মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০১১

জবাবে পুত্র বভ্রুবাহন বললনেঃ আমার মা নটী নয়। কিন্তু আপনার মা কী?

এবার আসি মহাভারতের কথায়, মহাভারত কেন নারী বিদ্বেষী? মহাভারতের কাহিনী বর্ণনা করার পূর্বে লেখকের পরিচয় প্রদান করা আবশ্যক, তিনি নারীকে অযথাই হীন বলেন নি বরং এর পিছনে ছিল লেখকের কষ্টদায়ক কিছু অভিজ্ঞতা। মহাভারতের লেখকের জন্ম ছিল কিছুটা বিচিত্র। পরাশরার সাথে সত্যোতির (বিবাহের পূর্বে, কুমারী থাকা অবস্থায়) মিলনে ভাসার জন্ম হয়। ভাসার গায়ের রং কালো ছিল বলে তার নাম শ্রীকৃষ্ণ এবং দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে দ্বৈপায়ন হয়। তাকে শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বলা হয়। এই সত্যবতী ছিলেন মৎস্যজীবী ধীবরের কন্যা। হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রী গঙ্গাদেবীকে হারানোর পর রাজা সত্যবতীকে বিয়ে করেন। সত্যবতী চিত্রঙ্গদা ও বিচিত্রবীর্য নামে দু'জন পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু কুমারী থাকা অবস্থায় সত্যবতী পরাশরার মুনির ঔরস্যে ভাসার জন্ম দেন।

"Who is he, my son ?" asked the queen. "Vyasa, the great saint," retorted Bhishma. Satyawati was reminded of Vyasa whom she had given birth as an unowed mother from Saint Parashara. It was the same Vyasa who later authored the present epic----the Mahabharata.

শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন আবার তার সৎ-ভাই (ছোট) বিচিত্রাবীর্যের রেখে যাওয়া দুই স্ত্রী (বিধবা) অম্বিকা ও আম্বালিকার গর্ভে জন্ম দেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও বর্ণহীন পান্ডুর। এছাড়াও ব্যাসদেব অম্বিকা ও আম্বালিকার দাসীর গর্ভে জন্ম দেন ভিদুরার। ধৃতরাষ্ট্র যদু বংশীয় সুবল রাজার কন্যা গান্ধরীকে, পান্ডু কুন্তি ও মাদ্রীকে, ভিদুর সুদেব রাজার কন্যা পরাশরাকে বিয়ে করেন। একই সঙ্গে কুন্তি ও গান্ধরী অন্তঃসত্ত্বা হল। কিন্তু কুঁড়ি মাস অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও গান্ধরীর সন্তান প্রসূত হলো না। অথচ, কুন্তীদেবী পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। কুন্তিদেবীর প্রথম পুত্র রাজা হবে এই ধিক্কারে গান্ধরী লোহার মুগুর দিয়ে পেটে আঘাত করল। সেই আঘাতে তার গর্ভ থেকে একটি মাংসপিন্ড নির্গত হল। ঘৃণায় মাংসপিণ্ড দূরে ফেলে দিতে আদেশ দিল। কিন্তু দ্বৈপায়ন মুনি গান্ধরীকে বললেন এই মাংসপিণ্ড থেকে মহাশক্তিধর একশত বীরের উৎপন্ন হবে। দ্বৈপায়ন মুনির বরে তাই হল। ওদিকে অক্ষম পাণ্ডর স্ত্রী কুন্তী দেবী ধর্ম্মরাজকে ভজনা করে যুধিষ্ঠির, পবন দেবকে ভজনা করে ভীমসেন, ইন্দ্রদেবকে ভজনা করে অর্জুন এর জন্ম দেন। 

অর্জুন, কুন্তি দেবীর তৃতীয় পুত্র। তবে পান্ডুর ঔরসজাত নন (কারণ, পান্ডু ছিলেন সন্তান উৎপাদনে অক্ষম), তিনি হলেন দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসজাত। তিনি দ্রৌপদীকে বিয়ে করেছিলেন। তবে তিনি একা নন। পাঁচ ভ্রাতা মিলে দ্রুপদ রাজের কন্যা দ্রৌপদীকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর শর্ত ছিল দ্রৌপদী (কৃষ্ণা) যখন কোনো ভ্রাতার সঙ্গে নিভৃতবাসে থাকবেন তখন অপর চার ভ্রাতার যে কেউ শয়ন কক্ষে অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। যদি করেই ফেলে তবে শাস্তি স্বরূপ তাকে ১২ বছরের বনবাসে যেতে হবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে এক ব্রাহ্মণের গোধন রক্ষার্থে অস্ত্র আনতে অর্জুন ভ্রাতা যুধিষ্ঠির ও ভার্যা দ্রৌপদীর শয়ন কক্ষে প্রবেশ করনে। এজন্য অর্জুনকে বনবাসে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তিনি বনবাস বা ব্রহ্মাচর্য কোনোটাই পরিপূর্ণভাবে পালন করেননি। ঐ সময়ে তিনি চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদা এবং কৃষ্ণ ভগিনী (বোন) সুভদ্রাকে হরণ করে বিয়ে করেন। আর কৌরব্যনাগের কন্যা উলুপীর আমন্ত্রণে তার সাথে সহবাস করেন। উলুপী পূর্ব-বিবাহিতা ছিলেন বলে প্রথমে তিনি তাকে বিয়ে করেন নি। অবশ্য পরে তাকে পত্নীর মর্যাদা দিয়েছিলেন।
(সুত্র : কাশীদাসী মহাভারত- মহামুনি বেদব্যাস প্রণীত মূল সংস্কৃত থেকে পন্ডিত কাশীরাম দাস কর্তৃক বাংলায় অনূদিত, বেণীমাধব শীল ও প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায় কাব্যরত্ন কর্তৃক সম্পাদিত, মহাভারতের কাহিনী- বিধায়ক ভট্টাচার্য সম্পাদিত, পৃষ্ঠা নং- ১২১০-১২১৪ এবং মহাভরতের চরিতাবলী- সূর্যদাস গুপ্ত, অবলম্বনে)

- বনবাসে আরো দু'খানা বিয়ে করে তিনি কি নিয়ম ভঙ্গ করেননি। আর দেবতারাই যখন নিয়ম ভাঙ্গে তখন ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? 
অর্জুন যে পান্ডুর ঔরসজাত নয় সে বিষয়ে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে তারই পুত্র বভ্রুবাহন। মা চিত্রাঙ্গদার আদেশে বভ্রুবাহন পিতা অজর্ুনের কাছে গেলন (যজ্ঞের অশ্ব ধরার অপরাধ স্বীকার করার জন্য)। নিজেকে অর্জুনের পুত্র হিসেবে দাবি করাতে অর্জুন লাথি মেরে - "- পুত্র বভ্রুবাহনকে ফেলে দিয়ে বললেন : 
- নটীর সন্তান, কাকে তুই পিতা বলছিস? দূর হয়ে যা আমার সম্মুখ থেকে। আমি কোনো কাপুরুষের পিতা নই। 
- তবু বভ্রুবাহন হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিনীত কন্ঠে বললেন- তিরস্কার করবেন না পিতা। আমি নিশ্চিত করে বলছি-তৃতীয় পান্ডু আমার পিতা। চিত্রাঙ্গদা আমার জননী। 
- তখন হংসধ্বজ আর নীলধ্বজ রায় অর্জুনকে বললেন- এভাবে তোমার পুত্রকে লাথি মারা উচিত হয়নি। ও তো এসেছিল তোমাকে পুজো করতে। 
- অর্জুন সক্রোধে বলে উঠলেন : না, এই নটীর তনয় আমার পুত্র নয়। এ যদি আমার সন্তান হত, তবে বিনা যুদ্ধে আমাকে যজ্ঞের অশ্ব দিত না। 
সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন বভ্রুবাহন। দৃপ্ত কন্ঠে বললেন- মায়ের আদেশে আপনাকে প্রণাম করতে এসেছিলাম। আপনি আমাকে জারজ বলে গালাগালি দিলেন। জগৎ জানে কে জারজ। আপনার মা কন্যাকালে সন্তান প্রসব করেছিলেন। আপনারা পাঁচ ভাই পাঁচটি দেবতার ঔরসজাত সন্তান। কারণ আপনার পিতা (পান্ডু) ছিলেন পুরুষত্বহীন। আমার মা নটী নয়। কিন্তু আপনার মা কী?" 
(সূত্র : কাশীদাসী মহাভারত- মহামুনি বেদব্যাস প্রণীত মূল সংস্কৃত থেকে পন্ডিত কাশীরাম দাস কর্তৃক বাংলায় অনূদিত, বেণীমাধব শীল ও প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায় কাব্যরত্ন কর্তৃক সম্পাদিত, মহাভারতের কাহিনী- বিধায়ক ভট্টাচার্য সম্পাদিত, পৃষ্ঠা নং- ১২৩৭-১২৩৯, অবলম্বনে) 

-যে দেবতা নিজের ঔরসজাত সন্তানকে চিনতে পারেন না, নিজের স্ত্রীকে নটী বলে সম্বোধন করেন; আদৌও কি সে দেবতা হতে পারে? 
কুমারী থাকা অবস্থায় সত্যবতী জন্ম দিয়েছিলেন ব্যাসদেবের (মহাভারতের লেখক), পরক্ষণে মাতাকে খুঁজে না পেয়ে মহামতি লেখক নারী বিদ্বেষী কথার অবতারণা করেছেন মহাভারতে। সে যাই হোক, বিয়ে করার ক্ষেত্রে দেবতারা ছিলেন অত্যন্ত বেপরোয়া। তাই এমন ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা দেবতাদের জীবনী লক্ষ করলে দেখা যায় তাঁরা একজন নারীকে নিয়ে কখনই সুখী হতেন না- একের অধিক নারী বিয়েই ছিল দেবতাদের বৈশিষ্ট্য। শান্তনু, বিচিত্রাবীর্য, ভীম, অর্জুন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেব-ই উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ