মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১১

আমনের বাম্পার ফলন ॥ গুদামজাত করতে ব্যর্থ কেন সরকার? সুযোগ নিচ্ছে ফড়িয়া; তৈরী হচ্ছে সিন্ডিকেট। সরকারের সদিচ্ছা ও সক্রিয়তার অভাবে মরণ দশা হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক থেকে গণমানুষের।

দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস থাকলেও দাম না পেয়ে উদ্বিগ্ন তারা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে। অথচ কিছু দিন আগেও প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকারও ওপরে। বর্তমান বাজারদরে খুশি নন কৃষকেরা। এতে উৎপাদন খরচই উঠছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এ বছর দেশে আমনের ভালো ফলনে খুশি হলেও দাম নিয়ে স্বস্তি নেই কৃষকের। বাজারে নতুন ধানের দাম কম হওয়ার কারণে আনন্দকে যেন গ্রাস করেছে দুশ্চিন্তা। শেষ পর্যন্ত উৎপাদন খরচ উঠবে কি না তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে কৃষকের।
আলু ও পাটের নিম্নমুখী দামের মতো একই অবস্থা ধানের ক্ষেত্রে হলে কৃষকদের পরিণতি বড়ই করুণ হবে।
এ বছর আমন মওসুমে সরকার চার লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। আর দাম নির্ধারণ হতে পারে বোরোর সমদামে। অর্থাৎ ২৯ টাকা কেজি দরে।
এ বিষয়ে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, কৃষকদের সহায়তা দিতে আমন সংগ্রহের ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও স্থানাভাবে বেশি করে আমন সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ইতোমধ্যে সরকারের সব গুদাম চাল ও গমে ভর্তি। গত বোরো মওসুমে ছয় লাখ টন চাল সংগ্রহের কথা থাকলেও গত ৩০ অক্টোবর শেষ হওয়া বোরো সংগ্রহ অভিযানে আট লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টন চাল সংগৃহীত হয়েছে।
খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারি গুদামে মজুদের পরিমাণ ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬৭৫ টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ১২ লাখ ১৪ হাজার ৯৭৭ টন এবং গম রয়েছে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬৯৮ টন। এ ছাড়াা আরো প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল ও গম পাইপলাইনে রয়েছে। দুই লাখ টন গমের চুক্তি হয়েছে। এর ফলে সরকারের মজুদের পরিমাণ ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, গুদাম খালি হওয়া সাপেক্ষে এ বছর আমন সংগ্রহ করতে হবে। তবে যেহেতু চলতি অর্থবছরের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১২ লাখ টন চাল সংগ্রহের জন্য বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। সে হিসেবে আরো চার লাখ টন চাল আমন মওসুমে সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে। অথচ এ বছর আমন ধান মোট উৎপাদন হবে ১ কোটি ৩৫ লাখ টন।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাঠে মাঠে সমানতালে চলছে রোপা আমন ধান কাটা। কৃষকের উঠোন ভরে যাচ্ছে ধানে। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকরা খুবই খুশি। কিন্তু দুশ্চিন্তা তাড়া করছে উপযুক্ত ও ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে। আউশ ধানের দাম পায়নি কৃষকরা। রোপা আমন উৎপাদনে খরচ বেশি হয়েছে তুলনামূলকভাবে। বেশীরভাগ এলাকার মাঠে বোরো ধানের মতো কমবেশি সেচ দিতে হয়েছে। কৃষি উপকরণের মূল্যও বেড়ে গেছে।
সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ছিল হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৭ মেট্রিক টন চাল। সেখানে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর, খুলনা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় এবার উফশী ও স্থানীয় জাতের ৬ লাখ ৮২ হাজার ৬৮১ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্তি ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। সবমিলিয়ে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এবং সার্বক্ষণিক দৃষ্টি দেয়া ও পরিচর্যা করার কারণে ফলন হয়েছে বাম্পার। এই মুহূর্তে কৃষক পরিবারে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও বস্তাভর্তি করছে কৃষকরা। হাট-বাজারেও কিছু নতুন ধান তোলা হচ্ছে।
আর ক’দিন বাদেই ধান বিক্রির জন্য কৃষকরা ভিড় করবেন। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়, কৃষকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সুদখোর, দাদন ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, আড়তদার ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সাধারণত ধান উঠা মৌসুমে সাধারণ কৃষকদের ফাঁদে ফেলে নানা অজুহাতে কম দামে ধান কিনে ঠকানোর ফন্দি আঁটবে। বাজার তদারকি থাকলে সেই সুযোগ পায় না মুনাফালোভীরা।
তাই এখনই সরকারের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা উচিত। সরকার গত মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহ না করায় মুনাফালোভী ও মুজদদাররা একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। ধান সংগ্রহ হলে খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহকারী কর্মকর্তারাও ধান ভিজা, চিটা ও ঝিল-কাঁকরসহ নানা অজুহাতে সাধারণ কৃষকদের যাতে ফিরিয়ে না দেয়, তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সূত্র মতে, সরকারের খাদ্যগুদামে ধান ও চাল পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে শুধু আপদকালীন নয়, প্রয়োজনমতো বাজারে চাল সরবরাহ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সুবিধা হবে। এতে সিন্ডিকেট অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে যখন তখন ইচ্ছামাফিক দাম বাড়ানোর সুযোগ পাবে না। ১৯৬৪ সালের এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটস রেগুলেশন অ্যাক্ট ও ১৯৮৫ সালের সংশোধিত বাজার নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬ (১) ও ১৬ (২) ধারামতে কৃষিজাত ও ভোগ্যপণ্যের ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য ও মুজদ পরিস্থিতির তদারকির ক্ষমতা রয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরেরর জেলা বাজার কর্মকর্তাদের। কিন্তু বাস্তবে এ অঞ্চলের অধিকাংশ জেলাতেই বাজার কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
উল্লেখ্য, কয়েকদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ধান মাঠ থেকে উঠে যাবে। শুরু হবে আবার বোরোর বীজতলা তৈরি। ধানের দাম এখন একেবারাই কম দামের দিকটা খেয়াল না করলে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ