শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১১

আজ গজারিয়া স্বাধীন হয়



আজ ৯ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের একটি যুদ্ধের ঘটনা বলছি। মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ার স্বাধীনতা দিবস। মুক্তি বাহিনী আর মিত্র বাহিনী ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে ৬ ডিসেম্বর। অর্থাৎ, সে যেদিন বন্ধু রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন, সেদিন থেকে।

৮ ডিসেম্বর, গজারিয়ার মুক্তিবাহিনীর থানা কমান্ডার নজরুল ইসলাম এর নেতৃত্বে বাউসিয়া ফেরীঘাটে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি অবরুদ্ধ করেন। গজারিয়া থানার এলাকায় ঢাকা- চট্টগ্রাম রাস্তার উপর সামরিক চৌকীগুলো পাততারি ঘোটায়ে বাউসিয়া আর্মি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে। ঐ দিকে কুমিল্লা থেকে অগ্রসরমান মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর তাড়া খেয়ে দাউদকান্দিতে অবস্থিত বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী একটি লঞ্চ যোগে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। ৮ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনীর মহান সদস্যগণ পাকিস্তান হানাদার বহিনী ও এদশেীয় কুলাঙ্গার রাজার বাহিনীকে তিন দিক হতে অবস্থান নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানীদের ক্যাম্পের পূর্ব দিকে মেঘনা নদী। ও পারের দাউদকান্দী হতে কোন সাহায্য পাবার আশা নেই। কারন, তারা আগেই পলায়ন করেছে। নদীর ফেরীগুলো মুক্তি বাহিনীর নির্দেশমতো পল্টুন ছেড়ে চলে গেছে। রাত পোহায়ে সকাল হলো। মুক্তি বাহিনী নদীর পাড়ের কিনার ধরে উত্তর ও দক্ষিন দিক হতে ক্রলিং করে এগুচ্ছে । পশ্চিম দিকে বিস্তৃত মাঠের স্থানে স্থানে ব্যাঙ্কার থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উপর গুলি ছুঁড়ছে মুক্তিবাহিনীরা।

পাকিস্তানী সেনা বাহিনী যখন বুঝতে পারলো তাদের ঢাকা বা কুমিল্লা থেকে কোন সাহায্য পাওয়া সম্ভবনা নেই। তারা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়লো। তার ফলে, এলোপাথারি গুলি করতে লাগলো। এই সময় মুক্তি বাহিনীর বুদ্ধিমান কৌশলী কমান্ডারের নির্দেশক্রমে মুক্তিযোদ্ধারা যতটুকু সম্ভব কম গুলি ছুড়তে লাগলো। ছিটে ফাটা কয়েকটা গুলি ছুঁড়ে তাদের অবস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। তাতে ভয়ার্ত পাকিস্তানীরা এবং রাজাকাররা বেশুমার গুলাগুলি করছে। এতে তাদের মজুদকৃত গুলি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

৯ তারিখ সকাল। শীতের কুয়াশা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে একসময় পরিস্কার হয়ে য়ায়। এতোক্ষন কুয়াশার কারনে যা অস্পষ্ট ছিলে - এখন খোলা মাঠে দূর থেকে সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্যই হোক, বা আবেগের বশবর্তী হয়ে হোক, গ্রামে অবস্থিত হাজার হাজার নারী-পুরুষ লাঠি, বল্লম, কোচ, জুইত্যা,টেঁটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র হাতে ঘর থেকে বের হয়ে মাঠে নেমে আসে। উত্তর দিকের গ্রামের চর বাউসিয়ার মানুষ, পশ্চিম দিক থিকে চর বাউসিয়া , পশ্চিমকান্দী ও দক্ষিন কান্দীর জনগণ এবং দক্ষিন দিক থেকে চর বাউসিয়া, দক্ষিন কান্দী , ফরাজীকান্দীর ও বসুর চরের জনগণ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার উদ্যেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে মাঠে নেমে তিন দিকে হতে মুক্তকামী জনতার স্রোত মাঠে নেমে আসছে। তা দেখে পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা নিশ্চয়ই অতি মাত্রায় ভয় পেয়ে গেছে।

এরূপ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা নৌকা যোগে নদীর পার হবার লক্ষ্যে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় চাষীর চরের দিকে। কিন্তু বিধি বাম - নদীতে তখন কোন নৌকা বা অন্যকোন জলযান ছিল না। রাজাকাররা অস্ত্র ফেলে সবাই নদীতে ঝাঁপ দেয় এবং নদী সাতরিয়ে নদীর ওপার চাষীর চর ও চেঙ্গাকান্দীর চর হয়ে দাউদকান্দী পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা জনতার উল্লাস ধ্বণী ‘ জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত শব্দে দ্বিগুণ প্রেরণা লাভ করে ক্রলিং করে ক্রমান্বয়ে এগিয় যাচ্ছে শত্রুর ক্যাম্পের দিকে। বাউসিয়া ফেরী ঘাটের পাকিস্তানী সেনা বাহিনীদের ক্যাম্পের দিকে। কিন্তু ।আশ্চার্য তাঁরা যতই এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের প্রতি কোন গুলি ছোড়া হচ্ছেনা। কয়েকজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো ক্যাম্পে কোন সেনা বা রাজাকার নেই। তখন জনতা আর মুক্তি বাহিনীর যুবারা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস উন্মাতাল করে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত ক্যাম্পের অবস্থানে।

এরই মধ্যে পাকিস্তানীরা নদীর পাড় ধরে দক্ষিন দিকে পালাতে গিয়ে দক্ষিন দিক থেকে আসা মুক্তি বাহিনীর দল কর্তৃক আক্রান্ত হলো। এদিকে উত্তর ও পশ্চিম দিক হতে মুক্তি বাহিনীর সদস্যগণ অর্ধ-চন্দ্রাকৃতি ভাবে পাকিস্তানীদেরকে ঘিরে ফেলল। তাদের পিছনে মেঘনা নদী। তিনদিকে মুক্তি বাহিনীর অবস্থান দেখে তার আত্ম-সমর্পন করল। সামনে অস্ত্র ফেলে দিয়ে দুই হাত উঁচু করে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইল্ নজরুল ভাইয়ের নেতৃত্বে মুক্তযোদ্ধারা অস্ত্র তাক করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। আত্ম-সমপনকৃত পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর তথা কথিত ‘‘ দুধর্ষ ও শক্তিশালী বিশ্বসেরা ’’ (?) সৈন্যদের দিকে। তিনদিকে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত কয়েকশত মানূষ কমান্ডার নজরুল ইসলামের নির্দেশক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে ঘৃণার রোষানল ঠিকরে পড়ছে। এহেন পরিস্থিতিতে যদি মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারের নির্দেশ না থাকতো - তাহলে তারা দেশীয় অস্ত্রে বিদ্ধ করতো ঐ সকল পাকিস্তানীদের । দীর্ঘ নয় মাসের অত্যাচারের বদলা নিত।

নজরুল ভাই সবার আগে গিয়ে তাদের অস্ত্রগুলো দখল করে সহকারী একজনকে বললেন, তা নিয়ে যাবার জন্য। একজন একজন করে দু’জন পাকিস্তানী সৈনিকের দেহ তল্লাশী করে সহকারী মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দিলেন, তাদেরকে পিছনে হাত বেঁধে ফেলার জন্য। ফিরোজ মিয়া নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা গামছা দিয়ে তাদের পিছমোড়া করে বাঁধতে শুরু করেছে মাত্র। ওমনি সময় একটি গ্রেনেট ব্লাষ্ট হলো। নজরুল ভাই লুটিয়ে পড়লেন চরের বালিতে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা করিৎকর্মার মতো কোন অবসর না দিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়তে লাগলো। পাকিস্তানীরা কোন উপায়ন্তর না দেখে নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়লো। কামাল উদ্দিন সরকার ও রতন সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ভাইকে দ্রুত ওখান থেকে সরিয়ে বাউসিয়া ফেরীঘাটে নিয়ে এলো। একটি জেলে-নৌকা করে বেলতলী নেওয়ার পথে শহীদ হন। ঐদিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাখি শিকারের মতো গুলি করে ‘‘মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়া’’ নয়জন পাকিস্তানীদের মেরে ফেলে। সেই গ্রেনেট হামলায় নজরুল ভাই শহীদ হয়েছেন আর আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে- ইয়াজধানী সরকার, ফিরোজ, তৌহীদ, নূরুল ইসলাম, আব্দুর রব আরো কয়েকজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ