শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

আততায়ী শীত, এবং সিরিয়াল কিলার আমরা..



শ্রান্ত হয়েছে দিন ,
আলো হয়ে এল ক্ষীণ ,
কালো ছায়া পড়ে দিঘি-জলে ।
শীত-হাওয়া জেগে ওঠে ,
ধেনু ফিরে যায় গোঠে ,
বকগুলো কোথা উড়ে চলে ।
“শীত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ”

রবীন্দ্রনাথের বর্ণনার মতো এতো মনোহরিনী শীত এবার পড়েনি। এবার পড়েছে জমজমাট ‘নো ফ্রস্ট’ শীত। বরফ জমছে না কিন্তু লু লু হাওয়ায় সব কিছু যেন জমাট করে ফেলছে। মুভিতে দেখেছি, পুলিশ অপরাধীকে ধরার সময় বলে ‘ফ্রিইইইজ’। এবার যে হারে শীত পড়েছে তাতে আমাদের দেশের অপরাধী হলে বলতো, ‘জইমাই তো আছি।‘


হালকা চালে শুরু করলেও যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেছি সেটি মোটেও হালকা নয়। আসলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই পোস্টটি লিখতে বসেছি তাতে এর শুরুটি হওয়ার কথা ছিলো ভূপেন হাজারিকা সেই বিখ্যাত গানটি দিয়ে, “মানুষ মানুষের জন্যে...” কারণ হচ্ছে, এবারের আততায়ী শীত এবং শৈত্য প্রবাহ। সত্যি বলছি, এবারের মতো খুনে শীত আমি কোনবারই দেখি নি। খবরে পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম এবারের শীতকে খুনে, আততায়ী বলে একদম ভুল কিছু করিনি। কয়েকটি উদাহরণ দেই:

বিডি নিউজ২৪ লিখেছে, “শৈত্য প্রবাহ বইছে, ৫১ মৃত্যুর খবর” 

বাংলাদেশ বার্তা ডটকম বলছে, “কেশবপুরে শীতের তীব্রতায় শিশুকন্যাসহ ৬ জনের মৃত্যু “ 

বাংলানিউজ২৪ ডটকম জানাচ্ছে, “শীত তীব্র, ৭ শিশুর মৃত্যু রংপুরে “ 

আবার বিডিনিউজ২৪ ডটকম জানাচ্ছে, “'কুড়িগ্রামে শীতে ৪৮ ঘণ্টায় ৭ জনের মৃত্যু'” 
এরকম আরো ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে, প্রতিনয়ত ঘটছে। তবে এবারের শীত বুঝতে পেপার পড়া লাগে না। যে শীত পড়েছে সেটি নিজেকে দিয়েই হাড়ে হাড়ে (আক্ষরিক অর্থে)বুঝেছি। দুইটা/তিনটা গরম কাপড় একসাথে পরার পরও যে কাঁপুনি দিয়ে শীত আসে মনে হয় রিমান্ডে আছি। সারাদিন লেপের মধ্যে থেকেই যদি এই শীতকে রিমান্ড মনে হয়, তাহলে, এই শীতে যাদের পর্যাপ্ত শীত বস্ত্র নেই তাদের কাছে তো এই শীত জয়েন্ট ইন্টেরোগেশন সেলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আজ বাংলা ১০ই পৌষ, এরপরে আছে মাঘ। পৌষের শুরুরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে মাঘকে কি বলা যায়, গুয়ানতানামো বে??!!

অথচ, আমরা একটু সচেষ্ট হলেও কিছু অসহায় মানুষকে এই শীতের জয়েন্ট ইন্টেরোগেশন সেল থেকে বের করে আনা সম্ভব। ডিসেম্বর/জানুয়ারি মাসে আমরা তুলনামূলকভাবে অনেক অনাবশ্যকীয় ব্যয় করি। সাধারণত এই সময়টাতেই আমরা বেশী ট্যুরে যাই, থার্টি ফাস্ট উদযাপন করি, উস্কানিমূলক ঠান্ডা আবহাওয়ার অজুহাতসংক্রান্ত পার্টি তো আছেই। 

এ বছর আমরা বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী পালন করছি। মুক্তিযুদ্ধে যারা দেশকে অংশ নিয়েছে তারা তো তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলো এই দেশের জন্য। এই জন্যেই আমরা জন্মের পর দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীন দেশে জন্ম গ্রহন করলেই কি দেশের প্রতি দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আমি বলছি না যে আমরা দায়িত্বহীন তবে আসলে আমরা দেশ ও দেশের মানুষকে কতটুকু প্রতিদান দিতে পেরেছি? আমি জানি আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক। আমাদের দেশের সিস্টেমেও সমস্যা। তাই বলে জানালা বন্ধ করে বসে থাকবো? আমরা আমাদের মানসিক সীমাবদ্ধতার জানালা কিছুটা খুলে আমাদের কিছু উষ্ণতা ছড়িয়ে দেই শীতে কাঁপতে থাকা আমাদের ভাইয়ের কাছে, বোনের কাছ, মায়ের কাছে, বৃদ্ধ দাদুর কাছে অথবা শীতে নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেলা সেই ছোট্ট শিশুটির কাছে। 

আসুন না বিজয়ের এই চল্লিশতম বার্ষিকীটা আমরা একটু অন্যরকমভাবে পালন করি। যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আজ বিজয়ের চল্লিশ বছর পালন করছি, সেই ত্যাগের স্মরণে আমরাতো সামান্য কিছুটা স্যাক্রিফাইসতো করতেই পারি। সেই স্যাক্রিফাইসটা হতে পারে আমাদের থার্টি ফাস্টের পার্টি, হতে পারে এবারের শীতকালের জন্য বরাদ্দ কোন ট্যুর, অথবা যেকোন অনাবশ্যকীয় চাহিদা যেটি না করলে আমাদের জীবন থেমে থাকবে না। 

আমি এই ব্লগে সলজ্জ ভাবে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ত্যাগের ঢোল পেটাতে চাই। সেটি হলো, এই জানুয়ারিতে আমি বন্ধুদের সাথে বান্দরবান ট্যুরে যাওয়ার প্লান করছিলাম। এখন স্ট্যাটাস হলোঃ ট্যুর ক্যানসেল, ট্যুরের জন্য বরাদ্দকৃত টাকায় আমি সস্তা কম্বল এবং শীতবস্ত্র কিনবো। তারপর দিয়ে দিবো শীতার্ত মানুষের জন্যে। 

আমার মূল কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে, অথবা সামান্য স্যাক্রিফাইস করে এইসব শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই। সেটি ব্যক্তিগতই হোক আর কারো মাধ্যমেই হোক। আমরা যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনের মাধ্যমেই শীতবস্ত্র দেই না কেন, আমাদের মূল কাজ হলো সবাইকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা যে সবাই তার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে এগিয়ে আসুক। আমাদের সামান্য প্রচেষ্টা যদি গুটিকয়েক মানুষকে এই শীতের মরণকামড় থেকে রক্ষা করে তো ক্ষতি কি?

কিছু অসহায় শীতার্ত মানুষ, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চা, চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধ দাদু আমাদের দিকে চেয়ে আছে। কথা দিচ্ছি যে বিজয়ের এই মাসে আপনাদের সামান্য এই ত্যাগে যে নিঁখাদ আনন্দ পাবেন, আপনার টুডু (TO-DO) লিস্টে থাকা অনাবশ্যক ট্যুর অথবা পার্টির তা একরত্তিও কম নয়। 

শেষ করছি পবিত্র কোরআনের (৫:৩২) একটি উক্তি দিয়ে, “If anyone slays a person, it would be as if he slew the whole people: and if any one saved a life, it would be as if he saved the life of the whole people.”

“যদি কেউ কোন মানুষকে হত্যা করে, সে যেন পুরো মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আবার যে একজন মানুষের জীবন বাঁচালো সে সে যেন পুরো মানব জাতিকেই রক্ষা করলো।“

এই শীত যদি আততায়ী হয় তবে প্রতিবছর সেটি দেখেও না দেখার ভান করে, শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকে আমরা হচ্ছি সিরিয়াল কিলার! ভেবে দেখুন আপনার দিকে বাড়িয়ে দেয়া হাত আপনার হাতের উষ্ণতায় সিক্ত হবে, নাকি সে হাত না ধরে আপনি তাকেও এই শীতের মতো নিথর ও জমাট করে দিতে চান সেটি আপনার সিদ্ধান্ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ