শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১১

আবার গুপ্তহত্যা, দুটি লাশ !!!

রাজধানীর হাতিরপুল থেকে গত ২৮ নভেম্বর একসঙ্গে নিখোঁজ হয়েছিলেন ছাত্রদলের তিন নেতা-কর্মী। এরপর গত বৃহস্পতিবার মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে পুলিশ দুটি গলিত লাশ উদ্ধার করে।
এর মধ্যে একটি লাশ নিখোঁজ হওয়া তিন যুবকের একজন ইসমাইল হোসেনের। নিখোঁজ বাকি দুজনের স্বজনেরা গতকাল শুক্রবার রাত পর্যন্ত আরেকটি লাশ শনাক্ত করা নিয়ে দোটানায় ছিলেন।
পুলিশ ও স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ নভেম্বর রাতে রাজধানীর হাতিরপুল এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল আমিন ও মাসুম হোসেন নামে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে কলাবাগান থানায় দুটি জিডি করা হয়েছে। নিখোঁজদের স্বজনেরা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র‌্যাবের দিকে। তবে র‌্যাব এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায় এড়াতে পারে না। মানুষের মনে যে সন্দেহ তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে, তা দূর করতে হবে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই ঘটনা ঘটাচ্ছে।
মর্গে স্বজনদের ভিড়: গতকাল সকাল থেকেই মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে এই তিন যুবকের স্বজনেরা ভিড় করা শুরু করেন। দূরসম্পর্কের স্বজনেরা চিনতে না পারায় তাঁরা আবার কাছের স্বজনদের খবর দিয়ে নিয়ে আসেন। তাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গলিত লাশ দুটি পরীক্ষা করে দেখেন। এভাবেই দিন কেটে যায়। রাতে ইসমাইলের স্বজনেরা দাবি করেন, একটি লাশ ইসমাইলের বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন।
ইসমাইলের মামা আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, একটি লাশের পরনে নেভি ব্লু প্যান্ট, ছাই রঙের গেঞ্জি ও পা দেখে ইসমাইলের লাশ বলে প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। 
শামীম হাসানের ভাই সাইমুন হাসান বলেন, তাঁরা মুন্সিগঞ্জে দুটি লাশের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। এর একটি ইসমাইলের বলে শনাক্ত করেছেন তাঁর স্বজনেরা। আরেকটি লাশ শামীমের নয় বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন।
নিখোঁজদের একজন মাসুম হোসেনের স্ত্রী হাওয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, লাশ শনাক্ত করতে তাঁদের দুজন আত্মীয় মুন্সিগঞ্জে গেছেন। তবে তাঁরা শনাক্ত করতে পারছেন না। রাতে আরও কয়েকজন আত্মীয় লাশ শনাক্ত করতে যাচ্ছেন। কেঁদে ফেলে হাওয়া বেগম বলেন, ‘এই লাশ আমি ক্যামনে দেখব ভাই!’
মাসুম হোসেনের স্বজনেরা জানান, মাসুম ছাত্রদল করতেন না, ব্যবসায়ী ছিলেন। সাভারে তাঁর বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রির দোকান রয়েছে।
মাথায় গুলির চিহ্ন: মুন্সিগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান গত বৃহস্পতিবার মোল্লারচর এলাকার ধলেশ্বরী নদীতে কচুরিপানায় আটকে থাকা লাশ দুটি উদ্ধার করেন। মিজানুর রহমান বলেন, দুটি লাশই পাশাপাশি ভাসছিল, তবে একটির সঙ্গে আরেকটি বাঁধা ছিল না। লাশ দুটির হাত ও পা একই রকমভাবে লুঙ্গির কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। আবার পাটের রশি দিয়ে তাঁদের পেটের সঙ্গে সিমেন্টের বস্তা বাঁধা ছিল।
তাঁদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছে জানতে চাইলে উপপরিদর্শক বলেন, অন্তত সাত-আট দিন আগে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুটি মৃতদেহই প্রায় পচে গেছে, তাই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। তবে লাশের মাথায় গোল ও গভীর জখমের চিহ্ন রয়েছে। তা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, গুলি করে লাশ নদীতে ডুবিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সিমেন্টের বস্তা বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে লাশ ফুলে পচে বস্তাসহ ভেসে উঠেছে।
উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান বলেন, মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে থাকা লাশ দুটি শনাক্তের জন্য ঢাকা থেকে তিন পরিবারের লোক এসেছে। তবে তারা রাত পর্যন্ত সুনিশ্চিতভাবে লাশগুলো শনাক্ত করেনি। তারা অন্যান্য স্বজনের অপেক্ষায় রয়েছে।
যেভাবে ধরে নেয়: ইসমাইলের মামা আবদুল খালেক বলেন, গত ২৮ নভেম্বর বিএনপির লংমার্চের পর খুলনা থেকে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফেরেন ইসমাইল। ঘণ্টা খানেক পর ব্যবসার পাওনা টাকা ওঠাতে হাতিরপুল বাজারে যান। এরপর তিনি আর বাসায় ফেরেননি। আবদুল খালেক আরও বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাঁরা তিনজন সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় হঠাৎ একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। এ সময় মাইক্রোবাস থেকে আগ্নেয়াস্ত্রধারী ছয়-সাতজন সাদা পোশাকের মানুষ তাঁদের মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে হাতিরপুল ফলবাজারের পেছনের রাস্তা দিয়ে চলে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে কলাবাগান থানায় ডায়েরি করা হয়েছে এবং র‌্যাবকেও জানানো হয়েছে। তবে কেউ কিছু বলতে পারেননি।
শামীম হাসানের ভাই সাইমুন ইসলাম বলেন, রাজধানীর হাতিরপুল এলাকার মোতালেব প্লাজার সামনে থেকে র‌্যাব-৩-এর পরিচয়ে কিছু লোক শামীমকে ধরে নিয়ে যান বলে সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শী কিছু দোকানদার তাঁকে তথ্য দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মো. সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাব এই নামে কাউক আটক করেনি। এটাকে একধরনের অপপ্রচার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান জানান, আগামী ৪ জানুয়ারি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সভায় গুপ্তহত্যার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে, গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে কমিশন কী দায়িত্ব পালন করবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ