শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১

আহমদ ছফার কল্পকন্যা রওশন আরা

আহমদ ছফার রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রবন্ধের একটা প্রবন্ধের নাম কল্পকন্যা রওশন আরা।এই রওশন আরা এক বীর বাঙালী নারী।যে বুকে মাইন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলো পাকিস্তানি ট্যাংকের সামনে।

তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।প্রবন্ধে বলা আছে, তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে দুটি নাটক, কিছু গান ও কিছু কবিতা।

ছফা লিখেছেন,

এই বিক্রমশালী কন্যার তারিফ করে প্রমথ নাথ বিশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের চেয়ে অধিক লম্বা কবিতা লিখেছিলেন।আপনারা সকলেই একমত হবেন।বিশী মশায় উৎকৃষ্ট রবীন্দ্র ভক্ত ও নিকৃষ্ট কবি ছিলেন।সেই কারনে তার কবিতা আমার স্মৃতি ধরে রাখে নি।

আমাদের এই কন্যাকে নিয়ে নাটক লেখা হয়েছিল দু খানা।এক খানি লিখেছিলেন সিপিআই অন্যখানি কংগ্রেস।সিপিআইয়ের নাটকখানা রওশন আরা দিবসে অভিনীত হয়েছিল এবং কংগ্রেসের নাটকখানি ছিল রওশন আরার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত।

নাটকে যে গান গুলো ছিল তার উল্লেখ ও আছে কিছুটা প্রবন্ধে,

রওশন আরা বোনটি আমার/
কোন গায়েঁতে ছিলো তোমার ঘর/
সেথায় কি আজ বুটের তলে/
আকাশ বাতাস রৌদ্র জ্বলে/
ধু ধু করে পদ্মা নদীর চর/

অন্য গান,

শহীদ আমার ভাই ভগিনি/
শহীদ রওশন আরা/
তোমারা সবাই প্রানের আগুন/
চোখের ধ্রুবতারা/

রওশন আরা নিয়ে কতটা মাতামাতি হয়েছিলো তার একটা বর্ননা আছে,

সে সময়ে যাঁরা আনন্দ বাজার, স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, অমৃতবাজার এই সকল পত্র পত্রিকা পাঠ করেছেন; অল ইন্ডিয়া রেডিও র ধারাভাষ্য শুনেছেন তারা স্বীকার করতে কুন্ঠিত হবেন না ভারতে হালফিল যে কন্যাকে নিয়ে মাতামাতি করছে, তার চাইতেও রওশন আরার মরতবা কত বড় ছিল, কতো পবিত্র ছিলো!এই কন্যার শরীর ধূপের ঘ্রান দিয়ে তৈরী।কেননা কল্পনার কোমল উতস থেকেই তার জন্ম।কোনো কামগন্ধ তাকে স্পর্শ করে নি।

কেউ যদি বলে বসে ওহে আহমদ ছফা তোমার কথা মানব না।কারণ তুমি সত্যের মত কর মিথ্যা বল, মিথ্যের মত করে সত্য বলো।এই ধরনের নিন্দুকের মুখ বন্ধ করার জন্য আমি সংবাদ পত্র ঘেটে আস্ত আস্ত প্রমাণ হাজির করব।বলবো পড়ুন গিয়ে ৯৩ সালের হোসেন আলীর ডায়রী।মর্নিং সান পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।হোসেন আলী প্রথম ব্যাক্তি যিনি কলকাতার পাকিস্তান হাইকমিশনে বাংলাদেশের বাওটা উড়িয়েছিলেন।স্বাধীনতার পর তার পদোন্নতি হয় নি বলে যদি তার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হয়, সেক্ষেত্রে ভারতীয় পত্র পত্রিকা থেকে হাজার হাজার ক্লিপিং আপনাদের সামনে হাজির করব।আপনারা মেনে নিতে বাধ্য হবেন, আহমদ ছফা মিথ্যে বললেও স্বাক্ষ্য প্রমাণ রেখে মিথ্যা বলে।

এই সংবাদ্গুলোর একটি ছিল এরকম প্রখ্যাত কংগ্রেস নেত্রী অরুণা আসফ আলী একদল মহিলা সহ আগ্রা থেকে দিল্লী পদযাত্রা করেছেন এবং তার দলটির নাম রওশন আরা বাহিনী।রওশন আরা ব্রিগেড স্কোয়াড কতো যে গঠিত হয়েছিলো সে কথা কী আর বলবো।বেকার এবং স্থুলকায় মহিলারা একটি মনের মতো কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন।



এই রওশন আরার স্রষ্টা ছিলেন বিকচকান্তি চোধুরী।বিকচকান্তি আগরতলা সংবাদ নামে একটি পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন।পত্রিকায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উতসাহ মূলক অনেক মিথ্যা অপারেশন, গেরিলা হামলা ইত্যাদির কথা লিখতেন।ছফা লিখেছেন, যুদ্ধ লেগে যাবার পর সংবাদ এ ইয়াহিয়ার সৈন্যবদ করার চাকরিটা সে পেয়েছে।এ পর্যন্ত যতো ট্যাংক ধ্বংশ করেছে সবগুলো টোটাল দিলে দেখা যাবে দুই মহাযুদ্ধেও অতো ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।বিকচের বিক্রমশালী প্রতিভা।

একদিন বিকচ ফুলিজান নামক এক মেয়ের কাহিনী লিখে ছফা কে দেখান।ফুলিজান নামে ১৮ বছরের এক যুবতী বুকে মাইন বেঁধে পাক ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।অকুস্থলেই মেজর জেনারেলসহ তেইশ জন সৈন্য নিহত।

ছফা নামটা বদলে দিলেন রওশন আরা।আরো লাগিয়ে দিতে বললেন সে ইডেন কলেজে ইকোনোমিক্স অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, নারী সুইসাইড দলের নেত্রী,শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নি হয়।

পত্রিকায় ছাঁপা হল নিউজ।মানুষ মুগ্ধ হল রওশন আরার সাহসে।উদ্দীপ্ত হল মুক্তিযোদ্ধারা।একেক পত্রিকায় একেক সাংবাদিক তার মনের মাধুরী মিশিয়ে আকঁতে থাকলে রওশন আরার ছবি।

সেই থেকে রওশন আরা হয়ে উঠল জীবন্ত এক চরিত্র।

ছফা তার প্রবন্ধ শেষ করেছেন এরকম ভাবে,

রওশন আরার কথা কেউ বলে না আর।তার স্মৃতি বুকে নিয়ে এক আমি বসে থাকি।এই রকম একটি মেয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে জন্মাতে পারত।যদি যুদ্ধটা আমরা নিজেরা করতাম,যে কোনো সাধারণ মেয়ে রক্ত-মাংসের বীরাঙ্গনা হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারতো।তাকে নিয়ে কবি কালজয়ী কাব্য লিখতেন।হায়রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, হায়রে কল্পকন্যা “রওশন আরা”।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ