মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১

খিচুড়ি খেয়ে সহস্রাধিক মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত দুই শিশুর মৃত্যু

নিষিদ্ধ পলিথিনে ভরা ওরসের খিচুড়ি খেয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুর, রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলায় সহস্রাধিক গ্রামবাসী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল সোমবার দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
আক্রান্তদের মধ্যে ছয় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের বাড়িতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একাধিক চিকিৎসক দল গঠন করা হয়েছে।
মৃত শিশুরা হলো, সৈয়দপুরের কামারপুকুর ইউনিয়নের আইসঢাল গ্রামের জাফর আহমেদ বুধারুর ছেলে সেলিম (৭) ও বদরগঞ্জের সন্তোষপুর পাতাইপাড়ার শরিফ উদ্দিনের মেয়ে সুরভী (৫)। 
সৈয়দপুর: ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে সৈয়দপুরের কাচারীপাড়ার বাসিন্দা কলেজছাত্র টুটুল বলেন, গত শনিবার রাতে আইসঢাল গ্রামে প্রয়াত পীর দাউদ আলী খন্দকারের আস্তানায় বার্ষিক ওরস হয়। ওরসে আশপাশের ১৫ গ্রামের ভক্তরা উপস্থিত ছিলেন। ভোরে সবাইকে তবারক হিসেবে গরুর মাংস, আলু ও ডাল দিয়ে তৈরি খিচুড়ি পলিথিনে করে দেওয়া হয়। এই খিচুড়ি খাওয়ার পর রোববার রাতে তাঁর পাতলা পায়খানা ও বমি শুরু হয়।
ওরসের পলিথিনভর্তি ওই খিচুড়ি অনেকে বাড়িতে এনে পরিবারের লোকজনকে খাওয়ালে তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। 
পীর দাউদ খন্দকারের আস্তানায় গিয়ে তাঁর উত্তরসূরি আবদুল মান্নান ও আবদুল বাতেনকে পাওয়া যায়নি। তাঁদের পরিবারের লোকজন বলে, ৮০ বছর ধরে পীর সাহেবের ওরস চলছে এখানে। প্রতিবছরই অসংখ্য মুরিদ এখানকার তবারক খেয়ে থাকেন। কোনো দিন এমন ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনায় তাঁরাও বিস্মিত।
সৈয়দপুরের কাচারীপাড়া, কুজিপুকুর, নিজবাড়ী, হাজীপাড়া, আইসঢাল, কামারপুকুর ঘুরে দেখা গেছে, নারী ও শিশুরা ঘন ঘন পাতলা পায়খানা ও বমি করছে। কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও ওষুধ পাচ্ছে না। 
আইসঢাল গ্রামের আক্রান্ত শিশু শাহনেওয়াজ কেঁদে বলে, ‘হামাক তোমরা বাঁচান। মরি গেইনো হামরা। রইসোধ (ওষুধ) দ্যান, সেলান দ্যান।’
কাচারীপাড়া গ্রামের একটি উঠানে দুপুরে ১০ জন রোগীকে খোলা আকাশের নিচে মাটির বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। একজন পল্লি চিকিৎসক রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে যান সৈয়দপুর ১০০ শয্যা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। ইতিমধ্যে ২০০ রোগীকে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের বাসায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শিশু সেলিমের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নুরুল আক্তার বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাটি হাসপাতালে আনার আগেই মারা যায়। 
যোগাযোগ করা হলে নীলফামারীর ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন আবদুল মজিদ বলেন, ‘ওরসের খিচুড়িগুলো নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে দীর্ঘক্ষণ থাকায় বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ কারণে সবাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদ গতকাল ওই গ্রামগুলো পরিদর্শন করে ঘটনা তদন্তে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনারকলি মাহবুবকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইউএনও আনারকলি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আক্রান্ত এলাকায় চিকিৎসক দল কাজ করছে। কাজেই উদ্বেগের কিছু নেই।’ 
বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ: শিশু সুরভীর মৃত্যু প্রসঙ্গে বদরগঞ্জ উপজেলা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. জেনাতুল্লা বলেন, সন্তোষপুর পাতাইপাড়ার শরিফ উদ্দিন ওরস থেকে খিচুড়ি এনে পরিবারের সদস্যদের খাওয়ান এবং নিজেও খান। ওই খিচুড়ি খেয়ে তিনি ও তাঁর মেয়ে সুরভী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। গতকাল ভোরে সুরভীর মৃত্যু হয়।
গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে তারাগঞ্জের হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত নারী-পুরুষ ও শিশুদের রিকশা-ভ্যান ও ভটভটিতে করে আনা হচ্ছে। সেখানে খোলা হয়েছে অস্থায়ী চিকিৎসাশিবির। আক্রান্ত রোগীদের ঘিরে কান্নাকাটি করছিল স্বজনেরা। 
ওই শিবিরে চিকিৎসক আবদুল মতিন বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৬২ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ৩২ জনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের শিবিরে শতাধিক ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। 
অন্যদিকে, বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন হেমন্ত রায় চৌধুরী বলেন, খিচুড়ি খেয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জনকে এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জনকে ভর্তি করা হয়েছে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ