বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১১

অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটঃ কি চান ছাত্র ও শিক্ষকরা?




(এই লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষণধর্মী সাময়িকী দি নেশন পত্রিকায় প্রকাশিত জশ এইডেলসন এর ‘Sharing Is Caring’: Students and Teachers Explain Why They Marched to Occupy Wall Street এর অনুবাদ। জশ এইডেলসন দি নেশন-এর একজন ইন্টার্ন ও দি আমেরিকান প্রস্পেক্ট এর কন্ট্রিব্যুটর এবং প্রাক্তন ইউনিয়ন সংগঠক।)

যে জনসমুদ্র গত রাতে (৫ অক্টোবর) এগিয়ে চলছিল লিবার্টি প্লাজার দিকে তাদের ভেতর ছিল বহু ছাত্র ও শিক্ষক। আলাপ হচ্ছিল তাঁদের কয়েকজনের সাথে। কেন তাঁরা এখানে? কী তাঁদের চাওয়া? কী তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী?  তাঁদের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এসব কিছু।

বেভারলি সেগারস,

৬৯ বছর বয়সী অংকের শিক্ষক

তিন বছর হতে চলল আমার ছেলে বেকার। ১৪ বছর ধরে সে একটা চাকরীতে ছিল। এখন এই আমেরিকায় সে কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। আমি আর পারছি না। অথচ জানো, অনেক কাজের যোগ্যতাই তার আছে। এমনকি সে আবার পড়াশোনাও করেছে নিজেকে তৈরী করার জন্য। এই হতচ্ছাড়া দেশে কাজ পেতে হলে তাকে আর কি করতে হবে বলতো? যুবক, ছাত্ররা কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছে অথচ কোন কাজ পাচ্ছে না। যখনি আমরা ঘুরে দাঁড়াই তখনি এরা শুরু করে সামাজিক সুবিধা হ্রাস, বারবার, বারবার। আর ওদিকে দেখো, পয়সাওয়ালা মোটা বেড়ালগুলোর তেলে মাথায় আরও বেশি তেল দেয়া হচ্ছে।

এই দেশে আমাদের দুর্ভোগের আর শেষ নেই। এখন সময় এসেছে কিছু একটা করার। কংগ্রেস কিছু করবে না, সিনেট কিছুই করবে না, প্রেসিডেন্টকে দিয়েও কিস্যু হবে না। যা করার আমাদেরকেই করতে হবে। যেভাবে আমরা সত্তরে করেছিলাম। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। আবার গ্রেপ্তার হতে আমার আপত্তি নেই। কারণ, তখন আমি যেভাবে বাঁচতাম এখন অবস্থা তার চেয়ে শোচনীয়। বুঝেছো? ৬৯ বছর বয়স হল আমার। বাঁচবো আর কয়দিন?

এই যে আমার ছাত্ররা, ধর যদি তারা GED পেল বা সার্টিফিকেট পেল। কি করবে তারা এ দিয়ে? কোথায় কাজ করবে তারা? তারা আমার কাছে চাকরির ব্যাপারে পরামর্শ চায়। কি ছাই বলব বল আমি তাদের? খুবই হতাশ লাগে, জানো। কয়েক বছর আগেও আমাদের জব কাউন্সিলর ছিল। তাদেরও চাকরী গেছে।

এই ছাত্ররাই ষাট আর সত্তরের সময় কেন্ট স্টেটে শুরু করেছিল বিপ্লব। দেশকে জাগিয়েছিল তারা। সেদিন আবার এসেছে। আবার একটা কিছু হবে, দেখো তুমি?

তিয়ানা স্ট্রিকল্যান্ড,

ম্যানহাটান স্কুলের ভিজুয়াল আর্ট এর ছাত্রী

দারুণ লাগছে আমার! আমার খুব গর্ব হচ্ছে আজ আমরা সবাই এক হয়েছি একটাই উদ্দেশ্য সামনে রেখে!

স্কুলে আমার এর মধ্যেই ৮০,০০০ ডলার দেনা হয়ে আছে। আমি জানি না কলেজ থেকে বেরুনোর পর আমার চাকরী হবে কি হবে না। আর যদি খুঁজে পেতে একটা চাকরী মেলেও আমার দেনা কিভাবে আমি শোধ করব?

এবার সরকার যদি একটা ধাক্কা খায়! মানুষের ভেতর যদি কোন পরিবর্তন আসে! আমি চাই এই স্ফুলিঙ্গ একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিক! মানুষ এখন বুঝতে পারছে আমরা যদি এক হই তো সরকারের আশায় আমাদের তাকিয়ে না থাকলেও চলবে!

আমি একজন ছাত্র। সপ্তাহে ৪ দিন আমি কাজ করি। নিজের বাসা ভাড়াটা, স্কুলের বেতনটা নিজেই দিই। এখন আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে আমি এই খরচ চালাবো? এটাই আমার কলেজের শেষ বছর, অথচ এখনও আমি বেতন দিতে পারিনি। আদৌ গ্রেজুয়েট হতে পারবো কি পারবো না, আমি জানি না। আমি অন্ধকার দেখছি চারপাশে। আমার চোখের সামনে আমার অনেক বন্ধুকে ড্রপ আউট করতে হয়েছে শুধু তাঁরা কলেজের খরচ চালাতে পারেনি বলে। ওদের জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। ইউনিয়নগুলো এখানে আছে এই ব্যাপারটা দারুণ। এতে বোঝা যাচ্ছে শুধু বাচ্চারা আর ছাত্ররাই নয় সবাই আজকে দুঃসময় পার করছে। অনেক সময় দেখা যায় ছাত্রদের গুরুত্ব দেয়া হয়না। এবার যখন শ্রমিক আর ছাত্ররা একসাথে নেমেছে পুরো ব্যাপারটা অন্য মাত্রা পাবে নিশ্চয়ই।

মারিয়া অরতিয,

দোভাষী শিক্ষক

পাবলিক স্কুলগুলোতে এখন কর্পোরেট মিডিয়াগুলোর রাজত্ব চলছে। তাঁরা আমাদের হুকুম দিচ্ছে কি বলতে হবে, কিভাবে বলতে হবে, কি শেখাতে হবে। আমরা জানি আমাদের বাচ্চারা কি চায় আর তাদের কি শেখাতে হবে। শিক্ষকরা কাজ হারাচ্ছে আর আমাদের ক্লাসরুমগুলোতে আজ বাচ্চাদের জায়গা হয় না।

আজকে আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি কারণ এরা আজকে মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্তদের পথে বসিয়েছে। আমাদের সব কিছু লুটে নিয়েছে এই ওয়াল স্ট্রীট এর জুয়াড়ীরা। স্কুলের টাকা মেরে দিয়েছে এরা। এখন পাবলিক স্কুলগুলোর জন্য কোন বরাদ্দ নেই। আমাদের ক্লাসরুমগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশ। আমরা সবাই এই দুঃসময় পার করছি। আমরা সবাই এখন একই পরিবারের। আমরা সবাই দেখছি এই ওয়াল স্ট্রিট এর জুয়ারীরা আমাদের অর্থনীতির কি শোচনীয় হাল করেছে।

নিক ফিওরা, ছাত্র,

ম্যাঞ্চেস্টার কমিউনিটি কলেজ

মিডিয়াগুলো এইভাবে খবর চেপে রেখেছে তাতে আমি আর আমার বন্ধুরা খুবই হতাশ। তাই আমরা অল্প কিছু টাকা জোগাড় করে কানেক্টিকাট থেকে চলে এসেছি এখানে অংশ নেয়ার জন্য। আমরা এই ব্যাপারটাকে সঠিক মনে করি ও সমর্থন জানাই। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা চাকরীর কারণে এখানে আসতে পারেনি। তাদেরকে পরিবার চালাতে হয়। তারা আমাকে বলেছে আমাদের পক্ষ থেকে তুমিই যোগ দাও।

এতো লোক দেখে আমি অভিভূত! কয়েকজনকে দেখলাম যারা প্রথম দিন থেকেই ছিলো। তারা আনন্দে কাঁদছিল। তাঁরা বলছিল, আমরা ছিলাম মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন। এখন আমরা হাজারে হাজার!

দুই দুইটি যুদ্ধের ব্যয় আমাদের ঘাড়ে। অথচ এই টাকাগুলো আমেরিকার জনগণের কাজে লাগানো যেত। অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে ব্যয় করা যেত। ভিন দেশে এই যুদ্ধ আমাদের কি দিয়েছে? এই রাজনৈতিক নেতাদের উচিত আমেরিকার জনগণের কাজের ব্যবস্থা করা আর ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা। অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট লক্ষ্যহীন নয়, আসলে আমাদের সমস্যাগুলো বহুমূখী।

মারি এলিস বয়েল,

ফোর্থ গ্রেড শিক্ষক, স্থানীয় ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট

পেকস্কিল এর যে স্কুলে আমি পড়াই শেখানে দারিদ্র হার ৬৮%। আমার চোখের সামনে ক্ষুধার্ত, গৃহহীন বাচ্চাদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি ক্লাস রুমে আমাদের প্রায় ৩০ জন করে বাচ্চা পড়ে। আমাদের ৩০০ ইউনিয়ন মেম্বারদের ভেতর ৪৫ জন চাকরী হারিয়েছে। একটা মোটামুটি মানের জীবন চালিয়ে নেবার জন্য যে শিক্ষাটুকুর দরকার হয় তাও আমরা এই বাচ্চাদের দিতে পারছি না। আরে, চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত যে শিক্ষা উপকরণটা দরকার তাওতো আমাদের নেই। আমরা রীতিমত ঘাম ঝরাচ্ছি, কিন্তু তাতে তো সমস্যা কমছে না। যে আমেরিকান স্বপ্নের বুলি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আওড়ানো হয় তা দ্রুত ফিকে হয়ে আসছে।

আমাদের ৪৫ জন ইতিমধ্যেই চাকরী হারিয়েছে। আগামী বছর যখন নতুন ট্যাক্স চাপবে ঘাড়ে তখন ছাঁটাই হবে আরেক দফা। আমাদের কি যে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু হাড় গোড় ছাড়া তো বাকি কিছু রাখেনি! ক্রমাগতভাবে চলছে লোক ছাঁটাই। এভাবে চললে প্রতি ক্লাসে আমাদের ৫০ জন করে বাচ্চাকে পড়াতে হবে। তা নয়তো ভার্চুয়াল স্কুল তো আছেই। তাঁরা বলবে দরকার কি এখন আর শিক্ষক দিয়ে। ক¤িপউটারই বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়ার দেখভাল করবে। বিল গেটস এর বেসরকারীকরণের আর ভার্চুয়াল স্কুলের ভুত চেপে বসবে পাবলিক স্কুলগুলোর উপর। সবকিছুই তো তাঁরা বেসরকারীকরণ করছে! এই কর্পোরেশনগুলো ঘন্টায় ১০ ডলার দিয়ে তাদের খাটাবে কোন সুযোগ সুবিধা ছাড়াই। এখানে শুধু থাকবে বিত্তবান আর নিঃস্বরা।

অন্তত কিছু লোক তো রুখে দাঁড়িয়েছে! আমি সেইদিনের আশায় বসে আছি যেদিন নতুন প্রজন্ম উঠে দাঁড়িয়ে বলবে, “দাঁড়াও! আমাদের কি হবে? কোথায় আমাদের আমেরিকান স্বপ্ন? আমি কলেজে পড়েছি আর আমি সব করেছি যা তুমি আমাদের করতে বলেছ। আজ তবে আমার চাকরী কই?”

কাইল কারারো, আইনের ছাত্র,

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক

জনগণ বিপর্যস্ত, আমাদের অর্থনীতি শোচনীয়। আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের তারা নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত। এই সহস্র জমায়েতের কিছু অংশ তো আছে যাদের এই উপলব্ধি আছে। তাঁরা ঠিকই ধরতে পারছে আজ অল্প কিছু আমেরিকানদের হাতে আমাদের সব স¤পদ কুক্ষিগত। আমি জানি না প্রি-স্কুলে পড়া লাইনগুলোর তাদের মনে আছে কিনা “সকলের তরে সকলে আমরা।”

সব সমস্যার মূলেই রয়েছে অর্থ। আমি যেখানে থাকি সেটা ছিল কো-অপারেটিভ। এখন তা চলে গেছে ব্যক্তি মালিকানায়। দাদার বরাতে আমাকে সেখানে কোন ভাড়া দিতে হয় না, কিন্তু যারা সেখানে থাকে তাদের প্রত্যেককে মাসিক ৩,৫০০ ডলার ভাড়া গুণতে হয়, হাস্যকর!! কে এটা চালাতে পারবে? তুমি দেখ, এখানে শপিং মল তৈরী হচ্ছে, বিলাসবহুল বাড়ী তৈরী হচ্ছে, এবং অনেক মানুষই জানে না এগুলো তৈরী করতে তাদের কত ট্যাক্স ছাড় দেয়া হচ্ছে। আর পাবলিক আবাসনের বাসিন্দাদের বলা হচ্ছে, “দুঃখিত, তোমার এপার্টমেন্ট সারানোর জন্য যথেষ্ট অর্থ আমাদের নেই।” অনেক বাসিন্দাই আছে, একটু বৃষ্টি হলেই তাদের এপার্টমেন্ট ভরে যায় পানিতে। দেয়াল ভর্তি শেওলা, যেন কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর চলচ্চিত্রায়ণ, অসহনীয়! অমর্যাদাকর! আর কর্তারা বলে এগুলো সারাতে ২০১৪ লেগে যাবে, এটা বে-আইনী আর কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কর্তৃপক্ষ বলবে, “মানি এটা আমাদের দায়িত্ব, কিন্তু এই মূহুর্তে আমাদের হাতে অর্থ নেই।”

বেশি দিন চলবে না এভাবে। কত মানুষকে তোমরা দূর্ভোগে ফেলেছ! এখন তার ফল দেখ! সবাই বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়!

এখানে এসে দারুণ লাগছে! আমি জানি না কি ঘটবে আর আমি মনে করি না যে এতেই সমাধান আসবে। বরং একে দেখতে হবে এক দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের একটা ধাপ হিসেবে, যে পরিবর্তনের জন্য আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘদিনের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ