শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১১

একজন মুক্তিযোদ্ধা ও আমার অগোছালো ভাবনা

আজকে সকালে যে ক্লাস ছিল জানতাম না। না খেয়েই দৌড়াতে হয়েছিল কলেজে। যতক্ষণে পৌছাই ততক্ষণে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় একটা মধ্যবয়সী লোককে দেখলাম গেটের কাছে একটা ফ্রেমে ধাঁধানো সাদা-কালো ছবি হাতে নিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াহুড়োয় ছিলাম তাই খেয়াল করতে পারিনি লোকটাকে।
স্যার ক্লাসের বিরতী দিল ১২টার দিকে। প্রায় সবাই ভলিবল খেলতে মাঠে চলে গেছে। অল্প কয়েকজন ক্লাসে বসে আছি। কেউ কেউ লাইব্রেরিতে গিয়ে প্যাপার পড়ছে। হঠাৎ দেখলাম সেই লোকটা আমাদের ক্লাসের সামনে এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। কয়েকজন বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো লোকটার দিকে। একজন জিজ্ঞেস করল, "কি চান? কাউকে খুঁজছেন?"
লোকটা জবাব দেয়ার বদলে সেই ফ্রেমের ছবিটা তুলে দেখাতে লাগল আর হাতের ইশারা দিয়ে বুঝাতে লাগল লোকটার সম্ভবত কোনো অসুখ হয়েছে। চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। কিন্তু স্টা নেই। আবার টাকা চাইতেও লজ্জা পাচ্ছেন। কারণ ক্যাম্পাসে এসেছেন প্রায় ঘন্টা তিনেক আগেই। এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইতস্তত ভঙ্গিতে।
ক্লাসে যারা ছিলাম সবাই এবার একটু গলা বাড়িয়ে লোকটার হাতের ফ্রেমটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। একটা প্যাপার কাটিং। সাদা-কালো ছবি, ছবিটা যে এই লোকটার তাতে কোনো সন্দেহই নেই। হুবহু এক। এখন কেবল বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়। ১৯৭১ সালে মীরসরাই এলাকায় তিনি যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর হয়ে। বীর প্রতীক তিনি। আজকে মীরসরাই মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের মীরসরাই অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়েছিল। 
আমরা সবাই একটু অবাক হয়ে লোকটার আপাদমস্তক দেখলাম ভাল করে। রঙ ওঠা মলিন ফুল শার্ট, ঢল ঢলে প্যান্ট, মুখের দাঁড়ি গোঁফে ময়লা একটা ভাব। ডান হাতের কনি আঙ্গুলটা গোড়া থেকেই নেই। পায়ের নখ পঁচে গেছে বেশ খারাপ ভাবে। স্যান্ডেলগুলোর অবস্থা খারাপ। মুচির সার্জিক্যাল টেবিলের নিচে কয় শো বার যে ওগুলোকে শুতে হয়েছে বোধ হয় স্যান্ডেলগুলোও এখন মনে করতে পারবে না।
লোকটা কথা বলতে পারেন না। গুঙ্গিয়ে হাতের ইশারায় কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ ঠিক মত বুঝতে পারে না। 
লোকটার সাহায্য দরকার, খুব সম্ভব চিকিৎসা কিংবা কারো বিয়ের জন্য। ঠিক বুঝতে পারলাম না। লোকটা হাতের ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করলেন যুদ্ধের সময় তিনি অনেক ছোট ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ করেছিলেন। গুলি খেয়েছিলেন হাতে, পায়ে, উরুতে আর পেটের ডান পাশে। 
আমাদের ক্লাসের সি.আর. ভদ্রলোক একটু দিল দরিয়া গোছের মানুষ। উঠে সবার কাছ থেকে টাকা তোলা শুরু করল। টাকা নিয়ে লোকটা মুখ নিচু করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় অদ্ভূত কায়দায় ডান হাতে আমাদের স্যালুট দেয়ার মত করে চলে গেলেন। স্যালুট দেয়ার কায়দাটা ঠিক রোবটের মত দাঁড়িয়ে থেকে নয়। অনেকটা নায়কচিত ভাবে হেটে মুখ ঝুঁকিয়ে স্যালুটটা দিয়ে হেটে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে। এই প্রথম কাউকে এরকম স্যালুট দিতে দেখলাম।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লিংকন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল, " আজকে মীরসরাই মুক্তদিবসে জানিস?"
আমি মাথা নাড়কাম। জানা ছিল না।
"আজকের দিনে মীরসরাই স্বাধীন হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর আসার অনেক আগেই এদিকটা স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। মানে হানাদার মুক্ত হয়েছিল। এই লোকটাও যুদ্ধ করে মীরসরাই মুক্ত করেছিল।"
আমি একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, "জানা ছিল না এতকিছু। যে দেশের সরকারই মুক্তিযুদ্ধের, সেই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবস্থা! একবার মুক্তিযুদ্ধের সরকার আসে তো একবার আসে মিক্সড সরকার। আর দেশের সব হোতা'রা তো রাজারকার!"
লিংকন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, আক্ষেপ মেশানো গলায় হঠাৎ বলে ফেলল, "এই দেশটা কোনোদিন বড় হবে না, উন্নতিও করতে পারবে না। কারণ এই মানুষগুলোর অভিশাপ আছে। অভিশাপ মাটিতে পড়ে না, কিন্তু এই অভিশাপ মাটিতেই পড়েছে!" ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল ও।
আমি খুব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
ওর কথাটা কানে বাজছে। অভিশাপ মাটিতে পড়ে না। কিন্তু যাঁরা মটির জন্য যুদ্ধ করেছে তাঁদের অভিশাপ মাটিতেই পড়েছে।
আপন মনেই খাতার ওপর কলম দিয়ে একটা স্ক্যাচ আঁকতে লাগলাম নিজের অজান্তেই। বুকের ভেতর কোথায় যেন বিচিত্র একটা দুঃখ পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। অদ্ভূত একটা হতাশা চেপে বসেছে মনের ভেতর। 
এই মাটিতে যারা জন্ম নিয়েছে এ পর্যন্ত- তাঁদের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ জাতি। আমরা একেকটা সাইনবোর্ড প্রজন্ম। এবং আমরাই সবচেয়ে বড় কাওয়ার্ড জেনারেশন। 
কেন বলছি কথাগুলো? কারণ আমরাই পারি মার্চ আর ডিসেম্বর মাসে লাল সবুজ ফ্লাগ নিয়ে দৌড়াতে। ফেব্রুয়ারি মাসে অ, আ, ক, খ লেখা ফতুয়া, শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে। আমরাই পারি রাগের মাথায় ইংরেজিতে চিৎকার করে সবাইকে বোঝাতে যে আমরা ইংরেজিতে মহা পন্ডিত। আমরাই পারি দেশটাকে ভালো বাসতে বাসতে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলতে। 
আমরা সব পারি। 
শুধু একটা জিনিস পারি না। 
আমরা নিজেরা কখনো একা একা দেশটাকে নিয়ে না ভেবে একা একা নিজের পরিবার আর আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবতে পারি না। আমাদের খুব বড় পরিসর নিয়ে চিন্তা ভবনা করতে হয়। আমাদের অনেক দায়িত্য কিনা! 
কি এমন ক্ষতি হয় এভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে ভাবলে? 
সন্তানের জন্ম দাতা পিতা কিংবা মাতা যখন সন্তানকে এত কষ্ট করে লালন পালন করে বড় করার পর দেখে ছেলেটা/মেয়েটা তাঁদের কেবল কষ্টই দিয়ে গেল- কখনো জানার চেষ্টা করল না মা-বাবা কেমন আছেন? কি করছেন? খাচ্ছেন কি?
তখন সেই সন্তানের ওপর নিজের অজান্তেই অভিশাপ নামে বাবা-মার। সেই সন্তান কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না পৃথিবীতে।
'৭১এর মুক্তিযোদ্ধারাই এই দেশের বাবা-মা। যারা খুব অবহেলায়, অনাদরে এখানে সেখানে জীবন কাটাচ্ছে হয়ত কোনো ক্যাম্পাসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অল্প কয়টা টাকার জন্য। কিন্তু লজ্জার চোটে মুখফুটে বলতেও পারছেন না।
ফ্ল্যাগের কাপড় পরে কিম্বা ফেসবুকে প্রোফাইল পিচকার দিয়ে আসলে আমরা বাহিরের দেশকে দেখাতে চাইছি এখন আমাদের বিজয়ের মাস- তাই না? 
আমরা পরাধীন জাতি। আমরা স্বাধীন নই।
১৯৭১ সালে এই দেশটা স্বাধীন হয়েছিল হয়ত।
এখন ২০১১ সাল। বাংলাদেশ পরাধীন রাষ্ট্র। এখানে '৭১ নিয়ে যারা বুলি আউরাবেন আজ থেকে আমি তাঁদের মুখ ভেঙ্গে ফেলবো। আমরা পরাধীন জাতি। 
আমি নিজে এতদিন স্বাধীনতা নিয়ে বহু লেখা লিখে এসেছি। অনেক দেয়ালিকা লিখেছি, অনেক ছবি এঁকেছি। আমি এই লেখাটার পর আর কোনোদিন স্বাধীনতা নিয়ে লিখবো না। 
আমার সে অধিকার নেই। 
যে দেশে হাজার হাজার মুক্তি যোদ্ধা গভীর অভিমান নিয়ে কলেজ গেটগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজের গ্রামের রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পায় দেখে রাগ করে নিজের সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসেননা, টাকার অভাবে কিডনি নষ্ট হয়ে মারা যান ধুঁকে ধুঁকে- সেই দেশের মাটি পবিত্র হতে আরো কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে। মা-বাবার অভিশাপ দিতে হয়না।
মুখ ঝুঁকিয়ে স্যালুট দিয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর বুকে আল্লাহ অনেক মমতা দিয়ে দিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। কারণ অল্প কয়েকটা টাকা পেয়ে তাঁদের চোখে মুখে এতো খুশি দেখেছি যে মনে হয়েছে তাঁরা এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের অনেক বড় মনের অধিকারী ভাবেন। যারা তাঁদের স্বাধীন করা দেশটাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। খুব অবাক লাগে তাঁদের দেখলে। দেশটাকে নিয়ে তাঁরা এখনো অনেক স্বপ্ন দেখেন।
আমি এত বড় হৃদয় নিয়ে জন্মাইনি। তাই আমি স্বপ্ন দেখবো না আর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ