বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১১

‘কারাগার’-এর প্রতিপাদ্য হলো ‘সংশোধনাগার’। কিন্তু দেশের কারাগারগুলো যেন- দোযখের টুকরা; আর মহিলা ওয়ার্ড যেন- হাবিয়া দোযখের টুকরা। নীরব মানবাধিকার সংস্থা, নিঃশব্দ রাজনীতিবিদ এবং নির্বিকার সরকার। কারাগারে যে নারীরা চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের ‘টু’ শব্দ নেই কেন? প্রতিক্রিয়া নেই কেন? শুধু ইসলামের বিরুদ্ধেই কী তাদের যতসব আওয়াজ। অথচ ইসলামী মূল্যবোধ শুধু তথাকথিত মানবাধিকারের কথাই বলে না; বরং তার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে প্রতিটা প্রাণাধিকারের কথাও উচ্চরবে ব্যক্ত করে।

বিনাবিচারে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে থাকা বন্দির প্রতি অবিচারের শামিল। এই সর্বস্বীকৃত সত্যটি প্রশাসন, বিচারবিভাগসহ সকল বিভাগের নীতিনির্ধারক ও শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের জানা থাকা সত্ত্বেও বিচারের নামে এই অবিচার বাধাহীনভাবে বছরের পর বছর চলে আসছে। অতীতে সা¤্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকদের আমলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটত। কিন্তু স্বাধীন দেশেও নির্বিবাদে বিচারের নামে অবিচার কিংবা বিচারের নামে প্রহসনের ঘটনা ঘটতে থাকলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
হয়ত এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এখানে বিচারবিভাগ বা আদালতের দায়িত্ব বা দোষ কোথায়? পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট দফতর তদন্ত রিপোর্ট তথা চার্জশিট আদালতে দাখিল করার পর তো বিচারক বিচার করবেন। এ বক্তব্য আপত মধুর। পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট দফতর কেন চার্জশিট দিতে বিলম্ব করছে এবং কোর্টে কেন ১০/১৫ বছর ধরে এক একটি ফৌজদারি মামলা বিচার না হয়ে পড়ে থাকছে সেটা দেখার দায়িত্বও কোর্ট তথা বিচারকের আছে কিনা আমাদের সঠিক জানা নেই, না থাকলে থাকা উচিত। প্রায়শ দেখা যায় বিনাবিচারে আটক বন্দিদের হয়ে কেউ কোর্টে আবেদন করলে মামলাটি কোর্টে ওঠে। নতুবা শুধু ১০ বছর বা ২০ বছর নয়, বিনাবিচারে কারাগারের মধ্যে থেকে বৃদ্ধ হয়ে মারা গেলেও কিছু করার থাকে না। এমনতর অমানবিক ঘটনার ২/১টা নজির যে আমাদের দেশে নেই এমন নয়। তরুণ বয়সে জেলে ঢুকে বিনাবিচারে আটকে থাকতে থাকতে বৃদ্ধ হয়েছে এমন ঘটনাও অতীতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিনাবিচারে কাউকে জেলে আটক রাখা কথিত জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের ও বিরোধী। অথচ জাতিসংঘের অন্যতম সদস্য দেশ-বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিপন্থী এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

১৬ বছর জেলের ঘানি বিনা অপরাধে!
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সিরাজুল হক নামের এক ব্যক্তি ১৯৯২ সালে তার ছেলে শাহীন আহমদকে অপহরণের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলায় দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জেল খাটছে একই উপজেলার আবদুল মান্নান। তার এক ভাই ও এক বোন সাত বছর সশ্রম কারাদ- শেষে মুক্তি পেয়েছে। অথচ যাকে অপহরণের অভিযোগে মামলা হয়েছিল, সেই শাহীনকে গত বছর পুলিশ উদ্ধার করার পর জানা যায় মামলাটি ছিল সাজানো। আদালতে জবানবন্দিতে শাহীন জানায়, মান্নান বা তার পরিবারের কেউ তাকে অপহরণ করেনি। শাহীন উল্টো তার বাবা সিরাজুলের বিরুদ্ধেই হত্যা পরিকল্পনা করার অভিযোগ আনে।
কিন্তু এরপরও মুক্তি পায়নি হতভাগা মান্নান। কারাগারে থাকার সময় সে হারিয়েছে মা, স্ত্রী ও এক ভাইকে। শাহীন উদ্ধার হওয়ার পর সে মিথ্যা অভিযোগ থেকে রেহাই ও মুক্তির জন্য গত ২০ অক্টোবর কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সিলেটের জেলা ও দায়রা জজের কাছে লিখিত আবেদন করে। এর আগে ২৯ জুন সে আরেকটি আবেদন করেছিলে। মান্নান জেলা জজকে জানায়, আর্থিক অনটনের জন্য সে উচ্চ আদালতে যেতে পারেনি। এ অবস্থায় তাকে যেন মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই আবেদনে কোনো সাড়া মেলেনি। মান্নান এখন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিরাজুল হকের ভাইসহ কয়েকজন প্রতিবেশীর চক্রান্তে মামলাটি করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, মান্নানের ভূসম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া। এই চক্রের হাতে মান্নানের দুই ভাই খুন ও তিনবার তার বসতভিটায় আগুন লাগানোর অভিযোগ রয়েছে। সবশেষে তিনজনকে জেলে পাঠিয়ে চক্রটি তাদের বাড়ির একাংশ দখল করে নেয়।
আবদুল মান্নানের বাড়ি কানাইঘাটের লক্ষ্মীপুর (মণিপুর) গ্রামে। একই উপজেলার সিরাজুল হকের প্রথম স্ত্রী পিয়ারা বেগমের ছেলে শাহীন। শাহীন ছোট থাকতেই পিয়ারা বেগমকে তালাক দেয় সিরাজুল। এর পর থেকে শাহীন বাবার কাছে ছিল। পিয়ারা বেগম একসময় আবদুল মান্নানের ভাই আবদুল খালিককে বিয়ে করে শাহীনকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। এর পরেই একদিন নিখোঁজ হয় শাহীন। সকালে সবাই ঘুম থেকে জেগে শাহীনকে কোথাও খুঁজে পায়নি। তখন তার বয়স তিন-চার বছর।
১৯৯২ সালের ৬ নভেম্বর দায়ের করা অপহরণ মামলায় পিয়ারা ও মান্নানের পরিবারের সদস্যদের আসামি করা হয়। কানাইঘাট পুলিশ ১৯৯৩ সালের ৩১ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দেয়। সেখানে অপহরণের জন্য দায়ী করা হয় আবদুল মান্নান, তার ভাই আবদুল কাদির ওরফে আবদুল খালিক, বোন হোসনেয়ারা ও শাহীনের মা পিয়ারাকে। ১৯৯৪ সালের ৩১ জুলাই সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করে। এতে আবদুল মান্নানকে যাবজ্জীবন এবং আবদুল কাদির ও হোসনেয়ারাকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। পিয়ারা বেগম খালাস পেলেও রায় ঘোষণা পর্যন্ত ১৮ মাস জেলে থাকতে হয় তাকে।
আবদুল মান্নানের ভাই ও বোন কারাভোগ শেষে মুক্তি পেয়ে গত বছর ২৭ মার্চ জানতে পারে, শাহীন বিয়ানীবাজারের আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর (উত্তরপাড়) গ্রামের জামাল মিয়ার বাড়িতে কাজ করছে। এরপর মান্নানের ছোট ভাই ছালিক আহমদ বিয়ানীবাজার থানায় জিডি করলে পুলিশ শাহীনকে আটক করে কানাইঘাট থানায় হস্তান্তর করে। গত ৩০ মার্চ শাহীনকে সিলেটের মুখ্য বিচার বিভাগীয় হাকিমের আদালতে নেয়ার পর আদালত তাকে নিরাপদ হেফাজতে পাঠায়।
আদালতে শাহীনের জবানবন্দি : শাহীন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে জানায়, চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে সে জকিগঞ্জের পিয়াইপুর গ্রামের আজিজুর রহমানের বাড়িতে লালিত-পালিত হচ্ছিল। ১০-১২ বছর সেখানে থাকার পর সে একই উপজেলার ডেমার গ্রামের ময়না মিয়ার বাড়িতে বার্ষিক কাজের লোক হিসেবে চলে যায়। এ সময় পিয়ারা বেগম নামের এক মহিলা তাকে নিজের ছেলে হিসেবে দাবি করে। কপালে জন্মদাগ, মাথার আকার একটু বড় এবং দুই পায়ের দুই বৃদ্ধাঙুলি বাঁকা দেখে তাকে শনাক্ত করে মা ও নানি। এরপর সে তার মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি চলে যায়। খবর পেয়ে বাবা সিরাজুল হক তাকে নিয়ে যায়।
জবানবন্দিতে শাহীন জানায়, বাবার বাড়িতে সে কয়েক মাস ছিল। এক রাতে সে শুনতে পায়, বাবা সিরাজুল হক তার সৎমায়ের সঙ্গে বসে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। বাবা বলছিল, ‘এই ছেলের অপহরণের মামলায় অনেকের সাজা হয়েছে। এখন এর পরিচয় জানাজানি হলে আমাদের ক্ষতি হবে।’ শাহীন আদালতকে জানায়, পরদিন সে পালিয়ে নানির বাড়ি চলে যায়। এর দু-তিন দিন পর বিয়ানীবাজারে জামাল মিয়ার বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে যোগ দেয় সে। সেখান থেকে পুলিশ তাকে আটক করে। শাহীন পুলিশকে জানিয়েছিল, শৈশবে সিলেট শহরে তাকে পেয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় আজিজুর রহমান। তবে শাহীন তার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে আদালত বা পুলিশ কাউকে কিছু বলতে পারেনি।
সিরাজুল ও পিয়ারার বক্তব্য: মামলার বাদী সিরাজুল হক পাথরবাহী নৌকায় শ্রমিকের কাজ করে। গত বছর আদালতে জবানবন্দি দিয়ে সিরাজুল হক স্বীকার করে, আটক হওয়া শাহীন ‘সম্ভবত’ তারই ছেলে। মামলা সম্পর্কে সম্প্রতি তাকে প্রশ্ন করা হলে অসংলগ্ন কথা বলে সে। সিরাজুলের দাবি, এই মামলা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। মামলা করিয়েছিলো তার বড় ভাই আজিজুল হক (আজই), শাহীনের মা পিয়ারার বাবার খালাতো ভাই সফিকুর রহমান (ছফই) ও আতাউর রহমান (আতাই)। তারাই মামলার সব খরচ দেয়। সিরাজুলকে এক দিনও আদালতে যেতে হয়নি।
সিরাজুল হক বলেছে, ‘অনেক আগের ঘটনা বলে সব কিছু আমার মনে নেই। আমি তখন পাগল ছিলাম। আমাকে বাদী বানিয়ে চাচা ও আমার ভাই মামলা করেছে তাদের দুশমনি মেটানোর জন্য। এখন মনে হচ্ছে তারা (আসামিরা) বিনা দোষে জেল খেটেছে। ছফইরা এর আগে খালিকের দুই ভাইকে খুন করে। তাদের বাড়ি জ্বালিয়েছে। তাদের বাড়ি ও জমি দখলের জন্য এসব হয়েছে।’ পিয়ারা বেগম পরে আবার বিয়ে করে একই উপজেলার চরিপাড়া গ্রামের আবদুল মানিককে। পিয়ারা বলেছে, ‘আমি মা হয়ে ১৮ মাস জেল খাটলাম। অপহরণের মামলা করার আসল উদ্দেশ্য ছিল মান্নানদের বাড়ি দখল করা।’
মান্নানের ভাই আবদুল খালিক বলেছে: বিনা দোষে মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ সাত বছর জেল খাটা আবদুল খালিক বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছে, ‘যাকে অপহরণ ও গুম করার অপরাধে আমাদের সাজা হলো সে এখনো বেঁচে আছে। অথচ নির্দোষ বড় ভাই এখনো জেল খাটছে। এত কিছু করলাম, এত টাকা খরচ করলাম, বাড়ির বাঁশ-গাছ সব বিক্রি করলাম। সাংবাদিকরা লিখে নিল, পত্রিকায় ছাপা হলো, টিভিতে দেখাল কিন্তু কিছুই হলো না।’
শাহীন আটক হওয়ার পর নিরাপদ হেফাজতে ছিল চার মাস। এ সময় শাহীন ও তার বাবা সিরাজুল হকের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়। পরীক্ষার প্রতিবেদন আসে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। প্রতিবেদনে দু’জনের ডিএনএ’র সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ আছে। অভিযোগ আছে, প্রতিপক্ষ অর্থ ও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের মতো করে প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছে।
মানুষের এই মর্মবেদনার এমনই আরো এক চিত্র পাওয়া গেলো দৈনিক আজাদীর গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত এক খবরে। খবরে প্রকাশ, দোষী সাব্যস্ত না হয়েও পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই দরিদ্র উপজাতীয় নাগরিক বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে আটক রয়েছে। এদের মধ্যে খাগড়াছড়ির বটতলীস্থ গোলাবাড়ি এলাকার সিপ্রু মার্মা অপরজন দীঘিনালা বাঘাইছড়ির অশোক কুমার চাকমা। সিপ্রু মার্মা জেল খাটছে ১৫ বছর এবং অশোক চাকমা খাটছে প্রায় দশ বছর। দু’জনকেই গ্রেপ্তার করা হয় পৃথক পৃথক মামলায়; তবে অভিযোগ একই- হত্যার। দু’জনই দিনমজুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ