শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১১

।। আত্মজীবনী / নাজিম হিকমেত ।।

১৯০২ সালে জন্ম আমার
কখনও একবারের জন্যেও ফিরে যাইনি আমার জন্মস্থানে
পেছন ফেরাটা পছন্দ নয় আমার
তিন বছর বয়সে পাশার নাতি হয়ে চাকরি করেছি আলেপ্পোতে
যখন উনিশ, মস্কো কমিউনিস্ট ইউনির্ভাসিটিতে ছাত্র আমি
আমার উনপঞ্চাশে, মস্কোতে গিয়েছি চেকা পার্টির অতিথি হয়ে
আর চৌদ্দতে পৌঁছানো থেকেই আমি এ যাবত কবি
কেউ কেউ উদ্ভিদ ও মাৎস্য বিষয়ে সব কিছুই জানে
আমি জানি বিভক্তি বিষয়ে
কারও কারও অন্তর জুড়ে মুখস্থ থাকে সমুদয় তারাদের নাম
আমি আবৃত্তি করি সমুদয় অনুপস্থিতি
কারাগারে এবং গ্র্যান্ড হোটেলেও ঘুমিয়েছি আমি
চিনেছি ক্ষুধা এবং অনশন আর
দুর্ভিক্ষেরও পেয়েছি স্বাদ
আমার তের বছরে ওরা আমাকে ফাঁসিতে লটকাতে চেয়েছিলো
আটচল্লিশে দিতে চেয়েছিলো শান্তি পুরস্কার
দিয়েওছিলো সেটা
ছত্রিশে, ছয়মাস ধরে চারবর্গ মিটারের সিমেন্টের মেঝে ছিলাম আমি
উনষাটে প্যারাগুয়ে থেকে পালিয়ে মাত্র আট ঘন্টায় পৌঁছেছিলাম হাভানায়
লেনিনকে কখনও দেখিনি, ১৯২৪ এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কফিন দেখেছিলাম আমি
আর ১৯৬১ তে তার কবরটা দেখেছিলাম একটা বইতে
তারা আমাকে পার্টি থেকে উপড়ে ফেলতে চেয়েচিলো
কাজ হয়নি
পতনোম্মুখ মূর্তিগুলোর তলেও পিষ্ট হইনি আমি
১৯৫১ তে এক তরুণ বন্ধুসহ মৃত্যুর দাঁতের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম আমি
১৯৫২ তে, চারমাস চিৎপাত হয়ে শুয়ে থেকেছি ভগ্ন-হৃদয়
অপেক্ষা করেছি মৃত্যুর
ঈর্ষা করতাম সেই নারীকে, যাকে ভালোবাসতাম আমি
চার্লি চ্যাপলিনকে এক চুলও ঈর্ষা করিনি
ধোঁকা দিয়েছিলাম প্রিয়তমা নারীকে
বন্ধুদের আড়ালো কোনওদিনও কোনও কথা বলিনি আমি
পান করেছি তবে রোজদিন নয়
আমার রুটিরুজি অর্জন করেছি সততার সাথে কতই না আনন্দে
অন্যদের কবলে বিব্রত হয়ে মিথ্যা বলেছি আমি
কাউকে আহত না করার মত মিথ্যাগুলোই বলেছি
আবার অকারণেও মিথ্যা বলেছি বহুবার
ট্রেনে চেপেছি, বিমানে উড়েছি, গাড়িতে চড়েছি
অনেকেই এতোটা সুযোগ পায় না
অনেক মানুষ, এমনকী, অপেরার নাম পর্যন্ত শোনেনি
আমি গিয়েছি অপেরায়
আর ১৯২১ থেকে আমি ওইসব জায়গায় যাইনি, যেখানে অধিকাংশ লোক যায়
মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়, সিনেগগে, জাদু প্রর্দশনীতে
অথচ পাঠ নেবার জন্য আমার ছিলো কফি-হাউস
লেখাগুলো আমার, মুদ্রিত হয়েছে ত্রিশ কী চল্লিশ ভাষায়
আমারই তুরস্কে, আমারই তুর্কিদের জন্য ওগুলো ছিলো নিষিদ্ধ
ক্যান্সার এখনও গ্রাস করেনি আমাকে
আর এমটি ঘটবার লক্ষণও নেই কোনও
কখনই প্রধানমন্ত্রী বা ওই গোছের কিছু একটা হবো না আমি
আর আমি চাইও না ওসব জীবন
যুদ্ধেও যাইনি আমি
কিংবা শেষরাত্রে বোমা থেকে বাঁচবার গর্তেও ঢুকে পড়িনি কোনওদিন
বোমারু বিমানগুলোর নিচে হাঁটতেও হয়নি আমাকে
কিন্তু ষোল বছর বয়সেই প্রেমে পড়েছি আমি
কমরেডদের সাথে
এমনকী, আজকের বার্লিনেও আমি বেদনা-কর্কশ ডেকে যাচ্ছি একটানা
তবু বলতে পারি, মানুষের মতই বেঁচে ছিলাম আমি
এবং কেই বা বলতে পারে
কতদিন বাঁচবো আরও
আর কী কী ঘটবে এই জীবনে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ