বহু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা অমীমাংসিত রেখে আলোচনার টেবিলে ‘ট্রানজিট’
ট্রানজিট,
ট্রানশিপমেন্ট কিংবা করিডর – যে সুবিধাই দেয়া হোক না কেন, তার ভিত্তি
অবস্যই হতে হবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা। ‘ট্রানজিট’রূপী সুবিধার বিনিময়ে
বাংলাদেশও সমমানের কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে – এমনটিই প্রত্যাশিত।
এক্ষেত্রে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বাড়তি প্রবেশের ব্যাপার যেমন
আছে তেমনি আছে নেপাল, ভূটান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে বাংলাদেশি পণ্য
পরিবহনের সুবিধাপ্রাপ্তির প্রশ্ন। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা
অন্যান্য সমস্যা যেমন সমুদ্রসীমা নির্দিষ্টকরণ, স্থল সীমানা চিহ্নতকরণ,
সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশীদের হত্যা, আন্তঃদেশীয়
নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া, ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধের
প্রতিক্রিয়াও বাংলাদেশের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।
এ
প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক ব্যবধানের বিষয়টি উল্লেখ করা
অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরের
জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি তালিকা বিশ্লেষণে
দেখা যায়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের
পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য। এ সময় বাণিজ্য
ঘটতি দাঁড়ায় ৩০২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি
করে ২৮৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ২৭ কোটি ৬৫ লাখ
ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২৫৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৯-১০
অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩২১ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য, যার বিপরীতে
রপ্তানি করে ৩০ কোটি ৪৬ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায়
২৯০ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাবে গত (২০১০-১১) অর্থবছরের
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৯৩ কোটি
৬৬ লাখ ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য।
দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। এই বিশাল
বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের পথে অন্যতম
অন্তরায় হয়ে আছে। আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের সঙ্গে চোরাই পথে আসা পণ্যের
হিসাব করলে ঘাটতির পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে যাবে। কয়েক বছর আগে
বিশ্বব্যাংকের দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ভারত থেকে আসা
৮৩ শতাংশ পণ্য আসে চোরাই পথে। এর পরিমাণ ৬৩১ মিলিয়ন ডলার। মূলত ভারতে
রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতির কারণে ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে।
বলা
হচ্ছে, ‘ট্রানজিট’ স্রেফ একটি অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ, এর সঙ্গে রাজনৈতিক
বিবেচনাগুলো যুক্ত করা অনুচিত হবে। কিন্তু বিশ্ব পরিসরের অভিজ্ঞতা থেকে
দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্বের বাস্তব পটভূমি ছাড়া এবং দেয়া-নেয়ার
মনোভাব ছাড়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা খুব বেশি এগোয় না। দীর্ঘদিনের পুরানো
দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর মীমাংসা স্থগিত করে এবং আড়ালে রেখে ‘ট্রানজিট’
সুবিধা দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের দিক থেকে জাতীয় স্বার্থসম্মত নয়।
কোনরূপ দরকষাকষি ও অর্থনৈতিক বিবেচনাকে বাদ দিয়ে ভারতে ‘ট্রানজিট’ বা
‘করিডর’ সুবিধা দিয়ে দেয়ার পক্ষে যারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের
একটি ‘যুক্তি’ দেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি বিধানে’র আলোকেই ভারতের
এইরূপ সুবিধা প্রাপ্য। এক্ষেত্রে আসলে সত্য-মিথ্যার মিশেল ঘটানো হচ্ছে।
প্রথমত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কথিত বিধি (অ্যার্টিক্যাল ৫) অনুযায়ী কেবল
‘ল্যান্ড-লক’ (অন্যদেশ দ্বারা বেষ্টিত, বন্দরহীন) দেশগুলোর জন্যই
প্রতিবেশী কর্তৃক ‘ট্রানজিট’ সুবিধা দেয়ার সুপারিশ রয়েছে এবং এই বিধানও
এখনো চূড়ান্ত ভাবে অনুমোদিত হয়নি। অর্থাৎ বিধানটি অনুমোদিত হলেও ভারতের
ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। কারণ ভারত কোন ‘ল্যান্ড-লক’ দেশ নয়।
উপরন্তু ভারত নিজে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ‘ল্যান্ড-লক’ দেশ নেপালকে কখনো
ট্রানজিট সুবিধা দেয়নি। যে কারণে নেপাল বহুপূর্বে বাংলাদেশের কাছ থেকে
‘ট্রানজিট’ সুবিধার নীতিগত সম্মতি পেলেও ভারতের বৈরিতায় তা আজো কার্যকর
করতে পারেনি।
উপরোক্ত
ধাঁচে সত্য-মিথ্যার ধূম্ররজাল সৃষ্টি করেই নব্বুয়ের দশকের শেষার্ধে
তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে এবং জনগণকে অন্ধকারে রেখে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির
হিস্যা নিয়ে একটি চুক্তি করেছিল ভারতের সাথে। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগ শেষে
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে চুক্তিতে কথিত পানি পায়নি।
ভারত-বাংলাদেশ অতীতের সকল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অভিজ্ঞতাই এ রকম হতাশাজনক।
এরকম নানান বিষয় অমীমাংসিত রেখেই ট্রানজিট প্রদানের ফয়সালার মাধ্যমে
শাসক শ্রেনীর নতজানু অবস্থান জনগণের কাছে পরিস্কার।
অর্থনীতির সাদামাটা হিসেবের আড়ালে ‘ট্রানজিটে’র তাৎপর্য
এটা
পরিস্কার, দুইহাজার দশ সালে এসে ইনডিয়া ‘ট্রানজিটে’র আদলে যে ‘করিডর’
চাইছে তার ধরণ, প্রকৃতি ও প্রয়োজন আগের যে কোন সময়ের চাইতেই আলাদা।
অর্থনীতির সাদামাটা হিশাব আমলে নিয়েও বলা যায় তা প্রধানত তাদের
উত্তরপূর্বাঞ্চলের ভূ-খন্ড টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্র তৈরির আবশ্যিক চাহিদা।
দশকের পর দশক প্রবল সামরিক উপস্থিতি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সংহতি টিকিয়ে রাখা
হয়েছে। বিদ্রোহী দলগুলার উপর রাজনৈতিক-সামরিক চাপ প্রয়োগ ও সমঝোতায়া
বাধ্য করার নীতিতে বাংলাদেশকে কাছে পাওয়া তাদের জন্য একান্তই দরকার।
বিরোধ মীমাংসাসহ রাজনৈতিক ফয়সালায় বাংলাদেশ সংযমী এবং দূরদর্শী ভূমিকা
পালন করতে পারত। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী না হয়ে শাসক শ্রেনীর কৈাশল হয়ে
গেল অন্যের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ইনডিয়ার নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে
বাংলাদেশে প্রবেশ করে গ্রেফতার এবং অপহরণের অবাধ সুযোগ দেওয়া।
উত্তরপূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের সশস্ত্র
সংগ্রামে নিয়োজিত দলগুলোর প্রতি ইনডিয়ার নতুন মনোভাব এবং করণীয়ও ঠিক
হয়েছে এই পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। বাংলাদেশকে তাদের নিরাপত্তা বলয়ের
মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করটা মূলত এই দিকটা সামলানোর জন্য। কিন্তু আড়াল হিশাবে
সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলার তৎপরতা এবং ট্রানজিটকে খুব সুচারুভাবে সামনে
আনা হয়েছে।
এরফলে
অবস্থা কি রুপ হবে তা মোটামুটি অনুমান করা যায়। সেই সাথে উইকিলিকসের
উদ্ধার করা বার্তা ছাড়াই প্রকাশ্যে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর মুখনিঃসৃত
বাণী থেকেই আমরা বুঝতাম, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনভাব। তার উপর পাওয়া
গেল সরাসরি ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর বক্তব্য। “তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অন্তত ২৫ শতাংশ বাংলাদেশি জামায়াতে-ইসলামির সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী”
– এই মন্তব্যে বাংলাদেশের কতভাগ লোক ইনডিয়া বিরোধী, অতএব মৈালবাদী সেই
সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবনিকেশ নিয়ে আলোচনার পর মন্তব্যটি সরিয়ে নেওয়া
হলেও, হিসেবে রাখা প্রয়োজন এটি প্রত্যাহার করা হয়নি। নিজ দেশের
সম্পাদকদের কাছে তিনি বাংলাদেশের প্রতি ইনডিয়ার মনোভাবই নয় বরং
সম্পর্কের ধরণ এবং ইনডিয়ার অবস্থানও ব্যাখা করেছেন। নিজেদের রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থের জন্য বিনিয়োগকৃত এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ
সহায়তাকেই আখ্যা দিয়েছেন অভূতপূর্ব উদারতা আর সদয় আচরণের পরাকাষ্ঠা
হিশাবে। শুধু তাই না, একমাত্র যে প্রতিশ্রুতিটুকু গত দেড়বছর আমাদের
প্রধানমন্ত্রীর খাতায় বারবার দেখানো হয়েছে, সেই তিস্তার পানি বন্টন
চুক্তি বিষয়ে মনমোহনের মন্তব্য, এরকম কিছু একতরফা ছাড় দেয়া যায় কিনা
ভাবছেন তারা। অভিন্ন নদীতে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত পানি পাবার ন্যায্য
অধিকারকে ইনডিয়া বলছে তাদের পক্ষ থেকে দয়া প্রদর্শন। প্রাকৃতিক উৎসের
উপর আমাদের প্রাপ্য অধিকারটাকে বহুদিন থেকে তারা কূটনৈতিক দেনদরবার এবং
দরকষাকষির বিষয়বস্তু বানিয়ে রেখেছে।
গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে
আহমদ ছফা বহু আগেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শাসক শ্রেনীর ভূমিকাকে ‘স্বাভাবিকের চাইতে একটু অধিক যেতে বাধ্য হয়েছিলো’
বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, নেতৃবৃন্দ কখনো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি
করতে পারেন নি যে বাংলাদেশে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রসত্তার জন্ম হতে
চলেছে এবং তারা সে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর এই ভাবেই বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ পায়ে হেটে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করতে ভারতে চলে
যেতে বাধ্য হয়। শাসক শ্রেনীর মেরুদন্ডহীনতায় সেই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে জনগণ
আজো বেড় হয়ে আসতে পারলোনা। জাতীয় সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দেওয়া,
ভারতকে ট্রানজিট প্রদানসহ ইত্যাদি পরিস্থিতি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও
রাজনৈতিক জানগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখোমুখি করেছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের নিয়তি কোন দিকে? আহমদ ছফাই সেই নিয়তির নির্দেশ
করেছেন, “…বাংলাদেশকে এমন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হতে
হবে, যা অনিবার্যভাবেই ভারতীয় বৃহৎ ধনিকশ্রেণীর শোষণ থেকে ভারতের শোষিত
এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীসমূহকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং আর্থিক দাবির
প্রতি সজাগ করে তুলবে। সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ভারতের নির্যাতিত
জাতিসত্তাসমূহের সামনে বাংলাদেশকেই সর্বপ্রথম প্রেরণার দৃষ্টান্ত সরবরাহ
করতে হবে। এটাই বাংলাদেশের নিয়তি।” ফলে শাসক গোষ্টির ক্রমাগত
ব্যার্থতা এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে নতুন রাজনৈতিক দিশা হাজির করবে।
জনগণের সঙ্গে জনগণের মৈত্রীর প্রশ্নে দৃঢ় ও আন্তরিক থেকে বাংলাদেশের
জনগণই উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
সহায়ক গ্রন্থ ও রচনা সূত্র:
০১. বেহাত বিপ্লব ১৯৭১; সম্পাদক: সলিমুল্লাহ খান। ফেব্র“য়ারী ২০০৭, অন্বেষা প্রকাশন।
০২. গণপ্রতিরক্ষা; লেখক: ফরহাদ মজহার। ফেব্র“য়ারি ২০০৬, ঐতিহ্য।
০৩. ইনডিয়া-বাংলাদেশ সর্ম্পক: মনমোহনের সফরে ম্যাজিক অসম্ভব। লেখক: মুসতাইন জহির।
০৪. ট্রানজিট: বহু প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। সম্পাদনায়: ট্রানজিট স্টাডি গ্রুপ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন