মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১১

আব্দুল মান্নাফ ফিরে আসার পর

পঞ্চদশীর মধ্যরাতে সে যখন বাবুল এন্টারপ্রাইজ (ঢাকা- টু- ফুলবাড়ীয়া, নাইট কোচ) থেকে ডিস্ট্রিক বোর্ডের বড় রাস্তায় নামে তখন তার সামনে সে দেখতে পায় পাথারের বিস্তীর্ন ধানক্ষেত। পাথারের শেষে যেখানে কালচে সবুজ রঙের ঢেউয়ের মত অথবা মেঘের মত গ্রাম দেখা যায় সেটাই তার গ্রাম। সাং চিন্তামন। সেই কালচে সবুজ রঙের ঢেউ থেকে বেরিয়ে আসে এক আধটা করে তাল গাছ। পঞ্চদশীর চাঁদনী রাতে এতো আলো। সে ঠিকই দেখতে পায় দুরে সাং চিন্তামন। দেখতে পায় সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে গেছে যে সরু আলপথ সেটা। রাস্তা আরো সরু হয়েছে। মানুষ কোদাল দিয়ে কুপিয়ে তাদের জমির সীমানা বাড়িয়েছে। এই বিশ বছরে রাস্তাটা কমসে কম অর্ধেক কমে গিয়েছে। আগে একটা গরুর গাড়ি যেত আরামসে। এখন খুব জোর একটা সাইকেল যাবে। পাথারের পথ ধরে আধঘন্টা হাঁটার পর একটা বিড়ি ধরায়। কার্তিকের রাত হালকা শীত শীত লাগে। বিড়ি খেলে গা গরম হয়। এই ভাবে পাথারের সরু আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যে যখন তার বাড়ির উঠান পর্যন্ত পৌঁছে তখন তার মনে হয় গ্রামটা বদলায়নি তেমন। তবে তার বাড়িঘর বদলেছে।
সে যখন তার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে তখন ভেতর থেকে সাড়া শব্দ মেলেনা। কোহিনূর বেগম যখন ঘুমায় তখন তার দিন-দুনিয়ার খবর থাকেনা। আব্দুল মান্নাফ বিশ বছর আগে দেখা তার বউয়ের ঘুমন্ত চেহারাটা কল্পনা করে। দরজায় কড়া পড়ে আরো। সাড়া নাই আব্দুল মান্নাফ জানালার কাছে যায়। কোহিনূর বেগম। কোহিনূর বেগম! খোলেকতো দরজাটা ! খোলেক দিনি! এই হালকা শীতের রাতে কোহিনূর বেগম চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছিল। ঘুমের চেতনহীন পর্দা আর কাঁথার আবরন ভেদ করে কেমন করে ডাকটা তার কানের পর্দায় ঢুকলো জানি না। কোহিনূর ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠলো। গত বিশ বছরে অনেক পুরুষ তার জানালায় টোকা দিয়েছে। কোহিনূর দরজা খোলেনি বরং তার বিছানার তলে রাখা, দাওটার বাঁট শক্ত করে ধরে থেকেছে। শুয়োরের বাচ্চা কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। তবু দরজা খোলেনি। এখন তার কানে যেন বিলের ঠান্ডা বাতাস চালিয়ে দিয়েছে কেউ। এ কার গলা ? দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এক দৌড়ে দরজার কাছে আসে কোহিনূর বেগম। ছিটকানি খুলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় কোহিনূর বেগম। মাটিতে পড়তে পারেনা ধরে ফেলে আব্দুল মান্নাফ। 
আব্দুল মান্নাফ যখন নিরুদ্দেশ তখন তার ঘরে কোহিনূর বেগম এবং তার দুই বাচ্চা। একটা আব্দুল করিম আর একটা রহিমা বেগম। আব্দুল করিমের তখন চারবছর আর রহিমা বেগম তখন কোলে। দুধ খায়। যে রাতে আব্দুল মান্নাফ ফিরে আসে তার পরদিন সকালে সে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। চব্বিশ বছরের জোয়ান আব্দুল করিম ঘরের বারন্দায় বসে থাকে। বাপ ঘুম থেকে উঠলে দেখা হবে। আব্দুল করিম বসে থাকে দোকানে যায় না। আব্দুল মান্নাফ ঘুম থেকে ওঠে বারান্দায় আসে। ফ্যালফ্যাল করে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। চুলার পাড় থেকে দৌড়ে আসে কোহিনূর বেগম। করিমের বাপ এটা তোমার বড় ব্যাটা করিম। কোহিনূর বেগম কেদেঁ ওঠে। আব্দুল করিম কাঁদে। আব্দুল মান্নাফ ও কাঁদে।
গ্রামের লোক খবর পায় আব্দুল মান্নাফ ফিরে এসেছে। বিশ বছর নাই হয়ে গিয়েছিল যে আব্দুল মান্নাফ সে ফিরে এসেছে। আব্দুল মান্নাফ বদলায়নি তেমন। সেই রকম লম্বা ঢাঙা আর তাগড়াই আছে। খালি বয়সটা একটু বেড়েছে। যারা বলত আব্দুল মান্নাফ ‘মরে গেইছে’ তারা ও আসে। যারা বলত, ‘আব্দুল মান্নাফ আরেকটা বিয়া করে ঢাকাত থাকে মুগাদপাড়া বস্তিতে’ তারা ও আসে। সবাই অবাক হয়ে আব্দুল মান্নাফকে দেখে। সবাই বলে ‘মান্নাফ ভাই কোটে গেছলেন? কোটে আছলেন এদ্দিন?’ আব্দুল মান্নাফ একটা শ্বাস ফেলে। রহস্যময় একটা অভিব্যক্তি আনে চোখে মুখে। তারপর বলে’ ‘কইম কইম’ সোগ কথাই কইম। ধৈর্য ধরেন। তোর ক্যাংকা আছেন ? উপস্থিত জনতা একেকজন একেক রকম উত্তর দেয়। তারা দেখে দুরে কোহিনূর বেগম কান্দে। এমন শক্ত বেটি ছোলটাকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি। আজ অবাক হয়। পাড়ার মন্তাজ আলী বলে, ‘মান্নাফ ভাই, ভাবীর নাকান মানুষ হয়না, আল্লা নিজ হাতে বানাইছে বাহে! কেংকরি যে বিশটা বছর কাটালো, ছোল গুলাক মানুষ করল ! করিমেক দোকান করে দিল। রহিমাক বিয়া দিল। এ্যাংকা বেটিছোল আল্লা সবাক বানায় না।’ আব্দুল মান্নাফ শোনে কি শোনে না বোঝা যায়না। সে নিঃশ্বাস ছাড়ে।
রহস্য ঘনীভূত হয়। আব্দুল মান্নাফ দ্বিতীয় দিনে ও বলেনা সে এত দিন কই ছিল। শুধু বলে, ‘কোইম কোইম সোগই কইম।’ কোহিনুর বেগম কিছু জিজ্ঞেস করেনা। সে খালি নানা রকম খাবার বানানোর আয়োজন করে। ভাপা পিঠা ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে খেতে পছন্দ করতো মান্নাফ। কোহিনুর তার আয়োজন করে। আব্দুল করিম দোকানে যায় আর বাড়ি ফিরে এসে বারান্দায় বসে থাকে। বাপের দিকে তাকায়। ‘আব্বা আপনে কোটে গেইসলেন।’ আব্দুল মান্নাফ কিছু বলেনা। খালি শ্বাস ফেলে। 
মানুষ আসতেই থাকে। বিশ বছর ধরে নাই হয়ে যাওয়া মানুষ আবার কেমন করে ফিরে আসে তাই বলতে থাকে মানুষ জন। ঘটনাবিহীন গ্রামীন জীবনে এটা একটা অনেক বড় ঘটনা ।অবশেষে আব্দুল মান্নাফ মুখ খোলে। 
“হইছে কি ? মুই রিকশা চলবা গেনু কুমিল্লাত। আমীরুদ্দির সাথে। রিকশা চলাতে চলাতে একদিন হৈল কি..... ?’ আব্দুল মান্নাফ অনেক রসিয়ে রসিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে গল্প বলতে থাকে। ঘটনা টা আমরা আমাদের ভাষাতেই বলি। 
আব্দুল- মান্নাফ বলতে চায় সে কুমিল্লায় গিয়েছিল রিকশা চালাতে। সংসারে অভাব। বউ বাচ্চাকে খেতে দিতে পারেনা। তাই অনেকের মত সে ও আমিরুদ্দীর সাথে কুমিল্লা গিয়েছিল রিকশা চালাতে। এক রাতে দুজন যাত্রী তাকে নিয়ে যায় এক নির্জন এলাকায়। সেখানে তারা দুজন রিকশা থেকে নেমে জোর করে তাকে বেঁধে ফেলে। তারপর ইনজেকশন পুশ করে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর সে দেখে সে সমুদ্রের মাঝখানে এক নির্জন দ্বীপে। অল্প কিছু মানুষ। তারা সমুদ্রের মাছগুলো কেটে শুঁটকি বানায়। আব্দুল মান্নাফ কে এই কাজে লাগানো হয়। মাঝে মাঝে তাকে দরিয়ায় নিয়ে যায় মাছ ধরতে। 
ট্রলারে করে মাছ ধরে আর শুঁটকি বানায়। মাঝে মাঝে সমুদ্রে ডাকাতি করতে ও নিয়ে যায়। আব্দুল মান্নাফ ডাকাত হয়ে যায়। অবসরে শুটকি মাছ বানায়। আব্দুল মান্নাফ তাদের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে। মানুষ গুলোর মন গলেনা। আব্দুল মান্নাফ উপায় খুঁজতে থাকে কি ভাবে পালানো যায়। দুবার পালাত গিয়ে ধরা পড়েছে। তারপর সেই রকম মার। এভাবে দশবছর। তারপর একদিন একটা জাহাজে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বার্মিজ কোস্টগার্ডদের হাতে। বর্মা দেশের জেলখানায় কাটে তার দশ বছর। তারপর ছাড়া পেয়ে আজ সে এই খানে। ফুলবাড়ী থানার চিন্তামন গ্রামে।
এই হলো আব্দুল মান্নাফের গল্প। এমন রোমাঞ্চকর গল্প গ্রামের মানুষ অনেকদিন শোনেনি। মান্নাফের মেয়ে রহিমা বেগমকে খবর দেওয়া হয়। গ্রামের মানুষ প্রতিদিন দু চারজন দশজন করে আসে তার সাথে দেখা করতে। আব্দুল মান্নাফ জমিয়ে গল্প করে। ‘একদিন কি হৈল....মুই গেনু ... মানুষ মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনে। দশদিন পনর দিন যায়। আব্দুল মান্নাফ খালি গল্প করে, খায় আর ঘুমায়। মোড়ের চায়ের দোকানে যায় সেখানেও এই গল্প। প্রতিদিন তার গল্পের ভলিউম বাড়তে থাকে। গালপালা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে রোমাঞ্চের উপাদান।
গ্রামের মানুষ মান্নাফ কে বলে কিভাবে তার বউ তার এই নিরুদ্দেশ কালে একা খেটে খুটে তার ছেলেটাকে মানুষ করে। মেয়েটাকে বিয়ে দেয়। নতুন দুটা ঘর ও তোলে। কোহিনুর বেগম মানুষ না দেবী। আব্দুল মান্নাফ এই গল্প খুব একটা শুনতে চায়না। সে তার গল্প বলে যায়।
সে এক দ্বীপ। চারদিকে সারি সারি নারিকেল গাছ। তারপর পানি, পানি আর পানি... ... ... দু একজন বেরসিক শ্রোতা তার গল্পের মাঝখান দিয়ে বাম হাত ভরে দেয়। দু একজন কাউন্টার কেশ্চেন করে। গল্পে যেন তাদের বিশ্বাস আসে না। মান্নাফ বিরক্ত হয়। গল্প থামিয়ে দেয়। মানুষ গুলো তখন হা হা করেওঠে।“ আহা হা কন না, কন না মান্নাফ ভাই। ওই হামেদ আলী তোরা বেশী কথা কন বাহে”।
এর মধ্যে একদিন তো একজন বলেই বসে ‘আপনে যে এত গল্প মারিচ্ছেন। ইদ্দ্রিস চাচাতো কোলো আপনি নাকি ঢাকা শহরত গেইসলেন। অটে একটা বিয়া করিসেন। চাচা নাকি নিজের চোখে দেখিছে, মুগদা পাড়া বস্তিত নাকি আপনার এ্যটা বউ আছে। দুটা ব্যটাও আছে।’ 
কোন চুদির ভাই কয়রে, মান্নাফ মুখ খারাপ করে। ক্ষেপে গিয়ে হুশজ্ঞান থাকেনা। 
একদিন রহিমা বেগম আসে তার স্বামীকে নিয়ে। বাপ ফিরে এসেছে শুনে সে তার ভারী পোয়াতী শরীরটা নিয়ে আসে বাপের বাড়িতে। আধারাস্তা কাঁদতে কাঁদতে আসে। ঘরের দাওয়ায় তখন মান্নাফ বিড়ি ফুঁকতেছিল। বাপকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে রহিমা। মান্নাফের চোখে পানি আসে। মেয়েটা এমন মায়াবতী হয়েছে ঠিক মান্নাফের মায়ের মত। বাপ মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। দুপুরে খাওয়ার পর রহিমার স্বামী শ্বশুরের সাথে গল্প করতে বসে। বিষয়বস্তু তার ধানচালের ব্যবসা, ধানের দাম, সারের দাম, মিলের খরচ ইত্যাদি। তারপর আবার সেই প্রশ্ন আব্বা এই বিশ বছর আপনে কোনঠে ছিলেন। আব্দুল মান্নাফ নড়ে চড়ে বসে। বিড়িতে লম্বা দম দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর শুরু করে হোল কি ... ...। মুই কুমিল্লাত যাওয়ার দুইদিনের মাথায় .. .. ..। ছোটদিনের দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। কোহিনূর বেগম চুলার পাড়ে বসেছিল রাতের খাবারের আয়োজন করতে। চুলা থেকে আধপোড়া একটা চেলাকাঠ নিয়ে দৌড়ে আসে আব্দুল মান্নাফের সামনে। চুপ করেন, চুপ করেন .. .. ..আর একটা কথা কোলে .. .. ..। আব্দুল মান্নাফ বোকার মত তাকিয়ে থাকে তার বউয়ের দিকে। তার বউকে কালী দেবীর মত রুদ্র আর ভয়ংকর দেখায় রহিমার স্বামী থতমত খেয়ে যায়। শাশুড়ীর এই চেহারা সে কখনো দেখেনি।
রাতে আব্দুল মান্নাফ শুয়ে থাকে। ঘুম আসেনা। বিড়ি ধরায়। পাশে শুয়ে থাকে কোহিনুর। বিশ বছর আগে মান্নাফের বয়স ছিল পঁচিশ। এখন পয়তাল্লিশ। পুরুষ মানুষ হিসাবে এমন কোন বয়স নয়। আব্দুল মান্নাফের বুকটাকে সেই রকমই চওড়া আর শক্ত মনে হয়। কোহিনূরের কাছে। বুকের চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে সে বলে, ‘আপনে আমাক কথা দেন। ওগুলান গল্প মানুষেক আর কবেন না। করিমের বাপ, আপনে ফিরা আইছেন সেটাই বেশী। আপনের আর পালে যাওয়া লাগবে না। এখন তো আর হামার কোন অভাব নাই ও। কোহিনুর কাঁদতে থাকে। 
হঠাৎ আব্দুল মান্নাফ বদলে যায়। তার রোমাঞ্চকাহিনী কাউকে শুনা যায়না। কেউ জিজ্ঞেস করলেও অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। 
মাস ছয়েক পর সে আবার নাই হয়ে যায়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ