শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১১

এই গল্পের কোন শিরোনাম হয় না



চোখ ডলতে ডলতে ব্রাশটা মুখে দেয় ধ্রুব। প্রত্যেকদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় একই দৃশ্য। মুখ ধোয়া শেষ না হতেই মায়ের গলা ভেসে আসে। “মুখ ধুতে কারো এতক্ষণ লাগে? তোর ক্লাস কয়টায়? কখন যাবি?”
জবাব না দিয়ে চুপচাপ খাবার টেবিলে বসে পরে। মুখ মুছে তোয়ালেটা একপাশে সরিয়ে রেখে দেয়। তাড়াহুড়ো করে মুখে কোনমতে কিছু খাবার গুজে দেয়। এত বড়ো হয়েছে কিন্তু এখনো জুতার ফিতা বাঁধতে পারে না। ওর খাওয়ার মাঝেই মা এসে ফিতা বেধে দিয়ে যায়। “আজকেও লেট লাইন এ দাড়াতে হবে।” চিন্তা করে টেবিলে রাখা টাকাটা নিয়ে মাকে বিদায় জানিয়ে ছুটে বেড়িয়ে যায়।



বেশ কিছুদিন ধরেই ধ্রুবর মনটা একটু খারাপ। গতকাল পাশের বাসার এক বড় ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছিল সন্ধ্যার দিকে। ওদের স্কুল থেকেই পাশ করেছেন উনি। ধ্রুব পড়ে ক্লাস টেন এ। ভাইয়া ধ্রুবর ৬ ব্যাচ সিনিয়র। হঠাৎ দেখা হওয়াতে ধরে বসলেন।
“কি ব্যাপার ভাইয়া ক্যামন আছ?”
“এইতো ভাই ভালো। আপনি ক্যামন আছেন?”
“হুম ভালো, তোমার স্কুল ক্যামন চলে?”
“ভালো ভাইয়া।”
“তাই নাকি।”
“তাই তো, এভাবে জিজ্ঞ্যেস করলেন যে? কিছু হয়েছে?”
“হুম, আজকে ব্লগে দেখলাম আমাদের স্কুলকে শিক্ষাবোর্ড থেকে “বি” গ্রেডে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, কালকে পেপারে চলে আসবে। আমরা আর এখন থেকে ঐতিহ্যবাহী শব্দটা ব্যাবহার করতে পারব না।”
“কি যে বলেন ভাইয়া, নিশ্চয়ই গুজব।”
“সত্যি না হলে তো আমিও খুশি হতাম। কিন্তু মনে হয় না খবরটা মিথ্যা।”



বলেছিলো বটে, কিন্তু কথাগুলো নিজের কানেই বেখাপ্পা লাগছিল। আশপাশ থেকে অনেকদিন ধরেই শুনতে পাচ্ছিল যে ওদের স্কুলের মানের অবনমন হচ্ছে। কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারছিল না, আবার কথাগুলো একদম ফেলেও দিতে পারছিল না। সকালে পেপারটা হাতে নিয়ে দেখল ভাইয়ার কথাই ঠিক। খুব খারাপ লাগছিল। ইদানিং মাও বেশ একচোট শুনাচ্ছিলো, পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজকে পেপারে খবরটা দেখার পর লোকজনের কথার দায়ে তো আর টেকা যাবে না। স্কুলের কোন দুর্নাম হয় এমন কিছু তো ওরা করে নি। তাহলে সমস্যাটা আসলে কোথায়?

“মামা ভাড়াটা দেন” রিকশাওয়ালার ডাকে সৎবিৎ ফেরে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে স্কুল পর্যন্ত চলে আসলেও টের পায়নি। ঘন্টাটা শোনার সাথে সাথে ওর মাথায় যেন বাজ পরে। আজকেও লেট। ভাড়াটা চুকিয়ে প্রার্থনা করতে করতে দৌড় লাগায়। কিন্তু নিস্তার পায় না। ঠিকই লেট লাইনে গিয়ে দাড়াতে হয়।

জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলে হেড স্যার এসে মাইকের সামনে দাড়ান। ওর বুকটা একটু কেপে ওঠে। কান খাড়া করে শোনে স্যার কি বলেন। গতকাল ভাইয়ার কাছে শোনা কথাগুলোই স্যারের বক্তব্যে ফুটে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয়, এই অবনমনের জন্যে স্যার ওদেরকেই দায়ী করেন।

স্যারের কথাগুলো শোনার পর একদম মুষড়ে পরে ধ্রুব। ওরা কি আসলেই শেষ হয়ে গিয়েছে? আর কিছুই কি করার নেই? কেন ওদেরকে “বি” গ্রেডে নামিয়ে দেয়া হবে? কেন স্কুলের নামের আগে ঐতিহ্যবাহী কথাটা ব্যাবহার করতে পারবে না? হেডস্যারের দেয়া সমস্ত অপবাদের ভারে ওর মাথাটা নিচু হয়ে যায়। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসে। কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু কি করবে ও? চারপাশে বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া দেখতে মাথা ওঠায়। 
মাথাটা ঝারা দিয়ে চোখ কচলে নেয় দুহাতে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সবগুলো মানুষ যেন জমে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছে। কেউ নড়ছে না। ওর পেছনে একজন স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওনার চোখের সামনে দিয়ে হাতটা ঘুরিয়ে আনে। কোন ভাবান্তর নেই। ভয় পেয়ে যায় ধ্রুব। চারপাশের পরিবেশটাও ক্যামন যেন বদলে গেছে। ঘাস, গাছের পাতা ক্যামন যেন বিবর্ন। স্কুল বিল্ডিংটার গায়ে শ্যাওলা দেখা যাচ্ছে। আকাশের রংটাও ক্যামন যেন ধূসর।

হঠাৎ একজনকে নড়তে দেখে। লোকটা স্যারদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। হেডস্যারের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? ধ্রুব বুঝতে পারে না ওর কি করা উচিৎ। এর মাঝেই লোকটা চোখের আড়ালে চলে যায়। যা আছে কপালে ভেবে হাটা ধরে। মূর্তি হয়ে থাকা মানুষগুলোর পাশ দিয়ে হাটার সময় গা শিরশির করে ওঠে। রুমটার সামনে এসে কয়েক মুহূর্ত দোনামোনা করে। অবশেষে পর্দা সরিয়ে উকি দেয়। পুরো রুমটা অন্ধকার হয়ে আছে। জানলা দিয়ে একটা আবছা আলো আসছে কেবল।

হঠাৎ একটা গলা শুনতে পায়, “কে তুমি বাবু?”
শব্দটা অনুসরণ করে তাকালে দেখে কোনার দিকে একটা চেয়ারে ওই মানুষটা বসে আছেন। গায়ে একটা চাদর জড়ানো, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় চূড়াওয়ালা টুপি। চিনতে পেরে থতমত হয়ে যায়।
“আপনি খান মুহাম্মাদ সালেক স্যার না!”
“হ্যা বাবু, তুমি কে?”
“আমি? আমি এই স্কুলেরই ছাত্র, মানে ছিলাম, মানে আছি, মানে...”
“কিন্তু বাবু তোমার তো এখানে থাকার কথা না, তুমি এখানে কি করে এলে?”
“জানিনা স্যার, আমি সমাবেশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ সবকিছু ক্যামন যেন বদলে গেলো। লোকগুলো যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছে। আপনি দেখুন স্যার।” বলে ঘুরতেই আরেকটা ধাক্কা খায়। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা এতগুলো লোক কেউ নেই। সব যেন ভোজবাজীর মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
“কই কেউ তো নেই।”
“কিন্তু স্যার কিছুক্ষণ আগেও তো ছিল।”
“হতে পারে। স্কুলটাও তো ঐতিহ্যবাহী ছিল, এখনো কি আছে? তোমাদের হেডস্যার যা বললেন তা কি ঠিক? তোমার কি মনে হয়?”
“স্যার আপনি জানেন?” সালেক স্যারের ঠোটে একটা স্মিত হাসি দেখতে পেয়ে স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেয়, “ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।”
“হুম, তুমি বরং এক কাজ করো। এই করিডোরটার একদম শেষ ক্লাসরুমে চলে যাও। ওখানে তোমাকে সাহায্য করার মতো কেউ একজন আছে।”
“কেন যাবো?” প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে যায়, স্যারের কথা মতো কাজ করে সে। মনের ভেতরে ভয় ভয় ভাবটা আর টের পাচ্ছে না। কিন্তু খুব অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে যেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।


“কোন ক্লাসে পড় তুমি?”
“ক্লাস সেভেনে।”
“গুড, আমি ‘৬৫ ব্যাচ। আমার নাম বাদল। স্কুলকে বি গ্রেডে নামানো হয়েছে কেন? পড়ালেখা হয় না? কোন বিষয়ে খারাপ তুমি?”
“জ্বি, মানে, ভাইয়া...”
“বেশিরভাগই অংকে খারাপ হয়, তুমি অংক ক্যামন পারো?”
“জ্বি মোটামুটি।”
“উহু, মোটামুটি হলে তো চলবে না, আচ্ছা চল দেখি তোমার টেস্ট হবে। আমাদের স্কুলের এক ম্যাথ জিনিয়াসের সাথে তোমার প্রতিযোগিতা হবে।”
প্রতিযোগিতার কথা শুনে একটু ভড়কে যায় ধ্রুব। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই বাদল ভাই হাটতে শুরু করেছেন। আগপিছু কিছু না ভেবেই অনুসরণ করে। 
“ভেতরে যাও” একটা ক্লাস রুমের সামনে এসে ওকে নির্দেশ দেন তিনি। তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে আপনমনে ব্ল্যাকবোর্ড এ কি যেন লিখছে।
“কিন্তু আমি কি...” এতটুকু বলে থেমে যায়। কারণ পেছনে বাদল ভাই আর নেই।
“দেরি করছ ক্যান? ভেতরে এসো তাড়াতাড়ি। বোর্ডে প্রশ্ন লেখা আছে। দেখা যাক কে আগে সমাধান করতে পারে” বলে অপেক্ষা না করেই একটা স্টপ ওয়াচ চালু করে বোর্ড এ লিখতে শুরু করে দেয় ছেলেটা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধ্রুবও তাই করে। কোন কিছু খেয়াল না করে নিজের মতো করে অংক করে যায়। একসময় সমাধানটা বের করতে পারে। চকটা রেখে পাশের ছেলেটার দিকে তাকায়। চিনতে পারে, এটা সামিন রিয়াসাত, ’০৭ ব্যাচ। IMO তে ব্রোঞ্জ মেডেলিস্ট। তার প্রায় শেষ। শেষ করে এসে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে থাকে সামিন।
“এত কঠিন একটা সমাধান তুমি আমার আগে শেষ করে ফেললে! তোমার ব্রেন তো বেশ শার্প। তাহলে তুমি এখানে কেন? তুমি বরং দোতলায় যাও। DCL রুমের পাশের রুমটায়।”


ভাইয়ার কথা মতো একটা ক্লাসরুমে গিয়ে পৌছায় ধ্রুব। একটা লাইব্রেরীর মতো। ওদের স্কুলে কোন লাইব্রেরী ছিল বলে তো ওর মনে পরে না। বইয়ের শেলফগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় একজন লোক বসে আছে। চেহারাটা পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে। মইনুল আহসান সাবের! ভাইয়ার কিছু লেখা পড়েছিল ধ্রুব। আওয়াজ পেয়ে তিনি তাকান।
“বই নিতে এসেছ? লাইব্রেরিয়ান তো নেই।”
“না ভাইয়া, বই নিতে আসিনি। আসলে আমি যে কেন এখানে এসেছি আমি নিজেও জানি না। একজন ভাইয়া আমাকে বললেন এখানে আসতে, আমার নাকি এখানে আসা উচিৎ।”
“হুম, আচ্ছা, তুমি লেখালেখি করো?”
“জ্বি ভাইয়া, মানে এই টুকটাক অভ্যেস আছে।”
“very good, very good, তা তোমার সাথে কি তোমার কোন লেখা আছে এখন?”
“জ্বি ভাইয়া, স্কুল “অনুশীলন” এর জন্যে একটা লেখা তৈরি করেছিলাম। ভালো হয় নি।”
“কই দেখি।”
ধ্রুব প্রথমে একটু ইতস্তত করে, তারপরে ওর ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে দেয়। ওর নিজের লেখা একটা গল্প “একটি ফুটবলের আত্মকাহিনী।”
“বাহ! চমৎকার। এটা তো বেশ ভালো হয়েছে। অসাধারণ কনসেপ্ট। তখন তুমি অমন করছিলে কেন!”
“সত্যি ভাইয়া!” বিশ্বাস হতে চায় না ধ্রুবর। মইনুল আহসান সাবেরের মতো একজন লেখক ওর লেখার প্রশংসা করছেন।
“হ্যা, তোমার লেখনি তো বেশ ভালো। তোমার লেখা পড়লে বোঝা যায় তুমি বেশ বুদ্ধিমান। তোমার সাবলীল কিন্তু আকর্ষণীয় বর্ণনা ভঙ্গী, এক কথায় চমৎকার। তোমাকে বুদ্ধির খেলায় খুব সহজে কেউ হারাতে পারবে না।”
“কিন্তু ভাইয়া আমি তো যুক্তি ভালো বুঝি না।”
“এটা তোমার ভুল ধারনা। আচ্ছা তুমি বরং এক কাজ করো। নিচতলায় একদম কোনার রুমটাতে যাও। আশা করি নিজের সম্পর্কে তোমার ভুল ধারনা ভেঙ্গে যাবে।”

মোহগ্রস্থের মতো নির্দেশ মেনে নেয় ধ্রুব।


রুমটার মাঝখানে সিলিং থেকে একটা লম্বা তার নেমে এসেছে। ৬০ পাওয়ারের একটা বাল্ব জলছে। দেখে অনেকটা জিজ্ঞ্যাসাবাদ সেলের মতো মনে হয়। ঠিক তার নিচেই একটা টেবিলের উপর একটা দাবার বোর্ড সাজানো। আবছা ভাবে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক চিনতে পারে না ইনাকে আগে কোথায় দেখেছিল।
“তাড়াতাড়ি এসো” যেন ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
“ভাইয়া আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে” কাছে গিয়ে বলে ধ্রুব, “ঠিক মনে করতে পারছি না”
“তুমি আমাকে চেন নি!” কিছুটা অবাক আর রাগত স্বরে প্রশ্ন করেন উনি, “আমি গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান।”
“ভাইয়া আপনার না মোচ ছিল!”
“হ্যা ছিল” কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তর দেন জিয়াউর রহমান, “এখন নেই ব্যাস। খেলা শুরু করো।”
“আমি খেলব!”
“তো কি করবে, খেলায় না জিতলে তুমি এই ঘর থেকে আর বের হতে পারবে না।”
এই কথা শুনে ধ্রুব ভয় পেয়ে যায়। ভাইয়া মজা করছেন না তো। আবার মনে হয় এখানে এখন সবই সম্ভব। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে খেলা শুরু করে।
প্রথম ২০ মিনিটের ভেতর জিয়া ভাইয়ের ৭ টা গুটি খেয়ে ফেলে ধ্রুব। গ্র্যান্ড মাস্টার দ্বিধায় পরে যান। বেশ চিন্তা ভাবনা করে পরের চালগুলো দিতে থাকেন। কিন্তু আজ যেন ধ্রুবরই দিন।
নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারে না ধ্রুব। গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানকে ও হারিয়ে দিয়েছে! চোখে প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকায় সে। ভাইয়াও বুঝে উঠতে পারেননি ব্যাপারটা কি হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পর হাত বাড়িয়ে ওর সাথে হ্যান্ডশেক করেন।
“বুদ্ধি তোমার খারাপ না। কিন্তু বাস্তবিক জীবনে তার প্রয়োগ কতখানি করতে পার সেটা দেখা যাবে। দোতলায় DCL রুমে যাও,” গোমড়া মুখে বলেন তিনি।


বিতর্কের মঞ্চ প্রস্তুত। রুমের লোকদুজনকে চিনতে পারে ধ্রুব। বিচারকের আসনে রফিকুল্লাহ রোমেল ভাইয়া, একপাশের ডায়াসে দাঁড়ানো প্রসুন বিশ্বাস ভাইয়া। ওকে দেখেই রোমেল ভাই হাত নেড়ে তাগাদা দেন অপর পাশের ডায়াসে দাড়িয়ে যেতে। কিছু না বুঝেই ডায়াসে উঠে যায় ও।
রোমেল ভাইয়া শুরু করেন, “স্বাগতম সবাইকে, আজকে বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয়েছে “গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলকে ‘বি’ গ্রেডে নামানোর সিধান্ত সঠিক”। বিষটির পক্ষে বলবেন প্রসূন বিশ্বাস এবং বিপক্ষে বলবেন ধ্রুব। প্রথমেই প্রসূনকে তার বক্তব্য উপস্থাপনের আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রসূন ভাই বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন। প্রতিটা যুক্তি শোনার পর ধ্রুবর কান লাল হয়ে উঠতে থাকে। এগুলো যে মোটেও সত্যি নয়! স্কুলের ছেলেরা এখনো ভালো রেজাল্ট করে। পাশাপাশি বিতর্ক, কুইজ, স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের বেশ ভালো রকম সাফল্য আছে। মোট কথা পড়াশোনা এবং তার পাশাপাশি যত ধরনের কার্যক্রম আছে সবখানেই ওদের সাফল্য জাজ্বল্যমান। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরে ঠেলে আত্মবিশ্বাসের সাথে বিতর্ক শুরু করে ও। এ বিতর্কে কিছুতেই হারা চলবে না। যে করেই হোক ভাইয়াদেরকে ভুল প্রমান করতেই হবে।
দুজনের বক্তব্য প্রদান শেষ হলে রোমেল ভাইয়া চেয়ারে নড়েচড়ে বসেন।
“তুমি কতদিন ধরে বিতর্ক করছ?”
“ভাইয়া আজই প্রথম”
দুই সেকেন্ড ঘরটা নীরব হয়ে থাকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। দু সেকেন্ড পরে রোমেল ভাইয়া আবার কথা বলেন, “ধ্রুব, আজকের বিতর্কে তুমি জয়ী হয়েছ।”
প্রসূন ভাইয়া ডায়াস থেকে নেমে এসে ওকে কংগ্র্যাচুলেট করে রুম থেকে বের হয়ে যান। ধ্রুব রোমেল ভাইয়ার দিকে এগিয়ে যায়। “আমি তোমাকে আর কিছু বলব না, তুমি সরাসরি ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের কাছে চলে যাও” ও কিছু বলার আগেই ভাইয়া ওকে বলেন, “অ্যান্ড ইউ ডিড ওয়েল”। মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বলে রুম থেকে বের হয় ধ্রুব। আশেপাশে প্রসূন ভাইয়াকে দেখা যায় না।


ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের নিচে সালেক স্যার কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ধীর পায়ে স্যারের দিকে এগিয়ে যায়।
“চল একটু হাটি,” ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলেন স্যার।
“আচ্ছা স্যার, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?” হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করে ধ্রুব।
“একটা প্রশ্নতো করেই ফেললে, আরো একটা চাইলে করতে পার।”
স্যারের কথায় হেসে ফেলে ধ্রুব, “এখানে আমার আসার কারণটা কি আপনি জানেন স্যার?”
“তুমি জাননা?” পাল্টা প্রশ্ন করেন স্যার।
“ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার। মনে হয় এখন আমি জানি।”
“সব সময় নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখবে, এই বিশ্বাসটা কক্ষনো হারাবে না। তোমাকে যাই করতে বলা হোক তুমি পারবে, কারণ সে ক্ষমতা তোমার আছে। তুমি একজন ল্যাবরেটরিয়ান। আজকের কথাই চিন্তা করো। তোমাকে যখন কাজগুলো করতে বলা হয়েছিল তখন তোমার মনে সংশয় ছিল, কিন্তু তুমি পেরেছ, কারণ তুমি চেস্টা করেছ। লোকজনের কথায় আগেই হাল ছেড়ে দেবে না। নিজেকে বিশ্বাস করো, ল্যাবরেটরিয়ান সত্ত্বায় বিশ্বাস করো। তোমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না।”
নিজের ভেতরে একটা শক্তির অনুভুতি পায় ধ্রুব। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। নিজেকে এখন বুঝতে পারে ও।
একটা যায়গায় এসে স্যার দাঁড়িয়ে যান। দেখাদেখি ধ্রুবও দাঁড়িয়ে পরে।
“তুমি জুতার ফিতা বাঁধতে পারো?” ওর জুতার দিকে আঙ্গুল তোলেন স্যার। তাকিয়ে দেখে ফিতা খুলে গেছে। চিন্তায় পরে যায় ধ্রুব। ও তো ফিতা বাঁধতে পারে না। সকালে তো মা বেধে দিয়েছিলো, এখন? ‘না স্যার’ বলতে গিয়েও থেমে যায় ধ্রুব, স্যার মিটিমিটি হাসছেন। ও নিশ্চিত হয়ে যায় এটাও ওর একটা পরীক্ষা। বুঝতে পেরে কেন যেন হেসে ফেলে ও। নিচু হয়ে ঝুকে ফিতা বাঁধতে থাকে। শেষ গিটটা দেয়া হলে পেছন থেকে শুনতে পায় স্যার বলছেন, “তোমার সফর পূর্ণ হল।”


স্যারের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ওর কানে একটা সমস্বরিত কোলাহল ভেসে আসে, জাতীয় সংগীতের লাইনগুলো চিনতে পারে। মাথা তোলার পর আর অবাক হয় না। ওর সামনে পেছনে স্কুলের ছেলেরা লেট লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউই আর মূর্তি হয়ে নেই। সবাই উচ্চ স্বরে জাতীয় সংগীত গাইছে। স্যাররাও তাদের আগের যায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। ওর বারবার মনে হতে থাকে এখনো একটা কাজ বাকি আছে কিন্তু ধরতে পারে না। জাতীয় সংগীত শেষ হলে হেডস্যার যখন বক্তৃতা শুরু করেন তখন ও বুঝতে পারে কাজটা কি। স্যারের বক্তব্য শেষ হয়। ওর ভেতরে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। ও জানে ওকে কি করতে হবে। হাত উচু করে ছুটে যায় মাইকের দিকে। সবাই একটা চিৎকার শুনতে পায়, “আমার কিছু বলার আছে।”


***২৫ বছর পর কোন এক বিকেলে***
মেইলবক্স চেক করতে করতে একটা মেইলে এসে চোখ আটকে যায় ধ্রুব আহমেদ সাহেবের। একটি প্রতিথজশা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিইও তিনি। । মেইলটা এসছে OLsA থেকে। তাঁদের স্কুলের রি-ইউনিয়ন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ওনার, একলাফে ২৫ বছর পেছনে চলে যান তিনি। সেইদিনটিতে যেন পুনর্জন্ম হয়েছিল তাঁর। নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখেছিলেন, ল্যাবরেটরিয়ান সত্ত্বায় বিশ্বাস করেছিলেন। সাফল্য অর্জন করতে শিখেছিলেন। তারপর থেকে কোনদিন পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাঁকে। তার ফলাফল আজকের এই অবস্থান। দরজা ঠেলে আহমেদ সাহেবের সেক্রেটারি রুমে ঢোকে, বসের চোখে পানি দেখে থমকে যায়। আহমেদ সাহেব চোখ মোছার কোন চেষ্টা করেননা। এ অশ্রু যে আনন্দের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ