শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১১

আবুল হোসেন ও ফারুক খানের খুটির জোর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা............

সরকারের প্রায় তিন বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভায় ছোটখাটো একটি রদবদল করেছেন। মন্ত্রিসভায় নতুন দু’জন মন্ত্রী যোগ দিয়েছেন। তাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে শেষ পর্যন্ত। একজন আগে মন্ত্রী ছিলেন। অপরজনের জীবনে মন্ত্রিত্ব পাওয়া এই প্রথম। তিনজন মন্ত্রীর দফতর বদল হয়েছে। রদবদল বলতে এতটুকুই। ফলে এ নিয়ে কোথাও তেমন আলোচনা কিংবা সাড়া নেই। না রাজনৈতিক মহলে, না সাধারণ্যে। আলোচনা যেটা হচ্ছে, সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অতি চালাকি’ নিয়ে। বিশিষ্ট নাগরিকরা এরই মধ্যে এ রদবদলকে ‘আইওয়াশ’ বলেই মন্তব্য করেছেন।
সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভা থেকে দুর্নীতিবাজ ও ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণের দাবি উঠেছিল জোরেশোরে। গত তিন বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা, অর্থনীতির দৈন্যদশা, শেয়ার কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা জনগণের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এসব নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক সমালোচনাও হয়। বিশেষ করে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে এবং বেহাল রাস্তার কারণে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের অপসারণের দাবি দেশ-বিদেশ থেকে উঠতে থাকে। একইসঙ্গে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্যের কারণে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের পাহাড়সম ব্যর্থতাকে দায়ী করে তারও পদত্যাগের দাবি ওঠে জোরালোভাবে। কিন্তু দেখা গেল ব্যর্থ ও অযোগ্য যারা, তারা বাদ তো পড়লেনই না, বরং মন্ত্রিসভা আরও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজ আশা করেছিল অন্তত আর যাই হোক সৈয়দ আবুল হোসেন ও ফারুক খানকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষের সেই আশা পরিণত হলো দুরাশায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় যত্সামান্য রদবদল করেছেন। এ রদবদলেও এ বিষয়টা পরিষ্কার যে, মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন ও ফারুক খান ব্যর্থ। তাদের বিরুদ্ধে এতদিন যেসব দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল তার সবটা মিথ্যে নয়। প্রকারান্তরে তা স্বীকারই করা হয়েছে।
দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অনিয়মের নানা অভিযোগের কারণে অবশেষে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে তিনি তার মন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। ভাগ্যবান লোক! একটি মন্ত্রণালয় ভেঙে দুটি করে একটির দায়িত্ব তাকে দিতে হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, সারাদেশের সড়ক ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দেশে-বিদেশে আবুল হোসেন ও সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়ার পেছনে এগুলোই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কারণেই এই কীর্তিমানকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কেননা তার কারণেই সরকারের প্রতিশ্রুত প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প আটকে যায়। বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা প্রতিশ্রুত ঋণ বন্ধ করে দেয়।
প্রায় তিন বছর যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা এবং সর্বশেষ পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন সদা হাসিখুশি সৈয়দ আবুল হোসেন। বিশ্বব্যাংক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত সেপ্টেম্বর মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে দেয়। সমালোচনা ছিল ফারুক খানের কর্মকাণ্ড নিয়েও। তাদের অপসারণ ও পদত্যাগ চেয়ে কয়েক মাস ধরে নাগরিক সমাজ সভা-সমাবেশ করেছে। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। ব্যর্থতার প্রতিবাদে শহীদ মিনারে ঈদ পালনের মতো ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটেছে। বিড়ম্বনায় পড়েছে সরকার।
একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং সেই অভিযোগ যখন দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তাধীন থাকে, তখন তাকে মন্ত্রী পদে রাখা কতটা সমীচীন? যে ব্যক্তির কারণে পদ্মা সেতুর মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প আটকে গেল, সেই ব্যক্তিকে কেন মন্ত্রিসভায় রাখা হবে? কিন্তু দেখা যায়, একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানো হয়নি। তাকে একটি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে নতুন করে আরেকটি মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে যা কাম্য নয়। যেহেতু সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে, সেহেতু তাকে সরাসরি মন্ত্রী থেকে সরিয়ে দেয়াই উচিত ছিল। আসলে সৈয়দ আবুল হোসেনকে নতুন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দিয়ে তাকে দুর্নীতির দায় থেকে মূলত রক্ষা করা হয়েছে। তিরস্কারের বদলে পুরস্কৃতই করা হয়েছে তাকে।
এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে সৈয়দ আবুল হোসেন ও ফারুক খানের খুঁটির জোর কোথায়? মন্ত্রিসভায় তারা এত অপরিহার্য কেন? তাদের ছাড়া কি সরকার চলবে না? সংশ্লিষ্ট একজন বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিতে যারা সিদ্ধহস্ত তাদের সাগরের ঢেউ গুণতে দিলেও সেখান থেকেই তারা দুর্নীতির রাস্তা বের করে ফেলবে। সৈয়দ আবুল হোসেনের ক্ষেত্রেও এ কথাই যে প্রযোজ্য, তা আলোচনা হচ্ছে। এবারই শুধু নয়, সৈয়দ আবুল হোসেন শেখ হাসিনার আগের আমলেও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তখনও পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিতে তিনি ধরা পড়েছিলেন। মন্ত্রী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত পাসপোর্ট নিয়ে তার ব্যবসায়িক কোম্পানি সাকোর কাজে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। সেবার তার মন্ত্রিত্ব চলে গিয়েছিল। সেবারও সাকো, এবারও সাকো। এবার সাকোর বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুতে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ। এবার অবশ্য সৈয়দ আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব যায়নি। পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হাতছাড়া হয়ে গেলেও তিনি হাতের মুঠোয় পেতে যাচ্ছেন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি)। তার নতুন মন্ত্রণালয় আইসিটির আওতায় আনা হচ্ছে বিটিআরসিকে। দুর্নীতির অভিযোগে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দিলেও তার অধীনেই যাচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ওই সংস্থা বিটিআরসি। এ সংস্থার আওতায় রয়েছে দেশের সব মোবাইল কোম্পানিসহ টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব এ খাত থেকে সরকার পায়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হয়ে থাকে। হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ হয় এখানে। এরই মধ্যে বাজারে বিভিন্ন কথা চালু আছে যে, আইসিটি ও টেলিকম সেক্টর থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর এর দায়িত্ব যদি সৈয়দ আবুল হোসেনের হাতে যায়, তখন তো সোনায় সোহাগা। দুর্নীতি চলে যাবে ডিজিটাল পর্যায়ে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরানোর আগ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক তাদের সিদ্ধান্তে ছিল অটল। তারা সাফ জানিয়ে দেয়, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগমন্ত্রী রেখে তারা পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের কোনো বক্তব্যই গ্রহণ করেনি বিশ্বব্যাংক। তারা জানিয়েছে যে, বৃহত্ এ প্রকল্পের দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও দেখবে তারা। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে লেখা চিঠিতে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি প্রতিরোধের কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরানোর পর বুধবার বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। কোনো কোনো পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক থেকে এ সাক্ষােক স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাত্ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাত্ বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ব্যাপারে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে না। তারা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই এ ব্যাপারে এগোবে।
এদিকে সৈয়দ আবুল হোসেনের নতুন দায়িত্ব নিয়ে যখন গুঞ্জন চলছে, তখন আরেক বিতর্কিত মন্ত্রী ফারুক খানকে নিয়েও চলছে একই গুঞ্জন। ফারুক খান বিমান ও পর্যটন মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। তার এ দায়িত্ব নেয়ার পর সংশয় দেখা দিয়েছে বিমানবন্দরের ৪৩৪ বিঘা জমি রক্ষা সম্ভব হবে কি না। কারণ মারাত্মক অনিয়মের মাধ্যমে বিমানবন্দরের ৪৫ হাজার কোটি টাকার এ সম্পত্তি লিজ নিয়ে সংঘটিত কেলেঙ্কারির সঙ্গে মন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান জড়িত। মন্ত্রীর ছোট ভাই আজিজ খানের সামিট গ্রুপ এতে জড়িয়ে পড়ায় বিমানবন্দরের রাষ্ট্রীয় এ সম্পত্তি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 


#সূত্রঃ আমার দেশ, উপসম্পাদকীয়, ০৯.১২.২০১১ইং।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ