শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১১

মৌনতা এবং আহত টেবিল-মাছি


গভীর ঘুম থেকে জেগে রোষায়িত সমুদ্রের গর্জন শ্রুত হয়েছিল । মেয়েটি সঙ্গীহীন, হুইল চেয়ার ফোল্ড করা, ক্র্যাচে ভর দিয়ে উঠেছে সিঁড়িতে, হেঁটে হেঁটে এঘর থেকে ওঘর গেছে । কেউ কিচেনে হয়তো মসলা ফুটাচ্ছে, মেয়েটির জন্য ফুল বুনছিল কেউ । তীর্থ জাহাজ থেকে নেমে আসে বংশধর। অরণ্যে হরিণের খাড়া কান, যাবতীয় দু:খ পিষে লাল ঝরিয়ে একদল ষাঁড় তাড়া করছে। আগেও তার জন্য কেউ থাকে নি। ক্যালেন্ডার পিছিয়ে পিছিয়ে তখন সে বর্তমান। বহুদিন মেয়েটি কথামত গাছের নিচে ভিজেছে। তুতের মিষ্টি হাতরুটি খেয়ে শান্ত কোকুন রেশম বুনে গেছে। সেই কীট ডানা মেলে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে । অন্যরা যদি হেটে যেত, তাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটত। সে থামত। ভালবাসত। পাথরে পা ভিজিয়ে সহস্নান পেলে একান্ত হয়ে বসত ফাউন্টেন তলায়। হার্মনি-কোরাস-অর্কেস্ট্রা বাজছিল দ্বৈতসুরে । সে দেখেছে ঘুণের শিল্পীরা পিতৃপুরুষের সখের পিয়ানো খেয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। ভাল লাগায় আচ্ছন্ন করে বহুদিনের বাড়ির পলেস্তার কেটে নিচ্ছে নুনের করাত। 

জেগেই দেখছে পৃথিবীর এই প্রান্ত বড় খালি। বন্ধুরা উঠে যাচ্ছে মই বেয়ে। রমণীরা জলকেলি সেরে এটেল কাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে খেলছে শিশুদের নিয়ে ।প্রেম এবং জননাঙ্গের কাঁটায় রক্ত ওঠতেই প্রত্যাবর্তনে উড়ে যাচ্ছে উড়াল হাস। হয়তো ডুবে যাচ্ছে শহুরে শাপলায় যে জানলায় পর্দায় আবছা দেখা যায় সুখীদের। দেখা হওয়া পথের বহুমুখ। একটি মুখে দাঁড় করিয়ে অন্য মুখে চলে গেছে। কারো কারো মুখে ঘুমক্ষত, পাখিদের প্রসাধনী বিলের দর্পণে শুকিয়ে সাদা পানির দাগ। দীঘির চারপাশে বাঁধানো ছবির ফ্রেম কেবলই সাজানো ছবি; জড় এবং অচেতন।

অসূর্যস্পর্শ্যা সে । ঘর থেকে বের হয়নি কখনো। নির্জন ধ্যানরত মঠ-সন্ন্যাসীদেরও জীবন থাকে। জীবন জানান দেয় ধানের কীট, ডুবুরী কৈ মাছ, এবং হাওড়ের ভেজা সারস। মেঘেরা ক্রমাগত এঁকেছে সমুদ্রের ঢেউ। সেই ছবি শেখা হল না তার ব্যস্ততায়। চঞ্চুতে পালক খুঁটে পাখি যায়। ফিন ফিনে কষ্ট সরিয়ে। বস্তুত: বেদনা ও একাকীত্ব বরাবরই সমার্থক। আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চায় শুভসংবাদের জলে উপচে যায়। অন্যদিকে আয়নায় পুড়ছে শব্দসৈনিক। পাইক মাঠে পিঠ তুলে জানিয়ে দেয় বাস্তবিকই তা মিথ্যে। এছাড়া শত আবিষ্কারেও মহাজাগতিক সিঙ্গুলারিটিতে থেকে বিস্তৃতি আসেনি গ্রহাণুর। দেবীদের প্রার্থনায় কালপুরুষ। হাতে উল্কার ধনুক নিয়ে, যদিও পেশী ছিঁড়ে গেছে, শ্যেন দৃষ্টি, শশকের মত শ্রুতি এবং মৌমাছির ঘ্রাণ; কড়া আয়োজনে। 

মেয়েটি বড় একা। অণুজীবের মত ছিঁড়ে দুই খণ্ড হয় তার অহং। বিভাজনে যুগল হয়, স্বগতোক্তি হয়, সচল হয়। শতরঞ্জি বোর্ড ঘুরিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা বুড়ো লোকটি যেমন বড়ে দিয়ে বড়ে কাটে। আড়াই ঘোড়া লাফিয়ে পড়ে অতীতের মাঠে, স্কুলের বেঞ্চিতে, জাম-রঙের বাল্যজিহ্বায় । নির্জনতায় শীষ দেয় খাঁচা-বন্ধ পাখি। সে একদিন দোলচেয়ারে দুলেছিল। রাতে। তারপর পোড়ামাটির সড়কে দুইশত সত্তর ডিগ্রী ঘুরে থামল মেয়েটি এক পরিত্যক্ত কোঠায়। দুরন্ত মৌসুমি হাওয়ায় চাল মুচড়ে নিচ্ছে সেই বৈশাখে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কাচ ভেঙে পড়েছিল আলোর স্পন্দনে। শাখা কাঁপছিল। হয়তো সন্ত্রস্ত সে দেখেছিল - কাটা লোমশ হাতটি ঢুকে গেছে কাঁথায়। কোন অশরীরী যেন দেয়ালঘড়ির রূপালী জিহ্বা টেনে খুলে আনছিল। তারপর বীভৎস হুঙ্কারে নষ্ট চঞ্চলতা রেখে স্থিরতাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। ফিরবে বলে সে ফিরছিল না। 

অবশ্য আমি দেখেছি জেলেদের জাল শুকানো। তাবিজের সৌভাগ্যে মাছ খুলে বায়োস্কোপ হয়। ছবি নড়ে। কুলায় ধানের তুষ ওড়ে, চুলায় সেদ্ধ সোনা। তারপর নদীর ভাঙন এলে মেজারিং টেপের স্বয়ংক্রিয় গুলতির মত সুড়ুত করে সমস্ত দৃশ্য ঢুকে যায় আদিম শূন্যতায়। শুনেছি নীল আগুন অপেক্ষাকে জ্বালা ধার দেয়। গন গনে যে আগুনে মস্কোর ঘণ্টার গলে যায়। তরল ধাতু পারদের মত বেয়ে বেয়ে নদী হয়ে যায়। আর ঘুম থেকে জেগেই মেয়েটি শুনেছিল উলুধ্বনি। সমুদ্রের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে মিলনসংকেত। দূর সাইপ্রাসে সমুদ্র মুঠো মুঠো বালি ফেলছিল উপকূলে। ঝড়ের ভয়ে অনেকবারই লুকোনোর ইচ্ছে হয়েছিল। পাতাল কক্ষে গুমরে ভেসে আসছিল হরিণের কান্না। কফির সাদা পেয়ালা এমনই। শ্বেত-গ্রন্থি থেকে মুক্তো ঝরে গিয়েছে। উপরে উঠে যাওয়া ক্ষণস্থায়ী। যেমন আকাশ ঘুড়ি নিয়ে শিশুদের মত খেলে। সুতোয় সুতোয় মন কষাকষি। একদিন ছিঁড়ে যাওয়া লেজ অসময়ে গাছের কোটরে ঢুকে যায়।

সংবাদ এসেছে। মাটি খুঁজে পাওয়া গেছে একটি পোড়ো বাড়ি। জড়ো হল উৎসুক জনতা। ফটকে অঙ্কিত বন-ময়ূর, কাঁটাতারের বেষ্টনী। এখানে একাকীত্ব আবিষ্কৃত হল মাটি খুঁজে। বাতাসের কঙ্কালে পাওয়া গেছে বহুযুগ আগের রোদ। আলোকচিত্রী ঢুকল। ঢুকে যাচ্ছে দীর্ঘ তামায় বয়ে যাওয়া ইলেকট্রনে। প্যান করে যাচ্ছিল সে বিধাতার দূত শোবার ঘরে। শুকিয়ে যাওয়া পাম-রোজ।সে থামল। দেখল বিস্ত্রস্ত করিডোর। রেফ্রিজারেটর খুলতেই একটা ক্ষীণ বাতি জ্বলে ওঠেছে। বাতাস পেয়ে ফ্রোজেন চামচিকা উত্তাপে কিচ কিচ উড়ে গেছে। অপেক্ষায় জমে গেছে কফির ধূম্র বাষ্প। কফি, কলম, চুলের বো পম্পেইয়ের লাভার মত সবই জমাট বাঁধা। সরে যাবে সে উপায় নেই বলে আছে। কাচের পিপা ভেঙে গেছে বালি-ঘড়ির। সুজির দানার মত বালি ছড়িয়েছে। তারপর সব শুন শান। নির্জনতার নিয়মকে কে ভাঙতে চায়? সবাই দেখছিল গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়ি থেকে কোকিল বের হয় নি, অথচ ভোর সমাগত। ধূসর সিলিং থেকে সুতো নামছে । আবারও সমুদ্রের শব্দ আসে। জীবন্ত শিশুদের কলরোলে ঢেকে যায়। কত বহুবিধ কথা, তন্তুতে পাক খেয়ে দুলছে তো দুলছে একটি আহত টেবিল-মাছি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ