নের বিভিন্ন মডেল দিল দেশগুলোকে,
ঋণ ও যাবতীয় পরামর্শ দিল , ঋণ নিয়ে কি করতে হবে, কি না করতে হবে, কোন
সংস্কার করতে হবে, কিভাবে বেসরকারিকরণ করতে হবে, কিভাবে বাজার সৃষ্টি করতে
হবে ইত্যদি ইত্যদি। আমেরিকার আরও একটি ভয় সবসময়ই সন্ত্রস্ত করে রাখত।
জাতীয়তাবাদ নতুন দেশগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এসব দেশে যেন সমাজতন্ত্রের
ভিত্তি গড়তে না পারে সেদিকে থাকত সবচেয়ে কড়া নজর। এই নিমিত্তে তারা বেশ
কিছু রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কূট কৌশলের মহড়া চালাত। এর প্রধান উদ্দেশ্য
দেশগুলোকে অস্থিতিশীল রাখা, যেমন সেনা অভ্যুত্থান, উগ্র জাতীয়তাবাদের
উত্থান, গোষ্ঠী বিভেদ বা দ্বন্দ তৈরী করা, ধর্মীয় উগ্রতাবাদের উত্থান
ঘটানো ইত্যাদি। এতে করে তার এক সাথে অনেক লাভ, অস্ত্র বিক্রি করা,
মাতব্বরি করা, নিয়ন্ত্রণ করা, লুটপাট করা ইত্যাদি।
৯২
সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর পরিস্থিতি ও বাস্তবতা পরিবর্তন হল। সেনা
অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা কমে গেল। উপরন্তু গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে
একে নিরুৎসাহী করা হতে থাকে।
আমরা
দেখেছি সময়ের প্রয়োজনে ও পুঁজির বিকাশের স্বার্থেই এরশাদ সরকারের উত্থান
ঘটিয়েছিল আমেরিকা। এরশাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তার পতনও ঘটানো হয়। নতুন
রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমেরিকা নতুন আরেকটি শ্রেণী তৈরিতে উদ্যেগী হল।
গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মত প্রকাশ তথা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা।
নতুন শ্রেণীটি হল এই সংবাদ মাধ্যম আশ্রয়ী বুদ্ধিজীবি শ্রেণী আমাদের এখানে
যারা সুশীল সমাজ নামে পরিচিত। এরা অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় সংস্কৃতি ও
চিন্তার ধারক ও বাহক মধবিত্ত ও মধ্যবর্তী শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে
অতিমাত্রায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। তাদের এই উত্থানের ও গ্রহণযোগ্যতার
কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনের ব্যার্থতা থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনে জেগে উঠা
হতাশাকে ধরতে পারা। তারা দেশে জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার গালভরা কথা বলে,
তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় উচ্চকণ্ঠ প্রকাশ করে যা মধ্যবিত্ত
শিক্ষিত শ্রেণীকে সহজেই আকৃষ্ট করে তুলে। তৃতীয় বিশ্বের নেতা নেতৃগণ
ক্ষমতা ও অর্থ ছাড়া তেমন কিছু চেনে না এবং তা স্বাভাবিক, খালেদা-হাসিনারা
তাই দুর্নীতির ধারক-বাহক। রাজনৈতিক দল সমুহের পারস্পারিক অশ্রদ্ধা,
গনতন্ত্র চর্চার অভাব, সহিংস মনবৃত্তি ইত্যাদি জনমনকে সর্বদা ক্লান্ত ও
হতাশ করে রাখে। সেই সুযোগটাই সুশীলরা হাতিয়ে নেয় কৌশলে। এদের আমরা প্রয়াশই
দুর্নিতি, সুশাসন প্রভৃতি প্রশ্নে সভা সমতি, সেমিনার, টক শো, পত্রিকার
কলামে বলিষ্ঠ বক্তা ও প্রতিবাদী দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখি। যাদের মুখে
বুলেটের মত উচ্চারিত হয় দেশ, জাতি আর স্বাধীনতার কথা। স্বাধীনতার চল্লিশ
বছরে আমাদের নেতৃত্ব দেশকে কিছুই দিতে পারেনি এই তাদের মুল বক্তব্য। এই
দেশ আমাদের মা, আর মায়ের জন্য আমরা কিছুই করিনি শুধুই দুর্নীতিতে ৫ বার
চ্যাম্পিয়ান বানিয়েছি। এই দায় কার? তাদের উত্তর সহজ এই দায় রাজনীতির, এই
দায় খালেদা-হাসিনার। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মত প্রতিষ্ঠানের
জন্মই হয়েছে এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা বিভিন্ন
দেশ সমূহের দুর্নীতিগ্রস্থতার পদস্থান নির্ধারণ করে। এই ব্যবস্থা এই
সুশীলদের আহাজারীর বৈধতা ও ভিত্তি দেওয়ার জন্যই।
তো
এই সুশীল সরাসরি আমেরিকার আজ্ঞাবহ। এই শ্রেণীটা কখনো বিশ্বপুঁজির
স্বার্থের সাথে বেইমানী করবে না। হাসিনা-খালেদাও আমেরিকারই তাবেদার। তবে
তাদের ‘পরিবার তান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা’ ব্যাপারটা পুজি ও সম্রাজ্যবাদের
স্বার্থের জন্য অনেক সময়ই প্রতিবন্ধক। এজন্য তাদের দরকার পরে এদের
নির্বাসনে পাঠিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন না করে এই তৃতীয় পক্ষ,
সুশীল-আমলা-সামরিক কর্তাদের নিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠার। যে সরকার বিনা দ্বিধায়
বিশ্ব ব্যাংকের নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে, জাতীয় সম্পদ বিদেশী কোম্পানির
হাতে তুলে দিবে, সেখানে হাসিনা-খালেদারা মাঝে মাঝেই গড়িমসি করে থাকে কেননা
সামান্য হলেও জনগণের মুখোমুখি হতে হয় তাদের, কিছুটা হলেও তারা আমজনতার
কাছে দায়বদ্ধ। এই নতুন মাত্রার সুশীল অভ্যুথানের এক্সপেরিমেন্ট আমরা দেখি
ওয়ান এলিভেনে। আমেরিকার আর্শিবাদ পুষ্ট সুশীল-বুদ্ধিজীবীদের অভ্যুথান হয়
এই দিনটিতে। এক অগণতান্ত্রিক, অরাজনৈতিক ঐতিহাসিক পাপের জন্ম দিল সুশীল
সমাজ। আরোপিত ব্যাবস্থার নাম দিল সামরিক শক্তি স্বমর্থিত উপদেষ্টা সরকার।
যেখানে আগের পদ্ধতিকেও অবহেলা করা হয় নি, সামরিক শক্তিকে পেছনে দাঁড় করানো
হয়েছিল।
এ
অবস্থা সৃষ্টির পূর্ব পরিকল্পনা হিসেবেই পাঁচ পাঁচবার বাংলাদেশকে
দুর্নিতিতে চ্যাম্পিয়ান করা হয়েছে। বাংলাদেশ অবশ্যই প্রবল দুর্নীতিপরায়ন
দেশ, তাই বলে তাকে টানা ৫ বার প্রথমই হতে হবে? তাছাড়া আমেরিকার আর্শিবাদ
পুষ্ট এরকম অনেক প্রতিষ্ঠানই রয়েছে যারা নিজেদের সুবিধামত, লক্ষ্যনুযায়ী
এসব সুচক, র্যাঙ্কিং ইত্যাদি তৈরি করে যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন বই
আর কিছু না। যেমন , failed state index । ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত ফরেন
পলিসি ম্যাগাজিনটি ২০০৫ সাল থেকে আমেরিকার ফান্ড ফর পিস নামক প্রতিষ্ঠানের
সাথে সম্মিলিতভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের সুচক প্রকাশ করে। এটি আর কিছুই না, এর
র্যাঙ্কিং গুলোর দেশ সমুহের অবস্থান দেখলেই বোঝা যায় এটি ৯/১১ এর
সন্ত্রাসী হামলার পরবর্তি বিশ্ব পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চোখ দিয়ে
বিশ্বকে দেখার প্রয়াস মাত্র। আমেরিকার নিশানা অনুযায়ীই দেশ সমুহের সুচক
উঠা নামা করে। এর ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় আমরা বারবার পাই আফগানিস্থান,
সোমালিয়া, আইভরিকোস্ট, ইরাক প্রভৃতি দেশের নাম, যা হিসাবকে আরও সহজ করে
দেয়।
অনুরুপে
এই টি.আই.বি, আমেরিকান আগ্রাসনের সহযোগী সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর
কিছু নয়। টিআইবি’র আগা গোড়া আমেরিকান ও তার সহযোগীদের অর্থ ও আদর্শপুষ্ট।
এ যাবৎ কালে আমেরিকা নিজের স্বার্থ ছাড়া কোন কাজ করে এমন নজির কেউ দিতে
পারবে না । আমেরিকার প্রতি দেশে এভাবে নিজেদের গড়া একেবারে “নিজেদেরই”
শ্রেণী তৈরি করা আছে। আমেরিকা বর্তমানে এক অংশের পতন ঘটিয়ে অপর অংশের
উত্থান বা সামরিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার চেয়ে তাদের নিজের আশ্রিত ও বিকাশ
করা শ্রেণীকে ক্ষমতায় আনতে তারা এখন বেশী আগ্রহী। টিআইবি, সিপিডি ইত্যাদি
প্রতিষ্ঠান সেই শ্রেণীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে মাত্র। আবার খালি চোখে
দেখলেও টিআইবির সাথে জড়িত ব্যাক্তিবর্গও প্রতিষ্ঠিত সুশীল হিসেবে পরিচিত।
মোজাফফর-হাবিবুল্লাহরা একই সমাজভুক্ত একই উদ্দেশ্যমুখী একই স্বার্থে
নিয়োজিত একটি নব্য প্রজেক্টের বা তত্ত্বের ফাংশনিং বা প্রয়োগ মাত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন