শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১

দিনবদলের প্রতিশ্রুতির তিন বছর

মহাজোট সরকারের ৩ বছর পূর্ণ হলো। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের চরম দুর্নীতি ও দুঃশাসন এবং তদারকি সরকারের জরুরি অবস্থার বিপরীতে তারা দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভালো কিছু হবে এ আশায় এবং একই সাথে মানুষের সামনে রাজনৈতিক কোনো বিকল্প না থাকায় মানুষ তাদের ভোট দিয়েছিল। নির্বাচনে বিপুল বিজয় ও সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মহাজোটের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত করেছিল। ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে তারা অতীতের ক্ষত দূর করার কথা বলেছিলেন। তিন বছর শেষে অতীতের ক্ষত কতটুকু দূর হলো আর তাদের প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ স্বপ্নের পথে দেশ কতটা এগোলো এ প্রশ্ন সবার।
সরকারের ৩ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকারের সাফল্যগাথা প্রচার করা হয়েছে - দেশ শনৈ শনৈ উন্নতির পথে অগ্রসরমান বলে দাবি করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি, রপ্তানী আয়বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ইত্যাদি পরিসংখ্যান আর অংকের হিসাবে দেশের কথিত অগ্রগতির ফিরিস্তি আমাদের শোনানো হল। পরিসংখ্যান নিয়ে রসিকতা করে বলা হয়, মিথ্যা তিন প্রকার - মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান। হিসাবের মার-প্যাঁচের ফাঁকি নিয়ে মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা একটি বাংলা প্রবাদে তুলে ধরেছে, ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’। পরিসংখ্যান আর হিসাব যাই বলুক, আমাদের দেখার বিষয় জনগণের গোয়ালে কি আছে, কেমন আছে দেশের সাধারণ মানুষ।
এ আলোচনায় যাবার আগে আরেকটি কথা বলে নেয়া দরকার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে ৬%, মাথাপিছু আয় ৭৮০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, ২০২১ সালে মধ্যআয়ের (অর্থাৎ মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলার) দেশে পরিণত হতে তারা পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। বিনিয়োগ বাড়লে জিডিপি বাড়বে, জাতীয় আয় বাড়লে মাথাপিছু আয়ও বাড়বে। সুতরাং ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট ও নগরী, ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকার পদ্মা সেতু, টেলিকম-গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে উচ্চহারে নিশ্চিত মুনাফা লোটার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ, সস্তাশ্রমের লোভে ইপিজেড ও গার্মেন্টস শিল্পে দেশী-বিদেশী পুঁজি আকর্ষণ,ব্যয়বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের সংখ্যাবৃদ্ধি, ফাইভস্টার হোটেল-পর্যটন-বিনোদন খাতে বিনিয়োগ, রিয়েল এস্টেট-শেয়ারবাজার-মাল্টিলেভেল মার্কেটিং-ব্যাংক-বীমার প্রসার ইত্যাদি হতে থাকলেই জাতীয় আয় বাড়তে থাকবে।
এই উন্নয়ন দর্শনে ব্যক্তিখাতই হচ্ছে অর্থনীতির পরিচালিকা শক্তি, সরকারের ভূমিকা নিছক সহজীকরণ করা। তাই শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিদ্যুত-গ্যাস-পরিবহন-অবকাঠামো নির্মাণসহ যেসব দায়িত্ব এতদিন রাষ্ট্র পালন করেছে- তার সবকিছুই পিপিপি’র নামে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ টাকাওয়ালাদের মুনাফা বৃদ্ধিই দেশের উন্নয়ন।এই তথাকথিত উন্নয়নের ছিঁটেফোটা মাত্র ভাগ শ্রমিক-কৃষক-গরিব মানুষ পেতেও পারে। পক্ষান্তরে পিপিপি আর বেসরকারিকরণের জোয়ারে বিদ্যুত-গ্যাসের দাম বাড়বে, ব্যক্তিমালিকানাধীন সেতু ও রাস্তার টোল দিতে গিয়ে পরিবহন ব্যয় বাড়বে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দাপটে শিক্ষা-চিকিৎসা দুর্মূল্য হবে, হোটেল-এয়ারপোর্ট-হাউজিং নির্মাণের জন্য উচ্ছেদ হবে সাধারণ মানুষ। শেয়ারবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে কষ্টার্জিত সঞ্চয় খুইয়ে সর্বস্বান্ত হবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা, তাদের টাকায় পকেট ভরবে পুঁজির কারবারীদের। ইপিজেড ও গার্মেন্টসের প্রসারে মালিকদের লাভ বাড়ছে,আগামী দিনে আরো বাড়বে। আর শ্রমিক ন্যায্যমজুরির দাবি নিয়ে রাস্তায় নামলে পুলিশের গুলি খাবে, মাস্তান বাহিনীর ঠ্যাঙানি খাবে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন নয়। এই আয়বৃদ্ধি কার ঘরে জমা হবে -এ প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এখন দেখা যাক নির্বাচনী ইশতেহারে যে সকল প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল তাকে সামনে রেখে সরকার জাতি গঠনের কাজে সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলেছে-মহাজোট সরকারের প্রচারিত দিনবদলের ৩ বছর’ শীষর্ক ক্রোড়পত্রের এ দাবির মধ্যে সত্যতা কতটুকু ? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারের ৫টি বিষয় ছিল-দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দা মোকাবিলা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুত ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাস, সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এসব প্রতিশ্র“তি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা সাধারণ মানুষ নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। তবে এসব খাতের বর্তমান চিত্র, সংকটের কার্যকারণ ও সমাধানের পথ আলোচনার দাবি রাখে।
দ্রব্যমূল্য : বাজার কি বলে ?
ইশতেহারের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী দাম কমানো তো দূরে থাক, কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর হিসেবে গত ১ বছরে প্রধান খাদ্যপণ্যের গড়ে ২০.৩০% মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। গত দু’মাসে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার আরো বেশি। মোটা চালের কেজি এখন ৩৬-৩৮ টাকা, পিয়াঁজ ৪৫ টাকা, সয়াবিন তেল লিটার ১২৫ টাকার উপরে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, ভরা মৌসুমে কেন চালের দাম বাড়লো তা তাঁর সরকার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধির কারণ তাঁর এখনো অজানা।কিন্তু, ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিমতো মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ দেশবাসী গত ৩ বছর দেখেনি। বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের কখনো অনুরোধ করেছেন, কখনো ধমক দিয়েছেন, কখনো যৎসামান্য ওএমএস চালু করে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছেন যে সরকার দাম কমাতে খুব তৎপর। আর বাস্তবে টিসিবিকে নিস্ক্রিয় রেখে সরকার বাজার-নিয়ন্ত্রণ থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছে, রেশনব্যবস্থা চালু করে গরিব-নিম্ন আয়ের মানুষকে রক্ষার দাবি উপেক্ষা করেছে। এভাবে খাদ্যপণ্যের ব্যবসা সিন্ডিকেটের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে জনগণের পকেট কাটার সুযোগ করে দিয়েছে। বাজার মনিটরিংয়ের কাজ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেট লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। সম্প্রতি ভোজ্যতেল ও চিনি বিপণনে ডিও প্রথা বাতিল করে পরিবেশক নিয়োগের বিধান চালু করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের হাতে বাজারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকলে ডিলারশীপ, ডিস্ট্রিবিউটরশীপ-যাই করা হোক তা খুব একটা ফল দেবে না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় চালের দাম বাড়ার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এই বলে যে এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবে। মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ীদের আড়াল করে কৃষক ও ভোক্তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা-শাসকদের সেই পুরনো ‘ভাগ কর, শাসন কর’ কৌশলের পুনরাবৃত্তি। এর চেয়েও বড় কথা হল, বাজারে কৃষিপণ্য যে দামেই বৃদ্ধি হোক না কেন তার সুফল যে উৎপাদক কৃষক পায় না এটা বাংলাদেশে প্রমাণিত বিষয়।প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। অথচ মাত্র ৫% চাল আমদানী হয়। আরো বলা হয়েছে, গতবছর মানুষের আয় দেড়-দুইগুণ বেড়েছে। অর্থাৎ দাম বাড়লেও মানুষ কিনছে তো আওয়ামী লীগ-বিএনপি সব শাসকদের নিষ্ঠুর মন্তব্যের মধ্যে কি অদ্ভূত মিল! এরা জনপ্রতিনিধি, কিন্তু গরিব মানুষের জীবনযন্ত্রণা কি তারা অনুভব করেন ? সরকারের হাতে খাদ্যশস্যের স্বল্প-মজুদ সংকট বাড়িয়েছে। বর্তমানে সরকারি মজুদ মাত্র ৭ লাখ টন, বিশেষজ্ঞদের মতে থাকা উচিত অন্তত ১২ লাখ টন। অথচ সরকার এবার কৃষকদের কাছ থেকে আমন ধান কেনেনি। মূল্যবৃদ্ধি সমস্যার সমাধান খাদ্যপণ্যের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু, অর্থাৎ কৃষকের কাছ থেকে সরকার সরাসরি কিনবে এবং নির্ধারিত দামে জনগণের কাছে পৌঁছে দেবে। সরকার এ নীতি অনুসরণ করছেন না কেন?
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : অন্ধকার ভবিষ্যৎ
গত ৩ বছরে বিদ্যুৎসংকট কাটেনি। সরকারি ভাষ্যমতেই আসন্ন বোরো মৌসুমে লোডশেডিং বাড়বে। ২০১০ সালের শেষে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজনের সরকারি ঘোষণার মধ্যে ১০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এর পুরোটাই আসছে বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত এসব অস্থায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানির সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকার কিনবে প্রতি ইউনিট ৮ থেকে ১৪ টাকায়। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিডিবির উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য প্রতি ইউনিট ২.৩৭ টাকা। উচ্চদামে বিদ্যুতের ফলস্বরূপ ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। পিডিবি-র পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি ছয়মাস অন্তর ১২.৫০% হারে দাম বাড়িয়ে ২০১৩ সালের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ করা হবে। পিডিবি চেয়ারম্যান বলেছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর হলেও আগামী ৩ বছরে (২০১১-২০১৩) পিডিবি’র লোকসান হবে ৭,৩৫০ কোটি টাকা। আর দাম না বাড়ালে লোকসান হবে ২০,১৭৫ কোটি টাকা বিদ্যুতের দাম বাড়লে শিল্প-কৃষিপণ্য সবকিছুরই দাম বাড়বে। এভাবে সরকারি খাতে বিদ্যুৎউৎপাদন না বাড়িয়ে দ্রুত সংকট সমাধানের কথা বলে বেসরকারি খাতে Rental Power Plant বা Quick Rental Plant স্থাপনের নামে গ্রাহকদের পকেট কেটে টাকাওয়ালাদের মুনাফা নিশ্চিত করা হচ্ছে। বিদ্যুৎবিভাগের পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ৫ বছরে ১০,৬৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে যার মধ্যে ৬,৭৩৮ মেগাওয়াট অর্থাৎ মোট উৎপাদনের ৬৩% আসবে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে। এদিকে পিডিবির তথ্যমতে, গ্যাস সরবরাহের অভাবে সরকারি খাতে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। জ্বালানি ঘাটতির কারণে সরকারি খাতে স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে, অথচ জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে ব্যক্তিখাতের (ইত্যাদি) উৎপাদিত বিদ্যুৎ বেশি দামে কেনা হচ্ছে। এরমধ্যে সরকার ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করেছে। এই বিদ্যুৎ ভারত থেকে আনতে সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের খরচ হবে ১৪০০ কোটি টাকা যা দিয়ে দেশেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা যেত। আমদানিকৃত বিদ্যুতের দামও নির্ধারণ করবে ভারত।
সমগ্র জ্বালানিখাতেই চলছে একই নীতি। দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ২৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সরবরাহ হচ্ছে ১৯৮০ মিলিয়ন ঘনফুট । অনেক এলাকায় গ্যাসের চাপও কম। গ্যাসের অভাবে চুলা বন্ধ, শিল্পকারখানায় নতুন সংযোগ দেয়া হচ্ছে না, সিএনজি পাম্পগুলো দৈনিক ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হচ্ছে। অথচ গত তিন বছরে গ্যাসউত্তোলন বাড়াতে নতুন কোনো গ্যাসকূপ খনন হয়নি। সরকার ঘোষিত ফাস্ট ট্র্যাক কর্মসূচি অনুযায়ী সিলেট, তিতাস, মেঘনা, হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসউত্তোলন হার বাড়ানোর কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। সালদা নদী ও সেমুতাং-এ তিনটি উন্নয়নকূপের কাজ এখনো শুরু হয়নি। সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র শ্রীকাইল, কাপাসিয়া, মোবারকপুর, রূপগঞ্জ ও সদ্যআবিষ্কৃত সুনেত্রায় অনুসন্ধান কূপের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এসব প্রকল্পে ধীরগতির কারণ হল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের অধীন এসব প্রকল্পের জন্য সরকার অর্থবরাদ্দ করছে না। অথচ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ১০০০ কোটি টাকার ওপর জমা আছে। উপরন্তু এসব প্রকল্প বিদেশে কোম্পানিকে লিজ দেয়ার চক্রান্ত চলছে। সেটা যদি করতে নাও পারে তাহলে পিপিপি’র মাধ্যমে বেসরকারিখাতে ছেড়ে দেয়ার পায়তারা করছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো অথবা সরকারের বাইরে তৃতীয় পক্ষের কাছে বাজারমূল্যে গ্যাসবিক্রির অনুমতির দাবিতে বিদেশি কোম্পানিগুলো নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ স্থগিত রেখেছে। ইতোমধ্যে সরকার কেয়ার্ন এনার্জি ও শেভরনকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাসবিক্রির অনুমতি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানিকে নিস্ক্রিয় রেখে কৃত্রিম গ্যাসসংকট তৈরি করে বিদেশি কোম্পানির হাতে সমুদ্রের গ্যাসব্লক তুলে দেয়া হচ্ছে এমন চুক্তিতে যাতে ৮০% গ্যাস তারা পাবে এবং তরলায়িত গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে। কনোকো ফিলিপসকে সমুদ্রের গ্যাসব্লক পাইয়ে দিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও জ্বালানি উপদেষ্টার গোপন সমঝোতার খবর সম্প্রতি উইকিলিকস ফাঁস করেছে। বাংলাদেশে কর্মরত ৩টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি যারা বর্তমানে দেশের ৫৫% গ্যাস উৎপাদন করে, তাদের কাছ থেকে সরকার গ্যাস কেনে প্রতি হাজার ঘনফুট ২২৫ টাকায়; যেখানে বাপেক্স ও অন্য দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি থেকে যথাক্রমে ২৫ ও ৭ টাকায় গ্যাস পাওয়া যায়। ফলে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানি-নির্ভরতার সরকারি নীতির ফলে আগামীতে গ্যাসের দাম আরো বাড়বে। এদিকে জ্বালানিসংকটের অজুহাতে ফুলবাড়ি ও বড়পুকুরিয়ায় পরিবেশ ও জনবসতি ধ্বংসকারী উন্মুক্ত কয়লাখনির কাজ গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দেওয়ার পক্ষে তৎপরতা চালাচ্ছেন জ্বালানি উপদেষ্টা, মার্কিন রাষ্ট্রদূত, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও সংসদীয় কমিটি। উইকিলিকস প্রকাশিত তথ্যে এর প্রমাণ মিলেছে। ফলে জ্বালানিসংকট সমাধানের নামে দেশি-বিদেশি লুটেরাদের হাতে জাতীয় সম্পদ তুলে দেবার আয়োজনে ব্যস্ত মহাজোট সরকার। আর এখাতে কোনো দুর্নীতির বিচার যাতে না হতে পারে সেজন্য দ্রুত বিদ্যুৎসরবরাহ নিশ্চিত করার নামে সংসদে দায়মুক্তি আইন পাশ করানো হয়েছে।
গতিশীল দুর্নীতি
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন নিশ্চিত করা, কালো টাকা ও অনুপার্জিত আয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। বাস্তবে, বিরোধীদলের নেতাদের মামলা পরিচালনা ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। গত দুটি বাজেটেই ১০% কর দিয়ে কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতাসীনদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। সংসদসদস্যদের বিনাশুল্কে গাড়ি আমদানির সুযোগ পুনরায় চালু করা হয়েছে। সরকার প্রধানসহ দলীয় নেতাদের মামলা ঢালাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। সদ্যপ্রকাশিত টিআইবি রিপোর্ট অনুসারে বিচারবিভাগ, পুলিশসহ সরকারি সেবাখাতগুলোর ঘুষ-দুর্নীতি বেড়েছে বলে মানুষ আভিযোগ করেছে। দুর্নীতির বিশ্বসূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি ঘটেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাগামহীন চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির ঘটনা নিয়মিত পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। শিক্ষক-চিকিৎসকসহ সরকারি বিভিন্ন পদে নিয়োগবাণিজ্য চলেছে লাগামহীনভাবে যার সাথে প্রধানত যুক্ত সরকারিদলের নেতাকর্মীরা।
সুশাসন : আইনি বিশৃঙ্খলা
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। অথচ পুলিশের রেকর্ড অনুসারে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১১টি খুন ও ৫০টি ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। খোদ সরকারদলীয় এমপির বাসায়ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। নারীনির্যাতন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ক্রসফায়ার বন্ধের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। গত দুইবছরে বিচারবহিভূর্ত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত ২৪৩ জন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ দলীয় এমপি নুরুন্নবী শাওনের বিরুদ্ধে নিজ পিস্তলের গুলিতে যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যার অভিযোগের সুরাহা হয়নি। নাটোরে প্রকাশ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যাকারী আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে ১২ জন ছাত্র প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েক শত, ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক প্রশাসন এবং যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি’র কথা বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দিনেই পাবনায় এডিসি-এসপিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের মুক্তিপ্রাপ্তির ঘটনা থেকেই এক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যে ১৩,৩৫০ জন কর্মচারী নিয়োগ পাবে তাতে দলীয় লোকদের বাইরে কাউকে নিয়োগ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনের শাসন, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে জিয়ার স্বৈরশাসন অবৈধ ঘোষণায় শাসকদল যতটা উল্লসিত হয়েছে, সপ্তম সংশোধনী বাতিল ও এরশাদের বিচার করা উচিত মর্মে হাইকোর্টের রায়ে তাদের সে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। বরং সংবিধান লঙ্ঘনকারী পতিত স্বৈরশাসক এরশাদকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একই বিমানে রংপুর গিয়ে মঞ্চে পাশাপাশি বসে ভাষণ দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে ’৭২-এর সংবিধান কার্যকর করার সদিচ্ছা সরকারের দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে একদিকে দীর্ঘসূত্রতা এবং অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যে ‘প্রতীকি বিচারের কথা শেষপর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের আইনি স্বীকৃতি প্রদানের পথ তৈরি করা হচ্ছে কিনা-এ নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে।
পররাষ্ট্রনীতিতে সরকার মার্কিন-ভারতের প্রতি নতজানু নীতি নিয়ে চলছে। অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার, টিপাইমুখ বাঁধ, সমুদ্রসীমা ইত্যাদি বিষয়ে ভারত কোনো ছাড় না দিলেও ভারতকে বিনাশুল্কে ট্রানজিট প্রদান, ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি, উচ্চসুদে ও কঠিন শর্তে ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি ইত্যাদিতে সরকারের নতজানু তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা চলছে, অথচ সরকার জোরালো প্রতিবাদ জানাতে পারছে না।
দারিদ্র ও বৈষম্য : উন্নতির(!) লক্ষণ স্পষ্ট
দারিদ্র্যবিমোচনে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল দারিদ্র্যের হার বর্তমানের ৪০.৪০% থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। বর্তমানে ৬.৫ কোটি দরিদ্রের সংখ্যা ২০১৩ সালে হবে ৪.৫ কোটি। অথচ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০০৯ সালে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের মাত্রা এক শতাংশ বেড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের ৮১% পরিবারে দীর্ঘমেয়াদী খাদ্যঘাটতি রয়েছে।
বছরে ন্যূনতম ১০০ দিনের কর্মসংস্থান করে প্রতি পরিবারের একজন কর্মক্ষম বেকার তরুণকে চাকুরি দেয়ার অঙ্গীকার পূরণ করা হয়নি। ন্যাশনাল সার্ভিস নামে মাত্র ৭৫০০০ যুবককে ২ বছরের জন্য অস্থায়ী কাজ দেয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি পরিকল্পনা ঋণবিতরণ, আত্মকর্মসংস্থানে উৎসাহ প্রদান, প্রশিক্ষণ ও বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পাট, চিনি, কাগজসহ শ্রমঘন কৃষিভিত্তিক শিল্পবিকাশের উদ্যোগ নেই। যদিও পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করা হয়েছে।
গার্মেন্ট শ্রমিকসহ সব ধরনের শ্রমিক, হতদরিদ্র ও গ্রামীণ ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের জন্য রেশনিং চালুর ওয়াদাও বাস্তবায়িত হয়নি। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে তা মানুষের মতো বাঁচার উপযোগী নয়।
সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, অথচ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফি চালুর মাধ্যমে চিকিৎসা খরচ ৪ গুণ বাড়ানো হয়েছে।
যুগান্তকারী’ একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি করছে সরকার। কিন্তু সাধারণ, মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেন-এই তিন ধারায় বিভক্ত বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রেখে কিছু সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে মাত্র। পশ্চাৎপদ মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষায় জোর দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির শ্লোগান দেয়া হচ্ছে। অষ্টমশ্রেণীর পর কারিগরি শিক্ষাকে উৎসাহিত করে উচ্চশিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, একদিকে নতুন শিক্ষানীতি সংসদে অনুমোদিত হচ্ছে অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ফি-বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হচ্ছে, নতুন বছরে স্কুলগুলোতে উচ্চহারে ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে।
কৃষকরা বারবার বাম্পার ফলন ফলিয়েছে কিন্তু ফসলের ন্যায্যদাম পায়নি। সার-বীজের কৃত্রিম সংকট, সেচে বিদ্যুতের অভাব, ভেজাল সার-কীটনাশক ও ভেজাল বীজের দৌরাত্ম্য-এসব ঘটনায় বিএডিসি-কে সংকুচিত করে কৃষিউপকরণের ব্যবসা ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দেয়ার কুফল টের পাওয়া যাচ্ছে। সার, সেচের ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কৃষকরা পায়নি, সুফল ভোগ করেছে সার ব্যবসায়ী ও পাম্পের মালিক ধনী কৃষক। ফলে উৎপাদক কৃষক ও শ্রমিক জনগোষ্ঠী ন্যায্যমূল্য ও মজুরি যদি না পায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিসেবা সব কিছুর বেসরকারিকরণের ফলে মূল্যবৃদ্ধি যদি ঘটতে থাকে তাহলে হতদরিদ্রদের জন্য যৎসামান্য নিরাপত্তা জাল দিয়ে দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব নয়।
আন্দোলনই অধিকার আদায়ের পথ
দিনবদল, ডিজিটাল বাংলাদেশ, ভিশন ২০২১-ইত্যাদি কথামালায় যে আশাবাদ মানুষের মনে তৈরি করা হয়েছিল, গত ৩ বছরের অভিজ্ঞতায় তা ফিকে হয়ে এসেছে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে না। কারণ প্রধান বিরোধীদল হিসাবে পরিচিতি বিএনপি-জামাত জোটের অতীত দুঃশাসন মানুষ দেখেছে, বর্তমানেও জনজীবনের সমস্যা নিয়ে কোনো আন্দোলনে তারা নেই। বাস্তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধ ক্ষমতার মসনদের দখল নিয়ে, দেশ পরিচালনায় তাদের নীতি একই। গার্মেন্ট শ্রমিকের মজুরির আন্দোলন প্রশ্নে উভয়ের অবস্থানই মালিকদের পক্ষে। দু'দলই দুর্নীতির মাধ্যমে গ্যাস-কয়লা সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি-বিশ্বায়ন-বেসরকারিকরণ নীতি অনুসরণ করে পানি-বিদ্যুৎ-শিক্ষাচিকিৎসাসহ যাবতীয় পরিসেবা পুঁজিপতিদের ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে তারা একমত। সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব-দুর্নীতি-দলীয়করণে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়েও তাদের মধ্যে বিরোধ নেই। রাজনীতির মাঠে যতই যুদ্ধংদেহী ভাব থাকুক, সংসদ সদস্যদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ী আমদানি আর মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বাড়ানোর প্রশ্নে তারা একমত।
কিন্তু কালোটাকা নির্ভর দলগুলো জনগণের ভোট নিয়েই ক্ষমতায় যায়, অথচ দেশ পরিচালনা করে গণপ্রত্যাশার বিপরীতে দাঁড়িয়ে। কেন এমন হয়? আসলে ধনী-গরিবে, মালিক-শ্রমিকে বিভক্ত সমাজে ক্ষমতাধর পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থে দেশ পরিচালনা করতে গেলেই তা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যাবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক দর্শনের অনুসারী। সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দা ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী একই চিত্র দেখা যাচ্ছে- পুঁজিবাদী দেশগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে পুঁজিপতিদের প্রণোদনা প্যাকেজ, বেইল আউট দিচ্ছে অথচ সাধারণ মানুষের পেনশন-শিক্ষা-চিকিৎসার বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে, ছাঁটাই করছে। এর বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, পুয়ের্তেরিকো এমনি অসংখ্য দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে জনগণ। কিন্তু তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে বসে ভোটারদের আকাংক্ষার বিপরীতে বিল পাস করছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি-দুবৃত্তায়িত রাজনীতির এই দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে ছোট দলগুলো দুর্বল হলেও তারা ধারাবাহিকভাবে জনগণের স্বার্থে লড়াই করছে। মূল্যবৃদ্ধির কবল থেকে গরীব মানুয়কে রক্ষায় রেশন চালু ও সিন্ডিকেট দমনের দাবি তারাই তুলেছে, শ্রমিকদের ন্যায্যমজুরির আন্দোলনে সাধ্যমত পাশে ছোট দলগুলো দাঁড়িয়েছে। গ্যাস-কয়লা রক্ষায় ধারাবাহিক আন্দোলন করেছে। জনজীবনের প্রতিটি সংকটের প্রতিবাদে তারা সোচ্চার। শোষণ-দুর্নীতি-লুটপাটের এ সমাজে কালোটাকা-পেশীশক্তি-নির্ভর অসুস্থ রাজনীতির বিপরীতে মানুষের মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিত ছোট দলসমূহ। ঐক্যবদ্ধ সুস্থ ধারার নেতৃত্বে জনজীবনের সংকট নিয়ে লাগাতার গণআন্দোলনের পথে জনগণের শক্তি নির্মাণ করতে পারলেই মানুষের পরিবর্তন প্রত্যাশা ও উন্নততর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ